“আজ তোমায় ডাকছি ওয়ারিস শাহ, কবর থেকে কথা বলো
প্রেমের গ্রন্থে আজ কোনো নতুন পাতা খোলো।
এক পাঞ্জাবের মেয়ে (হীর) কেঁদেছিল একদিন
তাকে নিয়ে লিখেছিলে সুবিশাল এক গাথা,
আজ লক্ষ মেয়ে কাঁদছে শোনো,
ওয়ারিস শাহ তুমি কোথা?
ওঠো পীড়িতের বন্ধু, দেখো তোমার পাঞ্জাবের চেহারা,
ফসলের মাঠে ছড়িয়ে লাশ আর চেনাবে (চেনাব নদী) রুধির ধারা।”
কথাগুলো বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ভারতীয় কবি অমৃতা প্রীতমের, নারীবাদিতার স্পষ্ট স্ফূরণ ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে যিনি হয়েছিলেন পাঞ্জাবি সাহিত্যে নারীদের মুখপাত্র এবং সেই সাথে বিংশ শতাব্দীর পাঞ্জাবের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের একজন। উপরোক্ত চরণগুলো তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘আজ আখখা ওয়ারিস শাহ নু’ (আজ তোমায় ডাকছি ওয়ারিস শাহ) থেকে নেয়া। ওয়ারিস শাহ হলেন আঠারো শতকের বিখ্যাত সুফী কবি; যিনি কালজয়ী প্রেমোপাখ্যান হীর-রাঞ্ঝার স্রষ্টা। এই কবিতায় একইসাথে অমৃতা তুলে ধরেছেন পাঞ্জাবের তৎকালীন ধ্বংসোন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর তার শিকার নারীদের বিপদাপন্ন সামাজিক অবস্থা।
এক কঠিন সময় ও কঠিন সমাজে জন্ম নেয়া অমৃতা প্রীতম সমকালীন অন্যান্য নারীর মতো দুর্বিনীত নিয়তি পরিগ্রহ না করে সারাটা জীবন নিজের ইচ্ছেনুযায়ীই বেঁচেছেন। সমাজের বাঁধন পুরোপুরি ছিন্ন করতে পারেননি, কিন্তু নিজের যাপিত জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- এভাবেও বাঁচা যায়, এভাবেও একজন নারী বাঁচতে পারে। তিনি ভালোবেসেছেন, বিদ্রোহ করেছেন, পুরুষের প্রেমে নিমগ্ন হয়েছেন, আবার পুরুষের পরিসীমাটিও সচেতনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার জীবনদর্শন ও হৃদয়ের গূঢ়তম কথাগুলো নিঃসৃত হয়েছে তার সাহিত্যে, তার কবিতার ছন্দে, ঝংকারে। বাংলাভাষীদের কাছে তার নামটি অপরিচিত। কিন্তু সাহিত্যে কোনো প্রাচীর নেই। পৃথিবীর এক প্রান্তের সাহিত্যের টঙ্কারেও আরেক প্রান্তে তুফান উঠে যেতে পারে, সেখানে অমৃতা প্রীতম তো অবিভক্ত ভারতবর্ষে জন্ম নেয়া আমাদেরই উপমহাদেশের একই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সমাজব্যবস্থার শিকার এক কবি। চলুন এই অজানা কবির কিছু কথা জানা যাক।
অমৃতা প্রীতম, মূল নাম অমৃতা কৌর। ১৯১৯ সালের ৩১ আগস্ট, ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষের পাঞ্জাবে গুজরানওয়ালা গ্রামে জন্ম তার। বাবা করতার সিং ও মা রাজ বিবির একমাত্র সন্তান ছিলেন অমৃতা। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, শিখ ধর্ম প্রচারক ও কবি। সুতরাং একরকম আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক পরিবেশ তিনি পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন। লেখালেখির প্রতি ভালোবাসাটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। বাল্যকাল থেকেই ধমনীতে এক বিদ্রোহী সত্ত্বা ধারণ করেছিলেন অমৃতা। প্রচলিত কায়দা-কানুনকে প্রশ্ন করা আর পুরোনোকে ভেঙে নতুনকে গড়ার আহবান তার মজ্জাগত ছিল। ছোটবেলায় দাদীকে দেখতেন হিন্দু ও মুসলিমদের আপ্যায়নের আলাদা আলাদা বাসন ব্যবহার করতে। সেই বয়স থেকেই এমন ব্যবহারকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন তিনি।
