কলকাতায় যত নাটক অভিনীত হয়েছে ভারতের আর কোথাও তত হয়নি। সে দিক থেকে কলকাতাকে নাটুকে শহর বলা যেতে পারে। এমন নাটক-পাগল শহর ভারতে আর দ্বিতীয় নেই। কলকাতার মত এত স্থায়ী রঙ্গমঞ্চও ভারতে বিরল। কলকাতায় স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয় ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতার রঙ্গমঞ্চ ও নাটক অভিনয়ের ইতিহাসকে মোটামুটি দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৮৭৩ থেকে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এটাকে গিরিশ যুগ বলা হয়। এর পরের যুগ ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ীর যুগ। প্রথম যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল সুরেলা অভিনয় ও নট-নটীদের একঘেয়ে বেশভূষা ও মলিন দৃশ্যপট। রূপস। করবার উপকরণও ছিল মামুলী, যথা আলতা, সিঁদুর হলুদগুঁড়ো, পিউরী, খড়ি, ভুষোর কালি। আর রঙ্গমঞ্চ আলোকিত করা হত পাদ-প্রদীপ দিয়ে। বেশভূষারও কোন কালোপযোগী বৈশিষ্ট্য ছিল না। আজ যে পোষাক পরে চন্দ্রগুপ্তের আবির্ভাব ঘটত, কাল সেই পোষাক পরেই জাহাঙ্গীরের ভূমিকা অভিনীত হত। তা ছাড়া এ যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতি রজনীতে তিন-চারখানা করে নাটকের অভিনয়। পাল-পার্বনে দশ-বারোখানা নাটকও অভিনীত হত। আজ সন্ধ্যায় অভিনয় শুরু হয়ে, কাল প্রভাতে সাতটা-আটটায় শেষ হত। দ্বিতীয় যুগের উদ্বোধন করেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। সুরেলা অভিনয়ের অবসান ঘটে। তার পরিবর্তে আসে স্বাভাবিক অভিনয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেশভূষা ও দৃশ্যপট কালোপযোগী করা হয়, এবং রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের ক্ষেত্রে নূতন টেকনিক অবলম্বিত হয়। পাদ-প্রদীপের পরিবর্তে আসে মঞ্চের ওপর আলোকসম্পাত।
১৯৩১-এর পর ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের প্রবর্তন হয়। এককথায় নাট্যজগতে শিশিরকুমার এক বিপ্লব আনেন। সময় অনুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধুলো উড়ে না রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটলো শম্ভু মিত্রের স্কুল জীবন থেকেই নাটকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। প্রচুর বাংলা নাটক পড়েছেনও। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ছাত্র ছিলেন যখন, নিয়মিত যাতায়াত ছিল পাড়ার থিয়েটারে। নাট্যচর্চার সূচনা ১৯৩৯ সালে, কলকাতার রংমহল থিয়েটারে অভিনয়ের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে মিনার্ভা এবং এরপর নাট্যনিকেতনের সাথে যুক্ত হন। নাট্যনিকেতন দলটি নাম পাল্টে শ্রীরঙ্গম হয়েছিল। শ্রীরঙ্গমে শম্ভু মিত্রের সাথে পরিচয় হয় বিখ্যাত নাট্যকার শিশিরকুমার ভাদুড়ীর। ততদিনে শম্ভু মিত্রের জীবনের অংশ হয়ে গেছে নাটক। আর জীবন দর্শনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েছে শিল্প দর্শন। সেই তাগিদে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হন ফ্যাসিবাদবিরোধী শিল্পী সংঘ গণনাট্য সংঘের সাথে। একাধারে তিনি অভিনয় করেছেন, নাটক রচনা করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং বাংলা নাটককে আধুনিক শিল্পযাত্রাপথে এগিয়ে যেতে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। থিয়েটার একটি দলগত শিল্প। থিয়েটারে যেমন ব্যক্তি প্রতিভার স্থান রয়েছে আবার দলগত কর্মযজ্ঞের কোনও বিকল্প নেই। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে গিরিশ যুগ, শিশির যুগের পর শম্ভু মিত্র পদার্পণ করেছিলেন এবং অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য যুগচিহ্ন। ব্যক্তি-অভিনেতা কেন্দ্রিক পেশাদারি থিয়েটারের যুগাবসানের পর যে গণনাট্যের যুগ শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন শম্ভু মিত্র। বিখ্যাত নাট্যদল ‘বহুরূপী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন শম্ভু মিত্র।
আজকে যার কথা লিখতে বসেছি খেয়াল করে দেখলাম তাকে নিয়ে আলোচনা তুলনামূলকভাবে খুবই কম, যতটা আলোচনা তাঁর স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে পাই তার তুলনায় তাঁকে নিয়ে লেখা যতটা হবার কথা ততটা নেই তিনি তৃপ্তি ভাদুড়ী। তৃপ্তি ভাদুড়ী নামে চিনতে খানিক সময় লাগলেও তৃপ্তি মিত্র বললে থিযেটার প্রেমী সবাই তাকে চিনবেন জানি। অথচ কী আশ্চর্য, এই মানুষটাই কি না তাঁর কৈশোরে ডাক্তার, প্রফেসর নয়তো সমাজসেবী হবে ভেবে তৈরি হচ্ছিল! এমনকী তাঁর মঞ্চে ওঠা নেহাতই পাকেচক্রে। টাঙ্গন নদীর পারে বর্তমান বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁ জেলার মেয়ে। বাবা আশুতোষ ভাদুড়ি। পেশায় উকিল। মা শৈলবালা স্বদেশীতে উৎসাহী। তাঁদেরই নয় মেয়ে, এক ছেলের একজন তৃপ্তি। মাসতুতো ভাই গোষ্ঠদা অর্থাৎ বিজন ভট্টাচার্যর লেখা নাটকে হঠাৎই এক অভিনেত্রী উধাও হয়ে যাওয়াতে শেষ মুহূর্তে ধরেবেঁধে নামানো হয় কিশোরী তৃপ্তিকে। এর পর বলতে গেলে ওই মাসতুতো ভাইয়ের জোরাজুরিতেই তাঁর থিয়েটারে আসা। তৃপ্তি ভাদুড়ীর জন্ম ২৫ অক্টোবর, ১৯২৫ সালে। তৃপ্তি ভাদুড়ীর তৃপ্তি মিত্র হয়ে উঠার পেছনের গল্পে বহুরূপী ও শম্ভু মিত্রের নাম বারবারই ঘুরে ফিরে আসবে। ১৯৪৮ সালে বহুরূপীর জন্ম। কাজ শুরু হয়ে যায়। যদিও নামকরণ হয়েছিল বছর দুই পরে, ১৯৫০ সালে। দেশের এবং ব্যক্তিগত জীবনের চরম বিপর্যয়ের মধ্যেই বহুরূপীর জন্ম। বলা যেতে পারে বহুরূপী শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের প্রথম সন্তান। বহুরূপী প্রযোজিত নবান্ন নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল রঙমহলে ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। এরপর ক্রমান্বয়ে বহুরূপী মঞ্চে আনে পথিক, উলুখাগড়া, ছেঁড়া তার, বিভাব, চার অধ্যায়, দশচক্র, স্বপ্ন, এই তো দুনিয়া, ধর্মঘট, রক্তকরবী প্রভৃতি নাটক।
