মহাভারত, ব্রহ্মপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতিতে অমৃত মন্থনের নানা উপাখ্যান জড়িয়ে রয়েছে। সমুদ্রমন্থন অমৃতলাভের নানা উপাখ্যানের মধ্যে একটি বহু প্রচলিত কাহিনী হল দেবরাজ ইন্দ্রের।
পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় একদা দেবরাজ ইন্দ্র পুষ্পভদ্রা নদীর তীরে মোহময়ী এক অরণ্যে ঘুরছিলেন। এমন সময় তিনি চন্দ্রালোক থেকে আগত অপ্সরা রম্ভাকে দেখতে পান। রম্ভা ছিলেন অপরূপা স্বর্গীয় নৃত্যশিল্পী যার সৌন্দর্য ও নৃত্য সর্বদা প্রশংসিত হতো। রম্ভার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ইন্দ্রকে মুহূর্তেই মোহিত করল এবং অসংযত ইচ্ছার তাড়নায় কামাতুর
ইন্দ্র ছুটে গেলেন রম্ভার কাছে এবং তার কাছে গিয়ে গোপন বাসনা ব্যক্ত করলেন।
রম্ভা কামদেবের ভক্ত হলেও ইন্দ্রের ভয়ে তাকে শৃঙ্গারের জন্য অনুমতি দেন। ইন্দ্র তখন ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা হারিয়েছেন। স্থান কাল পাত্রের জ্ঞানও হারিয়ে ওই নির্জন অপরূপ বাগানে রম্ভাকে শৃঙ্গার করতে থাকেন।
এরপর ইন্দ্র এবং রম্ভা যখন জলাশয়ে বিহার করছিলেন সেই সময় সেখানে দিয়ে দুর্বাসামুনি তাঁর বিশাল শিষ্যবাহিনী নিয়ে বৈকুন্ঠধাম থেকে কৈলাসে শিবের দর্শনে যাচ্ছিলেন।
দুর্বাসামুনি যখন বৈকুণ্ঠধামে ছিলেন তখন স্বয়ং বিষ্ণু তাকে একটি দিব্যগুণযুক্ত পারিজাত ফুল দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন — ‘যার কাছে এই ফুল থাকবে সে সবার আগে আমার পুজো পাবে এবং সর্বদা লক্ষ্মীলাভ এবং সর্বকর্মে বিজয় পাবেন।’
দিব্যগুণযুক্ত পারিজাত ফুল পেয়ে প্রথমে দুর্বাসামুনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন কিন্তু পরে ভাবলেন এহেন ফুল পেয়ে তার কি লাভ হবে! তাই সে ফুলটি উপযুক্ত ব্যক্তিকে দান করার কথা ভাবলেন। দেবরাজ ইন্দ্রকে যখন তিনি দেখতে পেলেন, তখন ভালবেসে সেই পারিজাত পুষ্পটি তাঁকে দিয়ে দুর্বাসামুনি কৈলাসে যাত্রা করলেন।
এদিকে ইন্দ্র তখন রম্ভার প্রেমে এতটাই অন্ধ হয়ে রয়ে ছিলেন যে তাঁর কোন দিকে হুঁশ ছিল না।তিনি এই দিব্য পারিজাত পুষ্পটি তার বাহন ঐরাবতের মাথায় রেখে দিলেন। ঐরাবত মাথা থেকে ওই পুস্পটি মাটিতে ফেলে পায়ে করে পিষে দিল।
এদিকে দুর্বাসামুনি কোন কারণে পিছন ফিরে দেখতেই চোখে পড়লো শ্রীবিষ্ণুর দেওয়া দিব্য। পারিজাতের করুণ পরিণতি। শিবের অংশাবতার দুর্বাসামুনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন –
‘এইক্ষণ থেকে তুমি লক্ষীহীন হয়ে যাবে।’
তার অভিশাপে ইন্দ্রসহ সব দেবতা শ্রীহীন ও বলহীন হয়ে পড়লেন। এই সুযোগে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অমোঘ শক্তিতে শক্তিমান দানবগণ স্বর্গলোক আক্রমণ করে এবং স্বর্গের রাজত্ব অধিকার করে।
পরিস্থিতি বিপাকে হয়ে যাওয়ায় ইন্দ্র-সহ সব দেবতাগণ ব্রহ্মার নির্দেশে অগতির গতি শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়ে কাতরকন্ঠে প্রার্থনা করলেন। পরম করুণাময় শ্রীবিষ্ণু তখন দেবতাদের বললেন, একমাত্র সমুদ্র মন্থনে অমৃতপ্রাপ্তি দেবতাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে।
