সুন্দরী আন্নিদো। যেমন তার গড়ন-পেটন, নাক-নক্সা, তেমনি সে সুশীলা। কোন কাকভোরে পূবপাহাড়ের মাথার আকাশে যখন একটু একটু রঙের ছোঁয়া লাগে, তখন তার ঘুম ভাঙে। ঘরের খোঁয়াড়ে বাঁধা লালঝুঁটি কুঁকড়োগুলো গলার শির ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে ডেকে তাদের ভগবান সূর্যকেই যেন সুপ্রভাত জানায়। আন্নিদো পা টিপে টিপে বিছানা ছাড়ে। তাদের বাঁশ-কাঠের ঘরে পা ফেলায় বড় আওয়াজ খচমচ, খচমচ। মা বাবা জেগে না যায়!
সকালে উঠেই অনেক কাজ তার। খোঁয়াড়ের মুরগী আর শুয়োরগুলো খাবার জন্যে হা পিত্যেশ করছে! তাদের খুদকুঁড়ো দিয়েই ঘরের লাগোয়া একটুকরো জমিটা একটু খুঁড়ে দিতে হবে। সেখানে আন্নিদো লাগিয়েছে মুলো আর সর্ষে। লকলকিয়ে তারা বেড়ে উঠছে। আন্নিদোর দেখে দেখে আর আশ মেটে না। পাহাড়ের কোলে তাদের ছোট্ট গ্রাম হংও বড় সুন্দর। ঐ বুঝি সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে পাহাড়ে। পাইন গাছের মাথায়। এবার জেগে উঠবে তাদের গোটা গ্রাম। সবুজ ধানের খেত হেসে উঠবে। আন্নিদো কাঠকুঠো জ্বেলে ভাত রেঁধে আর মাংস ঝলসিয়ে দৌড়বে ধানের খেতে। সেখানে সখিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে দিনভর কাটিয়ে দেবে চাষের কাজে।
আন্নিদোকে নিয়ে তার মা-বাবার গর্বের শেষ নেই। বাঁশের কোঁড় দিয়ে তার হাতের রাইশাক সেদ্ধ সবাই চেটেপুটে খায়। বন থেকে কাঠ কুড়োনোর সময় ঐ মেয়ে কি জানি সব ঘাসপাতা যোগাড় করে আনে। ভাত সেদ্ধ করার সময়, মাংস ঝলসে তাতে কুঁচিয়ে ছড়িয়ে দেয়। খাবারের স্বাদ বাড়ে। জড়িবুটি জানে আন্নিদো। তার মত কাপড় বুনতে, পুঁতির মালা গাঁথতে হং গ্রামে আর কেউ পারে না।
কবে বিয়ে দেবে এমন সর্বগুণসম্পন্না মেয়ের? পাড়াপড়শীর কৌতুহল আর প্রশ্নের শেষ নেই!
‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর
অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর!’
তাই তো আন্নিদোর মা-বাবার বড় চিন্তা। উপযুক্ত পাত্র কোথায় পাওয়া যায়। এবার ফসল তোলার ‘ড্রী’ উৎসবে ভগবান সিইকির কাছে মানত করেছে আন্নিদো-র মা-বাবা, হে ঈশ্বর আমাদের মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি যেন ঘর বর পায়! না হলে যে আমরা মরেও শান্তি পাব না।
কি আশ্চর্য রাতে স্বপ্ন দিলেন সিইকি! আন্নিদোর মা-বাবা দু-জনেই স্বপ্নাদেশ পেল, “মেয়ের কপালে, নাকে উল্কি এঁকে দাও। নাসা রন্ধ্রে পরিয়ে দাও বেতের তৈরি ইয়াপিং হুলো। দেখবে খুব তাড়াতাড়ি তোমার মেয়ে সুপাত্রস্থ হবে।”
যেমন কথা তেমনি কাজ! মুখের উল্কি আর নাকছিপি নিয়ে সুন্দরী আন্নিদো খুব তাড়াতাড়ি পাশের গাঁয়ের জোয়ান ছেলে চাদের গলায় মালা দিল। ভগবান সিইকি-র আশীর্বাদে তাদের সুখের সংসারে সম্পদের বন্যা। কাঠ-বাঁশের ঘর সন্তানসন্ততিতে ভরা চাঁদের হাট।
ভগবানের আশীর্বাদের কথা প্রচার হয়ে গেল আপাতিনিদের ঘরে ঘরে। তাদের ‘নাগো’ অর্থাৎ উৎসব মঞ্চে পুরোহিত বিধান দিলেন এবার থেকে সব আপাতিনি বালিকাদের প্রথম রজোদর্শনের পর মুখে উল্কি আঁকা হবে। নাসারন্ধ্রে পরিয়ে দেওয়া হবে বেত বা কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি ছিপি বা ইয়াপিং হুলো।
ব্যস, কয়েকশো বছর ধরে ইয়াপিং হুলো আটকে রইলো আপাতিনি মেয়েদের নাকের ফুটোয়। প্রথম সূর্যের আলো পাওয়া অরুণাচল প্রদেশ। তার নিম্ন সুবর্ণসিঁড়ি জেলার আপাতিনি আদিবাসী মেয়েরা এইভাবেই বিস্ময়ের কারণ হয়ে উঠলো জগতের চোখে।
ধীরে ধীরে পরিবর্তনের স্রোত বৃষ্টি ধারার মত নেমে এল পাহাড়ের গা বেয়ে। চাঁদসূর্যের উপাসক আপাতিনিদের খ্রীষ্টান মিশনারীরা খ্রীস্টের বাণী শোনাল। এককালের নিয়মনিগড়ে বাঁধা আদিবাসীদের গ্রাম্য জীবন বিস্তৃত হল দিকে দিকে। শিক্ষার আলো পুরোনো রীতিনীতিকে বর্জন করতে চাইলো। মেয়েরা আর পরলো না নাকের ঐ অদ্ভুত গয়না। সাজতে চাইল না মুখের উল্কি সাজে। স্বাধীন হল তারা।
তবু নয় নয় করেও রয়ে গেল আপাতিনিদের কিছু রীতিনীতি, নিয়ম। সাজপোশাক, খাদ্যাভ্যাস। না হলে যে, হিমালয়ের পদাশ্রিত এই সুন্দর সবুজ উপত্যকা থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে আপাতিনিরা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এক আদিম প্রকৃতি উপাসক সহজ-সরল জীবনধারা।