রক্তকরবী প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১০ মে ১৯৫৪ সালে, ইবিআর ম্যানসন ইনস্টিটিউট শিয়ালদহে, শেষ অভিনয় ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে। তৃপ্তি মিত্র বাংলা নাট্য জগতে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত রক্তকরবীর নন্দিনীর জন্যই যদিও কালজয়ী ‘নবান্ন নাটকের মাধ্যমে তার অভিনয় পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ‘অপরাজিতা’, ‘রাজা’, ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’, ‘পুতুলখেলা’ ইত্যাদি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে গতবছরই রক্তকরবীর শতবর্ষ গেল সেই অর্থে বলা যায় নন্দিনী চরিত্রটিরও একশ বছর গেলো গতবছর আর নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করা তৃপ্তি মিত্রের শতবর্ষ এই বছর! ১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাটকের প্রথম স্রষ্টা বিজন ভট্টাচার্য রচিত জবানবন্দী নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় জীবন শুরু। ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির তখনকার সম্পাদক পূরচাঁদ যোশীর আগ্রহে মুম্বাইয়ে খাজা আহমদ আব্বাস জবানবন্দীর কাহিনী নিয়ে নির্মাণ করেন হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ধরতি কে লাল’। শম্ভূ মিত্র ছিলেন সহকারী পরিচালক। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে থিয়েটারের সাথে চলচ্চিত্রেও নাম লেখান তৃপ্তি মিত্র। এর পর ডাক পেয়েছেন মহেশ কাউলের ‘গোপীনাথ’-এও। কিন্তু থিয়েটার তত দিনে তাকে কব্জা করে ফেলেছে। তারই মধ্যে তখন বোম্বে গিয়ে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে আলাপ, ১৯৪৫ সালে বিয়ে। থিয়েটার করতে করতেই সংসার করেছেন। সংসার করতে করতে থিয়েটার। খুন্তি নাড়ার সময়ও হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে সংলাপ মুখস্ত করেছেন মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ বিজন ভট্টাচার্যের লেখা নাটক ‘নবান্ন’ প্রথম অভিনীত হল শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যের যৌথ নির্দেশনায় ২৪ অক্টোবর ১৯৪৪-এ শ্রীরঙ্গম নাট্যগৃহে। প্রথম রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যে প্রধান সমাদ্দারের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য এছাড়াও শম্ভু মিত্র (দয়াল ও টাউট), সুধী প্রধান (কুঞ্জ), জলদ চট্টোপাধ্যায় (নিরঞ্জন),গঙ্গাপদ বসু (হারু দত্ত ও বরকত), চারুপ্রকাশ ঘোষ (কালীধন ধাড়া), সজল রায়চৌধুরী (রাজীব), মণিকুন্তলা সেন (পঞ্চাননী), শোভা সেন (রাধিকা), তৃপ্তি ভাদুড়ী (বিনোদিনী), চিত্তপ্রসাদ হোড় (বরকর্তা), গোপাল হালদার (বৃদ্ধ ভিখারি), শম্ভু ভট্টাচার্য (ডোম) প্রমুখ। আবহসঙ্গীত – গৌর ঘোষ, মঞ্চাধ্যক্ষ – চিত্ত ব্যানার্জী, উপদেষ্টা – মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, পরিচালনা – শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্য।
বাংলায় ব্যবসায়িক থিয়েটারের তারকা প্রথা (Star System) ‘নবান্ন’ অভিনয়ের মাধ্যমে ভেঙেগেল। কোন একক নায়কচরিত্র বা নায়িকাকেন্দ্রিক অভিনয় নয়, বদলে প্রতিষ্ঠিত হল গ্রুপ এ্যাক্টিং বা সম্মেলক অভিনয়ের নতুন রীতি, নতুন ধারা। যে ধারা সম্ভব হয়েছিল জীবনের আবেগ থেকে, উদ্দেশ্য থেকে, কোন পেশার কারণে নয়। তাই বুঝি যুগান্তর লিখেছিল — এই ধরনের নাটক কেবল নতুনতর আর্ট হিসাবেই প্রশংসনীয় নহে, দুঃস্থ ও নিপীড়িত মনুষ্যত্বের প্রতি ইহা যে বেদনা জাগ্রত করে তাহার মূল্য অনেক।” বহুরূপী নাট্যদল ১৯৪৮ সালে রঙমহলে পুরনো ‘নবান্ন’ মঞ্চস্থ করল। আগের সেই ঐতিহাসিক প্রযোজনার চারুপ্রকাশ ঘোষের জায়গায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুধী প্রধানের বদলি কালী সরকার, তৃপ্তি মিত্র নিজের পুরনো চরিত্রের বদলে শোভা সেনের জায়গায় আর তাঁর পুরনো চরিত্রে দেখা গেল সহোদরা মুক্তি গোস্বামীকে। বিজন ভট্টাচার্য এই প্রযোজনায় প্রথম ও শেষবার যুক্ত ছিলেন নিজের পুরনো চরিত্রে।
নবান্ন নাটকে ছোটবউ বিনোদিনী, ‘ছেঁড়া তার’-এ ফুলজান বিবি, ‘বিসর্জন’এ গুণবতী, ‘ওয়াদিপাউস’এ ইয়োকান্তে, কাঞ্চনরঙ্গে তরলা, ‘বাকি ইতিহাস’এ কণা, ‘চোপ আদালত চলছে’তে বেনারে, পুতুল খেলায় বুলু ও ‘রাজা’ নাটকে রাণী সুদর্শনা প্রভৃতি স্মরণীয় চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র। তবু তাঁর রক্তকরবীর নন্দিনী চরিত্রটিই স্মরণীয় হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় রক্তকরবীর কোন মঞ্চায়ন দেখে যেতে পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী ‘রক্তকরবী’ অভিনয় করুন। শিশিরকুমারেরও তেমন ইচ্ছা ছিল, কিন্তু নন্দিনী করার মত অভিনেত্রীর সন্ধান পাননি, ফলে তাঁরও রক্তকরবী করা হয়নি। অবশেষে শম্ভূ মিত্রর নাট্য শিক্ষায় সার্থক ‘নন্দিনী’ পেয়েছিল বাংলা থিয়েটার। রক্তকরবীর নন্দিনী যেমন রবীন্দ্রনাট্যের শ্রেষ্ঠ নারী চরিত্র, তেমনই তৃপ্তি মিত্রর ‘নন্দিনী’ ভারতীয় থিয়েটারের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। দীর্ঘ এগারো বছর নানা সময়ে তিনি নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নন্দিনী রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। নন্দিনী প্রেমের প্রতীক। সুন্দরের প্রতীক হয়ে যক্ষপুরীতে আসে নন্দিনী,যক্ষপুরীর জাল ছিঁড়ে আলোর দরজা খুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখায়। নন্দিনী চরিত্রে তাঁর যেন সম্মোহন করে রাখতো পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের দর্শকমন্ডলীকে। নন্দিনী কখনো স্নেহ প্রবণ, কখনো গদ্যময়, কখনো তেজস্বিনী আর প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি একবার যারা নন্দিনী চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রর কাব্যিক বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় প্রত্যক্ষ করেছেন, সেটি তার অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। রক্তকরবীর নন্দিনী তৃপ্তি মিত্রর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজন, সংশয় নেই। তৃপ্তি মিত্র যতোদিন নন্দিনী সেজে মঞ্চে উঠেছেন, প্রতিবারই প্রেক্ষাগৃহ থাকতো কানায় কানায় পূর্ণ। পরবর্তীতে তৃপ্তি মিত্রের কন্যা শাঁওলী মিত্র-সহ মধুমতি বসু, অনিন্দিতা রায়, বাসন্তী গুহ প্রমুখ ডাকসাইটে অভিনেত্রীরা এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কেউই তৃপ্তি মিত্রের মতো খ্যাতি পান নি। নন্দিনী ছাড়াও ‘রাজা ওয়াদিপাউস’ নাটকে ‘ইয়োকান্তে, পুতুল খেলায় ‘বুলু’ ও রবীন্দ্রনাট্য রাজা তে রাণী সুদর্শনার চরিত্রে তার সম্মোহনী অভিনয়। ‘ওয়াদিপাউসে’ রাজার চরিত্রে শম্ভূ মিত্র হয়তো তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছিলেন তেমনই