কিন্তু এ বিশাল কার্য দেবতাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন বিষ্ণু বললেন, ‘তোমরা সকলে দানবগনের সঙ্গে মিত্রতা করে সমুদ্র মন্থন করার ব্যবস্থা করো। অতিশীঘ্রই তোমরা মা লক্ষ্মীকে ফিরে পাবে।’
শ্রীবিষ্ণু পরামর্শে সকলে মিলে সমুদ্রমন্থনের কাজ শুরু করল। শর্ত অনুযায়ী ইন্দ্রসহ সকল দেবতাগণ ও ত্রিপুরাসুর সহ সকল অসুর অমৃত ভাগ করে নেবেন। মন্দর পর্বত হলো মন্থনদন্ড, বাসুকিনাগ হলো মন্থনের দড়ি যার লেজের দিক ধরবেন দেবতারা এবং মুখের দিক অসুরগণ।ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং কুর্মরূপ ধারণ করে নিজ পিঠে মন্থনদন্ড রূপ মন্দর পর্বতকে ধারণ করলেন।
সমুদ্রমন্থন শুরু হল। মন্থনের সময় বাসুকি নাগের ভয়ংকর বিষ সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়লে দেবতাদের প্রার্থনায় পরমকৃপালু আশুতোষ স্বয়ং সমস্ত বিষ গ্রহণ করে নীলকণ্ঠ নামে জগত প্রসিদ্ধ হন।
মন্থনে প্রথমেই উঠে এলো কামধেনু গাভী, এরপর একে একে উঠে এলো উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব, ঐরাবত, চন্দ্র, কৌস্তুভমনি, অপ্সরাগণ,শঙ্খ ও নানা ধরনের রত্ন। এরপর উঠে এলেন কমলনয়না মালক্ষী ও বারুণী। মালক্ষী উঠে শ্রীকৃষ্ণর চরণকমলে আশ্রয় গ্রহণ করলেন,বারুণীকে দৈত্যগণ গ্রহন করলেন।সর্বশেষে মনোহর শ্যামলমূর্তি বৈদ্যরাজ শ্যামল মূর্তি ধন্বন্তরি অমৃতপূর্ণ কলস (কুম্ভ) হাতে নিয়ে উঠে এলেন। মন্থনকার্য সমাপ্ত হলো।
এর সঙ্গে সঙ্গে দুদলের মধ্যে কুম্ভ নিয়ে কারাকারি শুরু হল।প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে দেবরাজ ইন্দ্র ভাবলেন যদি অসুরগন যদি এই অমৃত পান করে, তাহলে ভয়ানক অনর্থ হবে। এই চিন্তা করে দেবগুরু বৃহস্পতির পরামর্শে স্বীয় পুত্র জয়ন্তকে অমৃতকুম্ভ নিয়ে স্বর্গাভিমুখে পালাতে নির্দেশ দিলেন। পিতার নির্দেশে জয়ন্তদেব তাই করলেন। ওদিকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য এই সংবাদ জানতে পেরে অমৃতকুম্ভ আনতে দানবগনকে পাঠালেন যুদ্ধ করতে। ১২ দিন পর্যন্ত দেবতাদের সঙ্গে দানবদের ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল।
অসুরদের ভয়ে ভীত জয়ন্তদেব প্রতিদিন বিশ্রামের জন্য অমৃতকুম্ভ রক্ষার হেতু পৃথক পৃথক স্থানে লুকিয়ে রাখতেন এবং সুযোগ মতো অন্য জায়গায় পালিয়ে যেতেন। এইভাবে স্বর্গের আটটি স্থানে এবং মর্তের চারটি স্থানে জয়ন্তদেব অমৃত কলস্ লুকিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে দেবগনের পরাজয় হলে অসুরগণ অমৃতপানে উদ্যত হন।
দানবশক্তি বৃদ্ধি হলে জগতের অনর্থ হবে ভেবে জগৎপতি ভক্তবৎসল শ্রীহরি পরমসুন্দরী মোহিনী মূর্তি ধারণ করে অসুরদের আকর্ষিত করেন। মোহিনী মূর্তিতে আকর্ষিত হয় দৈত্যগণ অমৃতপানের কথা প্রায় ভুলেই যায়। সেই সুযোগে শ্রীনারায়ণ দেবগণকে অমৃত পান করাতে লাগলেন।
জয়ন্তদেব মর্তের যে চারটি জায়গায় অমৃতকুম্ভ রেখেছিলেন সেই স্থানগুলি হল হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী ও নাসিক।জয়ন্তদেব দেবলোকের হিসেবে পৃথিবীতে ১২ দিন ছিলেন। দেবলোকের একদিন মানে পৃথিবীর এক বছর। যেহেতু তিনি ১২ দিন ছিলেন সেই হিসেবে পৃথিবীতে তা ১২ বছরের সমতুল্য। তাই। সেই সময় থেকে আজও প্রতি ১২ বছর অন্তর কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
