পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি প্রকাশিত আলাউদ্দিন খাঁ : জীবন সাধনা ও শিল্প (১৯৯৬) গ্রন্থের মুখবন্ধে আকাদেমির সভাপতি শ্রীজ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ লিখেছেন, ‘আলাউদ্দিন খাঁ যন্ত্রসংগীতের জগতে প্রায় সকলেরই গুরুস্থানীয় ছিলেন। তিনি তাঁর কন্যা অন্নপূর্ণাকে তাঁর বিদ্যায় পারদর্শিনী করে তোলেন। খাঁ সাহেবকে আমি বলতে শুনেছি, “আমার বাজনা যদি কেউ বাজিয়ে থাকে তবে সে আমার মেয়েই বাজিয়েছে।” স্নেহবশত বলা হলেও এর মধ্যে একটি গভীর সত্য ছিল। বস্তুত অন্নপূর্ণাকে তিনি নিজের মতো করেই তৈরি করেছিলেন। তারপর আলি আকবর, রবিশঙ্কর (মুখবন্ধ)।’
১৯২৭ সালের ২৩ এপ্রিল চৈত্র পূর্ণিমার অন্নপূর্ণাদেবী-পূজার রাত্রে জন্ম হওয়ার সূত্রে মাইহারের মহারাজা তাঁর সভাগায়ক আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা রওশন আরার নাম রাখেন অন্নপূর্ণা।
আলি আকবর খাঁ (১৯২২-২০০৯) লিখেছেন: ‘অন্নপূর্ণার গানবাজনা শেখার সঙ্গে আমার অপদার্থতার সম্পর্ক আছে। একদিন সকালে একটা জিনিস বারবার চেষ্টা করেও যন্ত্রে আনতে পারছিলাম না। বাবা রেগেমেগে থলি হাতে বাজারে চলে গেলেন। ঠিক তখনই অন্নপূর্ণা সেই ঘরে এসে আমার ভুলে যাওয়া ওই ফ্রেজটা গেয়ে গেয়ে বলল, “এভাবে বাজাও, দাদা”। আমি তো অবাক, বুঝলাম বাবা যখন আমাকে শেখান, কাছাকাছি থাকলে শুনে শুনেই ও সেসব গলায় তুলে নেয়। আমি ওর গাওয়া শুনে পিসটা যন্ত্রে তুলে নিচ্ছি, এমন সময় আবার বাবার প্রবেশ; থলে নিয়ে বেরিয়েছিলেন কিন্তু রাগের ঝোঁকে টাকা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণার এই আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে সেদিন সন্ধে থেকেই অন্নপূর্ণাকে তানপুরা ধরিয়ে সরগম শেখাতে শুরু করেন বাবা। গানের সাথে সাথেই ছোট সেতার কিনে সেটাও শেখাতে শুরু করেন। বারো-তেরো বছর বয়সে শেখাতে শুরু করেন সুরবাহার। আশ্চর্য ক্ষমতা তো ছিলই, সেই সঙ্গে অন্নপূর্ণার নিষ্ঠার জবাব নেই। অন্নপূর্ণা আলাপটাকে একটা অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। সে বাবার মতোই বাজনায় শুদ্ধতার ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করত না। আলাপের পনেরোটা অঙ্গ নিখুঁতভাবে বাজাত। গভীর রাগই বেশি বাজাত অন্নপূর্ণা। আমরা যেমন ভৈরবীতে সব পর্দা লাগিয়ে দিই, ও বাজাত ‘শুদ্ধ ভৈরবী’। ওর বাজনার গভীরতা সমঝদারের অন্তরে গিয়ে ঘা দিত।’ (পৃ. ৯৭, স্বরসম্রাট উস্তাদ আলি আকবর খান, অতনু চক্রবর্তী, পারুল, কলকাতা, ২০১০)।
কিন্তু মহত্তম মানের এই সংগীতশিল্পীর জীবনটিকে সার্বিকভাবেই তছনছ করে দিয়েছে অপ্রত্যাশিত একটি অসময়ের বিয়ে এবং সংগীতজগৎকে বঞ্চিত করেছে তাঁর অলৌকিক সংগীতসুধা শ্রবণ থেকে।
অন্নপূর্ণার অফিশিয়াল বায়োগ্রাফার, স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘রবিশঙ্করের মাইহারে থাকার তিন বছরের মধ্যেই উদয়শঙ্কর অন্নপূর্ণার সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাব শুনে আলাউদ্দিন হকচকিয়ে গেলেন।
তাঁরা মুসলমান এবং যথেষ্ট রক্ষণশীল। আলাউদ্দিন জানতেন, তাঁর জাতিবর্গ ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে হিন্দুর সঙ্গে বিবাহের ও প্রস্তাবে সমর্থন মিলবে না। তা ছাড়া তাঁর মনে নানা প্রশ্ন জাগল। হঠাৎ এ বিয়ের প্রস্তাব কেন? এ কি রবিশঙ্করের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁকে দাসখত লেখানোর জন্য? কুলীন ব্রাহ্মণ হয়ে মুসলমান ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য এই আগ্রহ কেন? তা ছাড়া উদয়শঙ্কর নিজে এখনো বিয়ে করেননি। তা হলে রবিশঙ্করের বিয়ে দেওয়ার জন্য এত তোড়জোড় কেন?