অমৃতার বয়স যখন ১১, তখন তার মা মারা যান। শোনা যায়, ঈশ্বরের কাছে কাতর হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি মাকে বাঁচাবার জন্য। ঈশ্বর তার কথা রাখেননি, আর তাই মায়ের মৃত্যুর পর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা বন্ধ করে দেন তিনি। মায়ের মৃত্যুর অনতিকাল পরে তিনি বাবার সাথে লাহোরে চলে যান। মাতৃহীনা সংসারে দৈনন্দিন নীরস গৃহস্থালি কাজের চাপে একটু অবসরের জন্য উতলা হয়ে ওঠেন সদ্য কৈশোরে পা রাখা অমৃতা। খুব ছোট বয়স থেকেই লিখনশৈলীর স্ফূরণ ঘটেছিল তার মধ্যে, লেখার মাঝেই খুঁজে পেতেন শান্তি। তার প্রথম কবিতা সংকলন ‘অমৃত লেহরে’ (অমৃত তরঙ্গ) প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। তার বয়স তখন সবে ষোল। সে বছরই তার বিয়ে হয় বাল্যকালে পরিবারের ঠিক করা বাগদত্তা প্রীতম সিং এর সাথে। প্রীতম সিং ছিলেন এক হোসিয়ারি ব্যবসায়ীর ছেলে এবং পেশায় একজন সম্পাদক। বিয়ের পরে অমৃতা কৌরের নাম হয় অমৃতা প্রিতম। কবিতা অমৃতার রন্ধ্রে ছিল। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে তার ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
প্রথমদিকে অমৃতা শুধু প্রেমের কবিতা লিখেছেন। তার বুকের গভীরতম প্রকোষ্ঠে জমা প্রেমানুভূতি, আকুল আকুতির অমৃতধারা ছুটেছে তার কাব্যে। পরবর্তীতে তিনি প্রগতিশীল লেখকদের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এটি ছিল দেশভাগ পূর্ববর্তী ভারতের একটি সাহিত্য জাগরণ। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি অমৃতা সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের দুর্গতি ও তাদের অধিকার নিয়ে কণ্ঠে বান ডাকে তার। সেই সাথে জোয়ার আসে তার কলমে। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয় অমৃতার কাব্যগ্রন্থ ‘লোক পীড়’ (গণরোষ)। ’৪৩ এর বাংলার দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধবিদ্ধস্ত অর্থনীতির তীব্র সমালোচনা করেন তিনি এ গ্রন্থে। কবিতাই ছিল তার প্রতিবাদের অস্ত্র। ধীরে ধীরে তিনি এক দুর্দান্ত কবিতে পরিণত হচ্ছিলেন; এমন এক কবি, যে কোনো ভয়-ভীতি বা ফলাফলের তোয়াক্কা না করে অসঙ্গতির বুকে পদাঘাত করে যায় শুধু। জীবনে চলার পথে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা প্রভাবিত করেছে তার চিন্তা-চেতনাকে, তাই তার কবিতার ভাষা আর আবেদনও পরিবর্তিত হয়েছে।