রাণি ইয়োকাস্তের চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রর অনন্য অভিনয় প্রতিভার ছটায় উজ্বল হয়ে আছে। রাজা ওয়াদিপাউস যে তাঁরই সন্তান এই সত্য জানার পর ইয়েকাস্তের হাহাকার “হায় মানুষ, নিজের ইতিবৃত্ত তুমি যেন কখনো না জানো” কোনদিন ভোলার নয়। রাজা নাটকের রাজা কোন রক্তমাংসের রাজা নয়, রাণী সুদর্শনারই এক খন্ডসত্তা। সুদর্শনা চরিত্রে তৃপ্তি মিত্র আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয়ে যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন দর্শকদের। কখনো উগ্র, কখনো হতাশা জর্জর, কখনো অভিমানী – স্বর নিয়ন্ত্রণ ও প্রক্ষেপনে সম্মোহিত করে রাখতেন। নাট্যচরিত্রের অনুপুঙ্খ অধ্যয়ন ও তার ভেতরে প্রবেশ করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেই ক্ষমতা বলেই প্রখর মেধা ও শিল্প চেতনার অপরূপ সমন্বয় ঘটিয়ে তাঁর অভিনীত নাটকগুলির চরিত্র নির্মাণকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে তৃপ্তি বলেছিলেন — “…সেই রাজার কথা ভাবো – রাজা নাটকে রানী সুদর্শনা, দেখো তার আগে ‘ওয়াদিপাউস’এ রানী করেছি, অনেক রানী দেখেছি, যাত্রা থিয়েটারের অভিনয়ে, এদেশের বিদেশের অনেক রানী চরিত্র দেখেছি। কিন্তু ‘রাজা’র যে রানী ‘সুদর্শনা’ সে একেবারেই অন্যরকম। কে রাজা? রানী কে? ওয়াদিপাউসের রানী করা সহজ কারণ,এ রকম রানী ইতিহাসে ছিল। কিন্তু ‘রাজা’র রানী কোথাও নেই,কেউ ছিল না, … (তথ্যসূত্র – পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা / মে ২০০৭ সংখ্যা থেকে)। ‘রাজা’ নাটকের সুদর্শনার চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রর অভিনয় প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষের মন্তব্য উদ্ধার করি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৬৬-র ১৭ই জুন সন্তোষকুমার লিখেছিলেন … সম্রাজ্ঞীর মত সমগ্র রঙ্গমঞ্চ জুড়ে ছিলেন তৃপ্তি মিত্র। উদাসীন রাজার আচরণে কখনও ওভমানিনী, কখনও সর্বস্ব ত্যাগিনী – বহু পরস্পর-খন্ডী আলো-ছায়ায় সুদর্শনা রূপিনী তিনি এই-স্থির, এই-চঞ্চল পায়ে নায়াসে সঞ্চরণ করেছেন। রাজা যদি অরূপ বীণা তিনি সেই বীণার গান।” (পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা / মে ২০০৭ সংখ্যা থেকে )। এ দেশে থিয়েটার তার কর্মীদের রুজি-রুটির ব্যবস্থা করতে পারে না। অতয়েব তাঁকে যেতে হয়েছিল পেশাদারী থিয়েটারে সংসার চালানোর তাগিদে। ১৯৫৯-এ যোগ দিলেন বিশ্বরূপা থিয়েটারে। রাসবিহারী সরকার পরিচালিত ‘সেতু’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি। তাপস সেনের আলোর জাদু আর তৃপ্তি মিত্রর অসামান্য অভিনয়ে ভর করে ‘সেতু’ নাটকটি নজির গড়েছিল ১২৫০ রজনী অভিনয়ের।
অনেকগুলি ছায়াছবিতেও অভিনয় করেছিলেন তৃপ্তি মিত্র। ১৯৪৬-এ খাজা আহমেদ আব্বাসের ‘ধরতি কে লাল’ করার পর ১৯৫০-এ ঢাকায় চলচ্চিত্রায়িত উর্দু ছবি ‘জাগা হুয়া সবেরা’তে অভিনয় করেন। এ ছাড়া অনেকগুলি বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পথিক (১৯৫৩), ময়লা কাগজ (১৯৫৪), রিক্সাওয়ালা (১৯৫৫), শুভ বিবাহ (১৯৫৯), মাণিক (১৯৬১), সূর্যস্নান (১৯৬২), ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্প’ প্রভৃতি।
শম্ভূ মিত্রর শিক্ষায় নিজেকে তৈরি করেছিলেন তৃপ্তি। সেই শম্ভূ মিত্র সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল থিয়েটারী কারণে। ‘পুতুল খেলা’ নাটকের রিহার্শালে তাঁর অভিনয় চলাকালীন শম্ভূ মিত্র এমন একটা ভঙ্গি করতেন তাতে তৃপ্তির মনে হয়েছিল তার মনসংযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যই তিনি এটা করছেন। দুই প্রবল ব্যক্তিত্বের সংঘাত দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছিল। অথচ শেষজীবনে শম্ভু মিত্র এনে রাখলেন নিজের সাথে তৃপ্তি মিত্রকে। দু’জনে দু’জনকে তখন চোখে হারাতেন। কোনও বাড়াবাড়ি নেই। ভিতরের ছটফটানি বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। শুধু দম বন্ধ করে এক প্রবীণ মানুষ তাঁর সব কষ্ট চেপে ধীরে ধীরে বহু কালের সঙ্গীকে নিভে যেতে দেখছেন, এটুকু অনুভব করা যেত শুধু।
আকাশবাণী কলকাতায় রেডিও নাটক ও প্রশাসনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি আকাশবাণীর সংগ্রহশালা থেকে কমপ্যাক্ট ডিসকে ধ্বনিবদ্ধ রেডিও নাটক ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’য় শম্ভূ মিত্রর সঙ্গে তাঁর বাচিক অভিনয় এখনও শিহরণ জাগায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত তিনি আকাশবাণীর বিশেষ সম্মানীয় প্রযোজক (প্রোডিউসার এমিরিটাস) ছিলেন। ১৯৮১তে বিশ্বভারতী নাট্য বিভাগের ভিজিটিং ফেলো মনোনীত হয়েছিলেন। শম্ভূ মিত্র বহুরূপী থেকে সরে যাবার পরেও তৃপ্তি বহুরূপীতে ছিলেন ১৯৮২ পর্যন্ত। ১৯৮৩তে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন নাট্যশিক্ষা কেন্দ্র ‘আরব্ধ’, সেখানে নবীন শিক্ষার্থীদের নাট্যাভিনয় শেখাতেন, শিল্পী গড়ার কাজ করতেন। ‘আরব্ধ’ তৃপ্তির নির্দেশনায় নবরূপে ‘রক্তকরবী’র নির্মাণ ও অভিনয় করেছিল ১৯৮৪-র জানুয়ারিতে। নব পর্যায়ের রক্তকরবীতে অবশ্য তিনি অভিনয় করেননি। এছাড়া ‘আরব্ধ’ তাঁর নির্দেশনায় আরো কয়েকটি নাটক – একক নাট্য ‘অপরাজিতা’ ও বিধায়ক ভট্টাচার্যর ‘সরিসৃপ’ ও ‘হাজার চুরাশির মা’ মঞ্চায়ন করেছিল। বহুরূপীর রবীন্দ্রনাটক ‘ডাকঘর’ নাটকটিরও পরিচালক ছিলেন তৃপ্তি মিত্র। তৃপ্তি মিত্র ১৯৬২তে ললিতকলার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মান পান। এছাড়া ১৯৭১-এ পদ্মশ্রী, ১৯৮৭তে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি সম্মান ও ১৯৮৯তে মধ্যপ্রদেশ সরকারের কালীদাস সম্মানে ভূষিতা হন। ১৯৮৯-এর ২৪শে মে চৌষট্টি বছর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় থিয়েটারের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র।
তথ্যসূত্র :
তৃপ্তি মিত্র : অন্য বিনোদিনী লেখক: দেবতোষ ঘোষ
মিত্র তৃপ্তি, নাটক সমগ্র
মিত্র তৃপ্তি, এই পৃথিবী রঙ্গালয়
মিত্র শাঁওলী, রচনাসংগ্রহ-১
চৌধুরী দর্শন, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস
মিত্র শাঁওলী, গণনাট্য, নবনাট্য, সৎনাট্য ও শম্ভুমিত্র
ঘোষ দেবতোষ, শম্ভু মিত্র শ্রীচরণেষু
আনন্দবাজার পত্রিকা
পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা
সংবাদ প্রতিদিন রোববার
ভোর, ২৯ মে, ২০২৫