মাইহার মহারাজের কাছ থেকেও তিনি বিয়ের প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন পেলেন না। “আসলে আমাদের ধারণা যে উস্তাদের পরিবারের অঙ্গ না হলে পুরো তালিম মেলে না, এটা দুর্ভাগ্যজনক”, ব্রিজনাথ সিংহ একটি বাক্যে মনের কথা জানালেন। আলাউদ্দিন পড়লেন মহা মুশকিলে। কাউকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দুঃখ দেওয়ার মতো মন তাঁর নয়। অতএব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব।’ (অন্নপূর্ণা, পৃ. ৩৫-৪৪, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০১)। নসিবের ফেরে ১৯৪১ সালেই বিয়ে হয়ে গেল অন্নপূর্ণার, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪ আর রবিশঙ্করের ২১।
বাড়ির বাইরে অন্নপূর্ণা প্রথম বাজনা শোনান মাইহারের মহারাজা ব্রিজনাথকে। তানপুরা ধরেছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। রাগ ‘মালকোষ’। যতীন ভট্টাচার্য লিখেছেন: ‘বাদনকালে শিল্পী যখনই তাঁর শীর্ষে আরোহণ করছিলেন, তখনই অনুপ্রাণিত মহারাজার আনন্দাশ্রু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল; যদিও তিনি সংগীতের মূল্য বিচারে ছিলেন খুবই কঠোর।’ (পৃষ্ঠা ৭৫, উস্তাদ আলাউদ্দিন খান অ্যান্ড হিজ মিউজিক, ১৯৭৯)।
স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অন্নপূর্ণা গ্রন্থে লিখেছেন: ‘৩০ মার্চ ১৯৫৫, দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাব আয়োজিত সংগীত সম্মেলনের শেষ দিনের অনুষ্ঠানে সেতার ও সুরবাহারে যুগলবন্দী পরিবেশন করলেন রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা। তাঁরা বাজালেন রাগ ‘শ্রী’। এর আগেও দুজনে বাজিয়েছেন যুগলবন্দী। সেই বাজনাও হয়েছিল দিল্লিতে বছর পাঁচেক আগে। আর সেদিনও অন্নপূর্ণার বাজনাই বাহবা পেয়েছিল বেশি। কিন্তু আজকের এই বাজনায় অন্নপূর্ণা যেন নিজেকেও ছাড়িয়ে গেলেন।…
বাজনা শেষে রবিশঙ্কর বললেন: “দুজনে আরও বাজাতে হলে আমাদের কিছু কথা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।…তুমি শ্রোতাদের বাহবা পাবে, যেমন পাচ্ছ, হয়তো তোমার দীর্ঘ, দীর্ঘায়িত আলাপ তাদের মোহিত করবে। যেমন গতকাল করেছে। কিন্তু…।”
অন্নপূর্ণা বললেন: “বাবার কাছে যা শিখেছি তা-ই বাজাচ্ছি। এর মধ্যে কিন্তুর কী আছে? বাবা ধ্রুপদাঙ্গে শিখিয়েছেন। প্রতিটা স্বরে আমি দীর্ঘ সময় দাঁড়াই। ফিরে আসি। কয়েদ করি। আমি বাবার বাজনা বাজাতে চাই। সারা জীবন ওই নিয়েই থাকব। সেখান থেকে একচুলও সরব না। কোনো প্রলোভনেও না। নাম যশ খ্যাতি অর্থ কিছুই আমি চাই না।”
“আমি জানি। তোমার বাজনার মধ্যে একটা ফিলিং আনতে পারো তুমি। একটা স্বরে যেমন সাপটে লেগে থাকো, সেই স্বর থেকে সবটুকু রস নিংড়ে বের করো। তোমার বাজনায় সবাই মোহিত। সুরবাহারের মজাটাই ওখানে। সেতার কেবল পুওর রিলেশনসের মতো ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে।”