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ নামক অমানবিক কর্মকান্ডটির সময় অমৃতার বয়স ২৮। নিজের চোখের সামনে তিনি দেখলেন মানবতার এক বিশাল বিপর্যয়। রাজনৈতিক বিভীষিকার কবলে পড়ে একক রাষ্ট্রভুক্ত মানুষগুলো ধর্ম আর জাতের নামে নিজ নিজ আলাদা বাসস্থান খুঁজতে বাধ্য হলো। যুগ যুগ ধরে এক আকাশের নিচে বাসরত মানুষগুলোর একের অপরের সাথে ঘৃণার সম্পর্ক তৈরি হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু, মুসলিম, শিখ মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ নিহত হলো। অমৃতা নিজেও এই দাঙ্গায় মরতে মরতে বাঁচলেন, কিন্তু তার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেল এই বিপর্যয়ে। পাঞ্জাবী শরণার্থী হয়ে লাহোর থেকে দিল্লীতে এসে উঠলেন অমৃতা। চললো লড়াই জীবনটা নতুন করে শুরু করার। পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে অন্তর্জগতে জাগা তুমুল আলোড়ন অমৃতাকে কবি হিসেবে করলো আরও পরিণত, আরও গভীর। ১৯৪৮ সালে তিনি সুগভীর মর্মযাতনা নিয়ে লিখলেন ‘আজ আখখা ওয়ারিস শাহ নু’। মৃত্যু আর ঘৃণার রাজ্যে পুনরায় প্রেম আর জীবনের একটা নতুন অধ্যায় লিখতে আহবান জানালেন কবরে শায়িত ওয়ারিস শাহকে। একে অমৃতার সেরা কবিতা বলা হয়।
১৯৫০ সালে অমৃতা লিখলেন উপন্যাস ‘পিঞ্জর’। দেশ বিভাগের সময় পাঞ্জাবের মেয়েদের দুর্দশা সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুললেন এই উপন্যাসে। এতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতির প্রতিরূপও ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। বিশেষ করে পরিবারের হাতে অসহায় ও গুরুত্বহীন দুর্বিষহ নারী জীবন এর মূল উপজীব্য হয়ে এসেছে। ২০০৩ সালে বলিউডে চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদী এই উপন্যাস থেকে একই নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। ঊর্মিলা মার্তন্ডকর, মনোজ বাজপেয়ী ও সঞ্জয় সূরি মূল চরিত্রে থাকা এই সিনেমা সমালোচকদের প্রশংসাসহ জাতীয় পুরষ্কার অর্জন করে নেয়।
নিজের মতের তোয়াক্কাহীন, একটি চাপিয়ে দেয়া বিয়ে নিয়ে অমৃতা ব্যক্তিগত জীবনে সুখী ছিলেন না। তার ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেনি এই সম্পর্কে। প্রেম বিষয়ে তার সাথে যার নামটি বেশি আসে, তিনি হলেন সাহির লুধিআনভি। সাহির ছিলেন একজন কবি ও গীতিকার। ১৯৪৪ সালে তাদের প্রথম দেখা হয়। লাহোরের অনতিদূরে প্রীত নগর নামে এক গ্রামে এক মুশায়রায় (কবিতা পাঠের আসর) গিয়ে অমৃতা সাহিরের দেখা পান। সাহিরের মতাদর্শ, সৌন্দর্য, শব্দশৈলী সবকিছু মিলিয়ে অমৃতাকে তীব্র বাসনার জালে জড়িয়ে ফেলে। অমৃতা তখন বিবাহিতা, এক সন্তানের জননী। তারপরও সাহিরের সাথে পত্রালাপের মধ্যে দিয়ে কথামালায় তৈরি এক অনিন্দ্য সুন্দর সেতু গড়ে ওঠে অমৃতার। সাহিরেরও অনেক পছন্দের ছিলেন অমৃতা। একবার সাহির তার মাকে বলেছিলেন, “ও হলো অমৃতা প্রীতম, ও তোমার বৌমা হতে পারতো।” কিন্তু কোনো এক কারণে সাহির চাননি তাদের নৈকট্য। হয়তো তার আবেগের গভীরতা অমৃতার মতো অতল ছিল না। দূর থেকে সেই পত্র আদান-প্রদান, সেই অদৃশ্য স্পর্শ, সেই ছুঁতে পারা শব্দগুলোই তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। যে দুয়েকবার তারা গোপনে সাক্ষাৎ করেছেন, তাতে মুখরতার চেয়ে নৈঃশব্দ্যই বেশি ছিল। অমৃতা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রশিদী টিকেট’-এ কোনো রাখঢাক ছাড়াই সাহিরের সাথে তার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
দেশভাগের পর সাহির চলে আসেন মুম্বাইয়ে, আর অমৃতা দিল্লীতে। সাহিরের দিক থেকে আহবান না থাকলেও অমৃতা আর পারছিলেন না তার অসুখী বিবাহিত জীবন চালিয়ে যেতে। এদিকে সাহিরের জীবনে আগমন ঘটে গায়িকা সুধা মালহোত্রার। তাদের সম্পর্কের সেখানেই ইতি হয়। সব পিছুটান ফেলে অমৃতা আবারও এক নতুন জীবন শুরু করেন। এবার তার সাক্ষাৎ হয় প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক ইমরোজের সাথে। অমৃতার ব্যথিত প্রাণ শান্তি খুঁজে পায় ইমরোজে। জীবনের পরবর্তী চল্লিশটি বছর তিনি ইমরোজের সাথেই বাস করেন।
অমৃতা লিখেছেন কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, লিখেছেন আত্মজীবনী। তার সাহিত্যকর্মগুলো একটা সময়ের স্মারক। একটা যুগ থেকে বেরিয়ে আরেকটা যুগে প্রবেশ, এক জীবন থেকে বেরিয়ে আরেক জীবন গ্রহণ করার চিহ্ন। এক প্রাচীন অসঙ্গতির সমাজে প্রগতির বাহক হয়ে এসেছিলেন অমৃতা। সময়ের প্রয়োজনেই নারীবাদ ধারণ করেছিলেন তিনি সাহিত্যে। তার উক্তিগুলোই বলে কত স্পষ্ট ও অগ্রসর ছিল তার চিন্তাধারা। যেমন তিনি বলেন, — “একজন পুরুষ যখন নারীদের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে, সে তখন নিজের অবচেতন মনকেই অবজ্ঞা করে।”
সাহিত্যের স্বীকৃতিও কম পাননি অমৃতা। পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন ‘পাঞ্জাব রতন অ্যাওয়ার্ড’। ১৯৫৬ সালে পেয়েছেন ‘সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার’ (প্রথম নারী), পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরষ্কার ‘ভারতীয় জননপীঠ অ্যাওয়ার্ড’, পেয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, জবলপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী থেকে ডি.লিট (ডক্টর অব লিটারেচার) ডিগ্রীও পেয়েছেন। এছাড়া দেশের বাইরে ফ্রান্স, বুলগেরিয়া ও পাকিস্তান থেকেও অজস্র সম্মাননা ও পুরষ্কার পেয়েছেন।
দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভোগার পর ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঘুমের মধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেন অমৃতা। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। মৃত্যুর আগ অবধি ইমরোজ তার সাথে ছিলেন। অমৃতার জীবন ছিল এক মূর্তিমান বিদ্রোহের চালচিত্র। নিজের জীবন প্রণালী আর কলমের সঞ্চালনায় তিনি দেখিয়েছেন পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে না থেকে এভাবেও বাঁচা যায়, দেখিয়েছেন যা বুকের উপর পাথর হয়ে চেপে থাকে, তাকে উৎখাত করাই বাঞ্চনীয়। তিনি শিখিয়েছেন, জীবন যখন মানবেতর, তখন ভয় আসলে একটি বিভ্রম। ভয়হীন হয়ে গর্জে ওঠাতেই প্রগতির অঙ্কুর পরিপুষ্ট হয়। নিজ জীবন ও কর্ম দিয়ে তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন পাঞ্জাবের নারীদের নতুন যুগের দিকনির্দেশক।