রেডিও শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা, বাবার কথা। শান্ত ধীর নিস্তরঙ্গ মফস্বল শহরে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই রেডিওটা অন করত। চলতো দীর্ঘক্ষণ ধরে, কোন কোন সময়তো বাবা ঘুমিয়েই পড়তো রেডিও চালিয়ে। আমি কিম্বা মা গিয়ে রেডিওর বড় নব ঘুরিয়ে অফ করে দিতাম।আর বাবার অফিসের ছুটি থাকলে, সকালে বাজার নিয়ে এসেই চালু করতো রেডিও। রবিবার দুপুর বেলায় গোটা আলু আর পাঁঠার মাংসের ঝোলের উদাস গন্ধ নিয়ে শোনা হতো শ্রাবন্তী মজুমদারের ন্যাচারাল আদুরেপোনা কন্ঠের নানান অনুষ্ঠান।
সত্যি বলতে কি বকুনি খেলেও, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গানের অনুষ্ঠান, সংবাদ, নাটক শুনতে ভীষণ ভালো লাগতো। আজও মনে আছে হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স-এর শনিবারের বারবেলা, আরব্য রজনী, কেয়ো কার্পিন নাটকের দিন, শ্রাবন্তী মজুমদারের সেই গানটা…
‘ত্বক যদি কেটে যায়, ফেটে যায়, খসখসে যদি হয়…সারা অঙ্গে মেখে নিন/ সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিন’। কিংবা, ‘মাথার ঘন চুল যখন/ মরুভূমি হয়ে যায়/ ওয়েসিস নিয়ে আসুন….’ আটপৌরে বাঙালির কাছে রেডিও ছিল সুখে-দুখে অবসরের নিত্যসঙ্গী।
এক ডালি অনুষ্ঠানের আকর্ষণে সাড়া না দিয়ে থাকবে না এমন বাঙালি সেই সময় খুঁজে পাওয়া ছিলো দুষ্কর। বাবার কাছে সেরা আকর্ষণ ছিলো মাখনের চেয়েও একটু মোলায়েম গলায় ‘ভাইয়ো অর বেহেনো’-র ডাক। গলাটির মালিক আমিন সায়ানি। অনুষ্ঠানের নাম বিনাকা (পরে সিবাকা)গীতমালা।
১৯৫২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত চলেছে রেডিও সিলনে।তারপর ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত বিবিধ ভারতীতে।সায়ানি প্রতি বুধবার রাত ৮টায় রেডিওতে আসতেন।তাঁর উষ্ণ এবং স্নেহপূর্ণ কণ্ঠের ডাক স্বাধীন ভারতের রাস্তাঘাট ফাঁকা করে দিত।বলা হয়, দূরদর্শন টিভিতে রামায়ণ এবং মহাভারতের অনুষ্ঠান বহু দশক ধরে যেভাবে প্রচারিত হয়েছে, তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে রেডিও আরও অনেক কিছু করতে পারে।
আমিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম আমার কথা অন্তত ২০ কোটি মানুষ শুনছেন। কিন্তু কথা বলতাম এমনভাবে যেন একজনের সঙ্গে বলছি।’ আর সেই আন্তরিকতাই ইউএসপি হয়ে গেল আমিনের।
১৯৩২ সালে গুজরাটে বিখ্যাত গান্ধীবাদী ও নারী শিক্ষাকর্মী কুলসুম সায়ানি এবং চিকিৎসক জান মোহাম্মদ সায়ানির ঘরে জন্মগ্রহণকারী তরুণ সায়ানি মুম্বাইয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তার মা ১৯৪০-এর দশকে জনপ্রিয় একটি পাক্ষিক পত্রিকা রাহবার প্রকাশ করতেন যা হিন্দুস্তানি ভাষায় পাঠকদের সাথে কথোপকথনের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই প্রকাশনাটি (যা আমিন সায়ানীও সাহায্য করেছিলেন) হিন্দি এবং উর্দুর মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল যা হিন্দুস্তানি ভাষা নামে পরিচিত ছিল (দেবনাগরী, উর্দু এবং গুজরাটি লিপি ব্যবহার করে)। এই ভাষা মহাত্মা গান্ধী দেশকে একত্রিত করার এবং হিন্দি এবং উর্দুতে আরও বিচ্ছিন্ন ভাষা হওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার উপায় হিসাবে প্রচার করেছিলেন।
ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এই অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সায়ানির কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় যখন তিনি তার বড় ভাই এবং বিশিষ্ট সম্প্রচারক হামিদ সায়ানির পীড়াপীড়িতে রেডিও সিলনের মাইক্রোফোন তুলেছিলেন। তখনকার অন্যান্য সম্প্রচারকরা সাধারণত গম্ভীর গলায় কথা বলতেন, সেখানে সায়ানি আনন্দময় এবং মনোমুগ্ধকর জনসাধারণের ভাষায় কথা বলতেন।
সায়ানির রেডিওতে প্রবেশপথ মসৃণ ছিল না। আমিন বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হয়েই অল ইন্ডিয়া রেডিয়োয় হিন্দি সঞ্চালকের পদের জন্য আবেদন করেন। এবং যথারীতি বাতিলও হন। আমিনের কথায়, ‘ওরা বলেছিল লেখা দেখে আমার পড়ার দক্ষতা ভালো কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বলেছিল আমার উচ্চারণে গলদ আছে। অনেকটা গুজরাটি ও ইংলিশ টান আছে উচ্চারণের মধ্যে।’
আমিনের তখন গাইড ছিল তার নিজের দাদা হামিদ। হামিদ তখন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতেন। তার সঙ্গে রেডিও সিলনে বাণিজ্যিক একটি কাজেও যুক্ত ছিলেন। হামিদ ভাইকে পরামর্শ দেয়, ‘দেখো ভাই, তোমাকে যখন বলছে উচ্চারণে গলদ আছে তখন সেটা ঠিক করতে হবে। রেডিও সিলনের যেসব হিন্দি অনুষ্ঠান রেকর্ড হয় সেগুলিকে ভালো করে শোন।’ আমিন তাই করেছিলেন।
সেই সময় রেডিও সিলনের রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ক্যাম্পাসে। ফলে ক্লাস শেষ হলেই আমিনকে দেখা যেত স্টুডিওয় ঢুঁ মারতে।এরকমই একদিন হঠাৎ সুযোগ এলো আমিনের কাছে।
সেই সময় রেডিও সিলনে একটা অনুষ্ঠান হতো ‘ওভালটিন ফুলওয়ারি’। এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং খুব ভালো করে শুনতে আমিন।একদিন হঠাৎ করেই জানতে পারেন, বিজ্ঞাপনটি যিনি পড়েন তিনি আসেননি। তখনই তিনি ছুটলেন সেই বিজ্ঞাপন পড়ার জন্য ।তখন এই বাণিজ্যিক রেডিওর প্রডিউসার ছিলেন বাল গোবিন্দ শ্রীবাস্তব। তাঁকে আমিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কত টাকা পাবো আমি এই কাজের জন্য’? উত্তর ছিল- ‘নিজেকে কি মনে করো! বড়জোর ওভালটিনের একটি টিন পাবে।’
সম্প্রতি ভারত স্বাধীন হয়েছিলো, এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর (এআইআর) মতো রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলি একটি জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা সংজ্ঞায়িত এবং তৈরি করার দিকে নজর দিচ্ছিল। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী পদে নিযুক্ত ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিশুদ্ধবাদী বিভি কেসকর হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতকে অশ্লীল বলে মনে করেন এবং ১৯৫২ সালে আকাশে এটিকে নিষিদ্ধ করেন। শ্রীলঙ্কার আকাশে সম্প্রচারিত রেডিও সিলন তখন ভারতে খুব একটা জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন ছিল না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা এবং গীতমালার আগমনের পর পরিস্থিতি বদলে গেল। রেডিও সিলনের তিনটি শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার ছিল এবং এর সংকেতগুলি সমগ্র এশিয়া জুড়ে এমনকি আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত পৌঁছেছিল বলে জানা গেছে।
সেই সময় রেডিও সিলনে পশ্চিমী গানের একটি কাউন্টডাউন অনুষ্ঠান হতো। সেই আদলেই হিন্দি সিনেমার গান নিয়ে অনুষ্ঠান করতে চায় সিলনের রেডিও স্টেশন। প্রথমে ‘গীতমালা’-র অনুষ্ঠানটি আধ ঘন্টার জন্য তৈরি করা হয়েছিল যেখানে সাতটি চলচ্চিত্রের গান এলোমেলোভাবে পরিবেশিত হত, এবং যারা গানগুলি তাদের মুক্তির তারিখের কালানুক্রমিক ক্রমানুসারে সাজাতে পারবেন,তাদের জন্য নগদ পুরষ্কারের ব্যবস্থা ছিল।
এরপর রেডিও সিলন ডিসিশন নেন, শ্রোতরা চিঠি পাঠাবেন তাদের পছন্দের গান জানিয়ে এবং সে অনুযায়ী সম্প্রচার করা হবে।এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করার জন্যই আমিন সিলেক্ট হন এবং এই কাজের জন্য তাকে প্রতি সপ্তাহে ২৫ টাকা অফার করেছিল রেডিও শিলন। এত কম টাকায় প্রতিষ্ঠিত কোন সঞ্চালক কাজ করতে রাজি হননি। আমিনের জানিয়েছিলেন ,’আমার কাছে ২৫ টাকা তখন ওভালটিনের একটা টিনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল’।
এর পরের ঘটনা ছিল ইতিহাস। সায়ানির ভাগ্যে ঘটে গেলো অভূতপূর্ব সাফল্য। প্রথম সপ্তাহে আমিন ভেবেছিলেন হয়তো শদুয়েক চিঠি আসবে শ্রোতাদের। চিঠি এসেছিল ৯০০০, আজ্ঞে হ্যাঁ — নয় হাজার।
আমিনের কথায়, ‘সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল এবং আমিও, এবং তারপর আমি মাথা ধরে বসে রইলাম। আমাকে একা বসে প্রতিটি অক্ষর পরীক্ষা করতে হয়েছিল… এক বছরের মধ্যে, চিঠিপত্র সপ্তাহে ৬৫,০০০-এ পৌঁছে যায়।’
এরপর সপ্তাহের সেরা অনুষ্ঠানটি হিসাবে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। প্যান-এশিয়ান গানের প্রসারের ফল, (যা পরবর্তীতে পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছেগেছিলো) গীতমালার গানগুলিকে ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে অ-হিন্দি মানুষের কাছে নিয়ে যায়। তার শীর্ষে থাকার সময়, অনুষ্ঠানটি ৯ থেকে ১২ কোটি দর্শক সংগ্রহ করে। এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রেডিয়োতে তা নিয়মিত সম্প্রচারিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০০ ও ২০০১ সালে কিছু পরিবর্তন করে পুনরায় অনুষ্ঠানটিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
সায়ানী গীতমালা ছাড়াও আরও অনেক অনুষ্ঠানে কাজ করেছেন। কেরিয়ারে প্রায় ৫৪ হাজার রেডিয়ো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন আমিন। বিজ্ঞাপনের জগতেও তাঁর ভয়েসওভারের সংখ্যা ১৯ হাজারেরও বেশি।
যখন সারেগামা গীতমালার সিডি শুরু করে, ২০১৮ সালে ক্যারাভান তৈরি করে এবং সায়ানি একটি ব্যক্তিগত এফএম ইমে সঙ্গীত কে সিতারোঁ কি মেহফিল নিয়ে ফিরে আসেন, তখনও তার কণ্ঠস্বর ছিলো সাড়া জাগানো ।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৯১ বছর বয়সে প্রবীণ বেতার উপস্থাপক প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে, ভারতীয় রেডিওর এক গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কদিন আগেই ছিলো (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব বেতার দিবস। ফেব্রুয়ারি মাস বিখ্যাত হয়ে থাকুক রেডিও এবং তার সঞ্চালক আমিন সায়নির নামে।।
আমার একটা রেডিও ছিল, প্রত্যেক দিন দুপুরে নাটক শুনতাম জমিয়ে। যাত্রা পালা শুনতাম সন্ধ্যাবেলা। অনুরোধের আসর অনুষ্ঠিত হতো। খুবই enjoy করেছি। রেডিও বিয়েতে যৌতুক হিসাবে দিতো। আমার এক কাকা পেয়েছিল। কিন্তু ওই কাকিমা রেডিওর ধারে কাছে যেতে দিতো না। বাজলে শুনতে পেতাম। যখন আমি tuition fees নিয়ে রোজগার শুরু করি তখন আমি একটা রেডিও কিনে ছিলাম। ওই রেডিও কোথায় চলে গেলো আজও হদিস পাওয়া গেলো না। লেখা পড়লাম আর আমার শুধু ঐ রেডিওর কথা মনে পড়ছে। খুবই সুন্দর হয়েছে লেখা।
চমকপ্রদ বিষয়, দীর্ঘদিন আমাদের জীবনের বিনোদন ছিল ঐ অনুষ্ঠান। অনেক কিছুই জানা গেল। ভীষণ ভাল উপস্থাপনা।