আসলে রবিশঙ্কর নিজেই হীনম্মন্যতায় ভুগছিলেন।…
অন্নপূর্ণার কাছে আসল ব্যাপারটা ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাঁর ভালো বাজানো চলবে না। রবিশঙ্কর রবির মতোই একা থাকতে ভালোবাসেন আকাশে। তাই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, মঞ্চে বাজানোর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। বাবার কাছে তালিম যেটুকু পেয়েছেন, নিজের মধ্যেই অধিকৃত রাখবেন শিষ্য-প্রশিষ্যদের জন্য। এতেই তাঁর শান্তি। তাঁর জীবনের সার্থকতাও মিলবে এখানে, এই এখন তাঁর স্থির বিশ্বাস।’ (পৃ. ৬৯-৭১)
দুজনে একসঙ্গে বাজানোর কথা শুনে বাবা আলাউদ্দিন আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন—‘অন্নপূর্ণার সঙ্গে এক আসরে বাজালে রবুর কী অইব, হে যে ঢাকা পইরা যাইব।’
নিজের শিল্পীজীবন অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে রবি যেসব প্রশ্নবিদ্ধ পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন, সেসবের অনেক কিছুই লিপিবদ্ধ করেছেন আলাউদ্দিন খাঁর অফিশিয়াল বায়োগ্রাফার যতীন ভট্টাচার্য তাঁর উস্তাদ আলাউদ্দিন খান অ্যান্ড হিজ মিউজিক এবং উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও আমরা এবং অন্নপূর্ণার অফিশিয়াল বায়োগ্রাফার স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অন্নপূর্ণা এবং অ্যান আনহার্ড মেলোডি: অন্নপূর্ণা দেবী শীর্ষক বাংলা-ইংরেজি গ্রন্থগুলোতে। এখানে কেবল একটি দুঃখজনক ঘটনা উদ্ধৃত করব অন্নপূর্ণা গ্রন্থটি থেকে।
‘প্রতিবার বাইরে যাওয়ার সময় রবিশঙ্কর বিমান ঘোষকে বলতেন, “বাইরে যাচ্ছি কদিনের জন্য। তুমি অন্নপূর্ণার দেখাশোনা করবে।” এর মধ্যেও যে কিছু অন্য পরিকল্পনা থাকতে পারে, অন্নপূর্ণা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু এখন তাঁকে সেসব বিশ্বাস করতে হচ্ছে।
রবিশঙ্কর চলে গেলে বিমানদা আসেন। খোঁজখবর নেন শুভ আর অন্নপূর্ণার। রবিশঙ্করের কিছু ছাত্ররাও আসেন তাঁদের খোঁজ নিতে। সবাই মিলে অনেক রাত অবধি গল্পগুজব চলে।
রটনা হয় তিনি আর বিমান ঘোষ একই ঘরে প্রেমালাপে ব্যস্ত। রবিশঙ্কর বিশ্বাস করেন! সেই একই রবিশঙ্কর যিনি অন্নপূর্ণাকে বিমানদার অভিভাবকত্বে রাখার জন্য অত্যুৎসাহী ছিলেন।
কিন্তু আরও এক রবিশঙ্কর আছেন। তিনি কমলাকে ভালোবাসেন। কমলার স্বামী সিনেমা প্রযোজক অমিয় চক্রবর্তীর মৃত্যুর পরে কমলার সঙ্গে বসবাস করার যেটুকু বাধা ছিল, রবিশঙ্করের তাও কেটে যায়। আর তাই তিনি বোধহয় এখন মরিয়া হয়ে ওঠেন, অন্নপূর্ণার সঙ্গে নিজের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য।’ (পৃ. ৭২)
অপরের স্ত্রীর সঙ্গে একত্রবাসের কারণ জানতে চাইলে পণ্ডিতজি বলেন, ওকে তাঁর ভালো লাগে। শুনে অন্নপূর্ণা বলেন: ‘তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? ও তো তোমার অনেক ছেলেবেলার বন্ধু। আমায় কি তাহলে বিয়ে করেছিলে বাবার জন্য? তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাটুকু আদায় করার জন্য?’ (প্রাগুক্ত পৃ. ৫৪)
আদায় করেছেনও। তবে সংগীতকে যিনি সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন, সেই অন্নপূর্ণার মতো স্বতন্ত্র স্তরের ‘শিল্পী’ হয়ে ওঠার মতো একনিষ্ঠতা রবিশঙ্করের ছিল না। অতএব তিনি বিশ্বখ্যাত হয়ে রইলেন প্রধানত সৃজনশীল মঞ্চশিল্পী হিসেবেই। তাই পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য বর্ণিত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার মেধাতালিকায় আলাউদ্দিন খাঁর পরের নামটি অন্নপূর্ণার, তাঁর পরের নামটি আলি আকবর খাঁর এবং চতুর্থ স্থানটি রবিশঙ্করের। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩৬) কারণ ওঁরা সংগীতের সমাধিস্থ সাধক, আর ইনি সংগীতের মেধাবী বাদক।
এমন শিখরবাসিনী শিল্পী অন্নপূর্ণাকে সর্বদিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে তাঁর সৃজন এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে পরিচালিত নানা রকম অপপ্রচারের আরেকটি উদ্ধৃত হচ্ছে তাঁর বাবার বায়োগ্রাফারের বই থেকে।
১৯৫৬ সালে কলকাতায় আলি আকবর কলেজের উদ্ঘাটনের দিন অন্নপূর্ণার কৌশি এবং মাঝখাম্বাজ বাদন হয়েছিল অপূর্ব। কে বা কারা কৌশলে সেই অসাধারণ বাজনার বিকৃত টেপ সংগীতসমাজে প্রচার করেছিল বোঝানোর জন্য যে বাজনাটা ছিল সাধারণ মানেরই। শ্রীভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘যতই বিকৃত টেপ করুক কিন্তু সত্য চিরকালই সত্য। প্রকৃত যে বাজনা বেজেছিল তা শুনেছি অনেক পরে।’ (আলাউদ্দিন খাঁ ও আমরা দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৭-৮)।
মায়ের খানদানি প্রতিভাই পেয়েছিল শুভেন্দ্রশঙ্কর। তাই ছেলেকে সেতারি হিসেবে নিজের হাতে গড়ে তুলছিলেন অন্নপূর্ণা। কিন্তু অল্প বয়সেই ছেলের অকল্পনীয় উন্নতিতে আতঙ্কিত পিতা নানা রকম কলাকৌশলে কেবল মা থেকেই নয়, সংগীত থেকেই ছিনিয়ে তাকে আর্টস্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আমেরিকা নিয়ে গেলেন। সেই একবারই সংযম হারিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা, ছেলেটিকে ছিনিয়ে নেওয়ার সময় বলেছিলেন: ‘শুভর বাজনা শুনে তুমি বুঝতে পেরেছিলে যে তোমার ওপরে চড়ে বাজাবে। সেটা তুমি সহ্য করতে পারলে না। বাবা ঠিকই বলতেন, আগেকার কালে গুরুরা ছেলেকেও পুরো শেখাত না, কেননা যদি কখনো প্রয়োজন হয় তখন শেষ অস্ত্র ছাড়বে। তাই তাঁদের বলা হতো মিরাশি। এই কালে তোমাকেই মিরাশি দেখলাম। বাজনা শুনেই বুঝেছ, তোমার ছেলে তোমার ওপর চড়ে বাজাবে।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮-১৩২)
এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই আলি আকবর খাঁ লিখেছেন: ‘দুজনের বাজনার তুলনা করে শ্রোতারা রবিশঙ্করকে খাটো করছে দেখে অন্নপূর্ণা বাজানো বন্ধ করে দিল। ওর বাজনা যারা শুনেছে, তারাও আফসোস করে এমন বাজনা কেউ শুনতে পেল না।…পূর্ণতা দেওয়ার বদলে অন্নপূর্ণার ওপর নিরন্তর অবিচার এবং ওকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার ফলে…অন্নপূর্ণার সামনে দাঁড়ালেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। স্বামী-সন্তান-সংগীত—কী নির্মমভাবে ওর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংগীতকে নিজের মতো করেই শেষ আশ্রয় করে নিয়েছে অন্নপূর্ণা। একা বদ্ধ ঘরে বসে বাজিয়ে যায়—বাজনাতেই ঢেলে দেয় জীবনের সব কষ্ট। দু-একজনকে মাঝেমধ্যে শেখায়।’ (অ.চ. পৃ. ৯৮) সৃষ্ট হন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, বিশ্বমোহন ভাটগণ।
মুম্বাইয়ের উম্যান অ্যান্ড হোম পত্রিকায় ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত মোহন ডি. নাদকার্নির নেওয়া বিরল একটি সাক্ষাৎকারে অন্নপূর্ণা বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ শিল্পী এখন “কনসার্ট শিল্পী” যাঁরা পরম্পরা সৃষ্টি করার মতো গুরু নন। বাবার শ্রেষ্ঠ শিষ্যগণও তাঁর মিউজিকের বিশুদ্ধি থেকে দূরে সরে গিয়ে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতবোধে শ্রোতাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁরা অপ্রস্তুত ও অদীক্ষিত পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের উত্তেজিত করার সহজ পথ ধরে প্রকারান্তরে হিন্দুস্তানি মিউজিকের মৌলিক ক্ষতি সাধন করেছেন। ফলে সৃষ্ট হয়েছে ভেজাল “মিডিয়ক্রিটি”, শুদ্ধ শিল্পী নয়।’
নাদকার্নি লিখেছেন, সংগীতমহলে উস্তাদ আমীর খাঁর উক্তিরূপে কথিত আছে যে অন্নপূর্ণা আলাউদ্দিন খাঁর ৮০ ভাগ, আলি আকবর ৭০ আর রবিশঙ্কর ৪০। এ জন্যই খাঁসাহেবের ‘আল্টিমেট রেফারেন্স’ জ্ঞান করা হয় অন্নপূর্ণাকেই। তাঁর সামনে সরোদ বাজাতে দ্বিধা বোধ করেন স্বয়ং স্বরসম্রাট আলি আকবর। সে জন্য সরোদ শিখতে তিনি তাঁর ছোট বোনটির কাছেই পাঠিয়েছেন পুত্র আশীষ খাঁ এবং ধ্যানেশ খাঁকে।
অন্নপূর্ণা খাঁ তাঁর শিষ্যদের মনে রাখতে বলেন, শিক্ষাদানকালে বাবা তাঁকে বারবার বলেছেন: ‘আমার সংগীত যেন সাধারণ্যে প্রদর্শনীর জন্য না হয়ে নিজের সিদ্ধির জন্য হয়।’ কারণ প্রথমটি মহিমান্বিত করে সংগীতশিল্পীকে, সংগীতকে নয়। তাঁর শিষ্যবর্গের দীর্ঘ সারিটি বেশ সমীহ জাগানো। ‘পদ্মভূষণ’, ‘সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি পুরস্কারে ভূষিত এই মহতী শিল্পী ‘এনসিপিএ’র জন্ম থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত এর ‘প্রফেসর অব মিউজিক’ পদে বৃত ছিলেন। অন্নপূর্ণা বর্তমানে মুম্বাইয়ের ‘আচার্য আলাউদ্দিন মিউজিক সার্কেল’-এর প্রাণসত্তাস্বরূপ। তাঁর সমগ্র জীবনের একমাত্র লক্ষ্য—বাবা আলাউদ্দিন খাঁর শুদ্ধতম সংগীতের দীপটিকে প্রজ্বলিত রেখে যাওয়া।