কুম্ভমেলা তিন প্রকার– পূর্ণকুম্ভ,অর্ধকুম্ভ ও মহাকুম্ভ। পূর্ণকুম্ভ হয় প্রতি ১২ বছর অন্তর এক একটি জায়গায়। প্রতি তিন বছর অন্তর ওই চারটি স্থানে যে কুম্ভ হয় সেটি হল অর্ধকুম্ভ আর ১২টি পূর্ণকুম্ভে যে কুম্ভ মেলা হয় তা হচ্ছে মহাকুম্ভ (১২ বছর x ১২ বার)। তিনটি গ্রহ — সূর্য চন্দ্র ও বৃহস্পতি–বিশেষ সংযোগকালে বিশেষ রাশিতে অবস্থান করলে তবে কুম্ভযোগ সূচিত হয়।
পুরানে দেখা যায়, পৃথিবী ছাড়া দেবলোকের আটটি স্থানের সুধাবিন্দু পড়েছিল। সে সমস্ত দেবগন ছাড়া আর অন্য কেউ ভোগ করতে পারেন না।
আজ ২৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, বুধবার, ইংরেজী : ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, মাঘী পূর্ণিমা, পঞ্চম শাহি স্নান।
এই স্নান মুহুর্তর তালিকা দেওয়া হল।
কুম্ভ সংক্রান্তি পুণ্যকাল: ১২:৩৫ পিএম – ০৬:০৯ পিএম
কুম্ভ সংক্রান্তি মহাপুণ্য কাল: ০৪:১৮ পিএম – ০৬:০৯ পিএম
সনাতন ধর্মে, সংক্রান্তি তিথির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে স্নান, দান এবং প্রার্থনা করা মোক্ষ লাভের পথ প্রশস্ত করে বলে বিশ্বাস করা হয়। তিল দান, সূর্য দেবতার পূজা এবং ব্রাহ্মণদের অন্নদানের ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে। জ্যোতিষশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই দিনটি মকর এবং সিংহ (সিংহ) রাশির জাতকদের জন্য বিশেষভাবে শুভ বলে বিবেচিত হয়।
কুম্ভ সংক্রান্তির আচার-অনুষ্ঠান:
ব্রহ্ম মুহুর্তের সময় ঘুম থেকে উঠে গঙ্গায় পবিত্র স্নান করুন।
গঙ্গা জল (পবিত্র জল) এবং তিল বীজ জলে মিশিয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য অর্পণ করুন। মন্দিরে একটি প্রদীপ জ্বালান।
জলে কালো তিল এবং কুশ ঘাস ব্যবহার করে তর্পণ (পৈতৃক নৈবেদ্য) করুন।
শনিদেবের আশীর্বাদ পেতে কালো গরু এবং পথশিশুদের খাওয়ান। সাধ্যমত দান করুন।
কি কান্ড! ভালো লেখা।
থ্যাঙ্ক ইউ
ভারতবর্ষ আস্থা আর বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত,
যারা কাল্পনিক সৃষ্টিকেও ধার্মিক ভাব ভাবনার
দ্বারা পরিলক্ষিত করে সন্ধান করে ঐশ্বরিক মহা
মহিমার অলৌকিক দর্শন তত্ব।
কামনা বাসনাকেও দেওয়া হয় ধার্মিক আচ্ছাদন।
মহাভারত সেই কাম প্রবৃত্তির লীলাভূমি যেখানে
ঈশ্বর নামক কাল্পনিক কল্পনা আল্পনা দেয় মন
গভীরে আর সৃষ্টি হয় অসংখ্য ধ্যান ধারনার আর
পরিমন্ডল যেখানে ঈশ্বরের কামলীলাকে ভক্তদের
কাছে পরিবেশিত হয় মহা মহিমায়।
এই করলে এই হবে,এটাই মুক্তির পথ ইত্যাদি
রহস্যময় বক্তব্যের সাক্ষী হিসাবে করা হয় বিভিন্ন
গতিবিধি যার নিদর্শন ব্রত্ উদযাপন উপবাস আর
অবগাহনে মুক্তির আশা।কুম্ভ সেই রকম একটি
বিশেষ পরম্পরার অবদান।তবে আস্থা আর বিশ্বাসের মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান।
ভালোলেখা ভালোলাগা ভালোবাসা।
বাহ্ খুব সুন্দর বললেন🌹 আন্তরিক ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয়