সোমবার | ১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:১৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
সবগুলো গল্পেই বিজয়ার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রয়েছে : ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল কচুর কচকচানি : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (অষ্টম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুরের উইল ও দ্বারকানাথের ধনপ্রাপ্তি : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (সপ্তম পর্ব) : আবদুশ শাকুর যে শিক্ষকের অভাবে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয় না : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (ষষ্ঠ পর্ব) : আবদুশ শাকুর দিল্লি বিধানসভা ভোটেই নিশ্চিত হচ্ছে বিজেপি বিরোধি জোটের ভাঙন : তপন মল্লিক চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুরের গানের চর্চা : অসিত দাস মমতা বললেন, এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দুষ্টচক্র হু জানাল চিন্তা নেই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (পঞ্চম পর্ব) : আবদুশ শাকুর পৌষ পুত্রদা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (চতুর্থ পর্ব) : আবদুশ শাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় কবিগান ও যাত্রার আসর : অসিত দাস সসীমকুমার বাড়ৈ-এর ছোটগল্প ‘ঋতুমতী হওয়ার প্রার্থনা’ সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলনে সিনেমা : সায়র ব্যানার্জী নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সুও দুও ভাসে’ বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (তৃতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর ভিয়েতনামের গল্প (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব নীলমণি ঠাকুরের মেছুয়া-যাত্রা, একটি ঐতিহাসিক পুনর্নির্মাণ : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দ্বিতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর কাদের প্রশ্রয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিরা বাংলার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রসাহিত্যে কবিয়াল ও কবির লড়াই : অসিত দাস নকল দাঁতের আসল গল্প : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (প্রথম পর্ব) : আবদুশ শাকুর মুর্শিদাবাদের কৃষি ঐতিহ্য : অনুপম পাল নক্সী কাঁথায় বোনা জসীমউদ্দীনের বাল্যজীবন : মনোজিৎকুমার দাস পঞ্চানন কুশারীর জাহাজী গানই কি কবির লড়াইয়ের মূল উৎস : অসিত দাস দিব্যেন্দু পালিত-এর ছোটগল্প ‘ঝালমুড়ি’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই ২০২৫ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সবগুলো গল্পেই বিজয়ার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রয়েছে : ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল

ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল / ২৭ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫

বিজয়া দেবের ‘এলিয়েন’ গল্পগ্রন্থটি ক’দিন আগেই হাতে এসে পৌঁছেছে। বইটি হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম। এর একটি কারণ অবশ্যই আছে। আর সেটি হলো বিজয়া আমার অন্যতম প্রিয় একজন গল্পকার।

বিজয়ার গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং বলার কৌশল আমাকে টানে। পড়া শুরু করে বুঝলাম, ‘এলিয়েন’-এর সবগুলো গল্পতেও তিনি সেই ধারা বজায় রেখেছেন। গল্পে ‘…বর্ণনার ছটা /ঘটনার ঘনঘটা’ কোথাও নেই, অথচ কী মসৃণ গতিতে উঠে এসেছে গল্পকারের এক বহুমাত্রিক সৃষ্টিলোক যেখানে সমাজ রয়েছে, রাষ্ট্রচিন্তা রয়েছে, রয়েছে প্রেম, প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সমীকরণ। গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই বহুশ্রুত এবং বহু ব্যবহৃত বাক্যটি — ‘সব ছোটগল্প‌ই গল্প, কিন্তু কোন গল্পই ছোট নয়’।

প্রথম গল্প ‘সদানন্দের আয়না, সেলফি ও লকডাউন’ এর কথাই ধরা যাক। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। সদানন্দের আয়নাতেও অন্য একটা ছায়া পড়ছে আজকাল — ‘বড় বিপদ, বড় বিপদ’। কাজ নেই, উপার্জন নেই, আছে শুধু পেটের খিদে। নিজের বউটা ছিদামের সঙ্গে চলে গেলো। ও পাড়ার মালতীকেও নিজের করে পাওয়া হলো না। ঝোপড়ির ভেতর থেকে মালতীর রক্তাক্ত শরীরটা তার পায়ের কাছে ছিটকে এসে পড়লো একদিন। সদানন্দ আকূল হয়ে ডাকতে লাগলো — ‘মিতা ও মিতা?’ দেহ কথা বলে না। সেদিন সদানন্দ মালতীর পাশে শুয়ে একটা সেলফি তুলে নিজের কাছে রেখে দিলো। আর এখানে এসেই থেমে গেলো গল্পটাও। গল্পকারের মুন্সিয়ানাও এখানেই। তিনি প্রমাণ করলেন এতো সংক্ষিপ্ত, সংযত বিন্যাসেও বিপর্যয়ের করোনাকাল এবং নিম্নবিত্ত মানুষের চরম বিপণ্ণতার একটি বাস্তব দলিল এমন করে পাঠকের সামনে তুলে ধরা যায়। বিজয়ার এই দক্ষতা সহজাত।

‘ও নদী রে’ এবং ‘নিরাপদর পদযাত্রা ও শিমূলগাছ’ — এই দুটি গল্পেও নিজস্ব নিঃসঙ্গ বৃত্তে আবর্তিত হয়েছে চরিত্ররা। দারিদ্র্য এখানে নিত্যসঙ্গী। নিরাপদ আর ভালো করে চলাফেরা করতে পারে না আজকাল। তাই নতুন সঙ্গী জুটিয়ে বউটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। নিরাপদ এখন আশ্রয় নিয়েছে ঐ শিমূলগাছের তলায়। একদিন ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা এসে নাটক করে গেলো শিমূলতলায়। নদী, পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে কোথাও নাকি একটা দেশ রয়েছে, যেখানে সবার মুখে অন্ন জোটে। নিরাপদ পারবে সেখানে যেতে? পায়ের তো এই অবস্থা! কিন্তু তার আগেই কারা যেন এসে গাছটাকে কেটে দিলো। এখানে উঁচু বাড়ি হবে। বিকেলে কাটা শিমূলগাছের গুড়ি আঁকড়ে মরে পড়ে রইলো নিরাপদও। পদযাত্রা আর হলো না।

নিরাপদর মতোই জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে ক্লান্ত, অবসন্ন ‘ও নদী রে’ গল্পের সেই নিরীহ শ্রমিকও। বিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গের অভিঘাতে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে চেনা পৃথিবীটার সঙ্গে। টাকা না নিয়ে ঘরে ফিরলে নিজের বউও তাকে ‘গরুছাগল’ ভাবে। কথা বলে না, কাছেও আসে না। সে তখন একা বসে নদীর সঙ্গে কথা বলে। এই নদীই বুঝি তার একমাত্র বন্ধু। কিন্তু বাঁধভাঙা বন্যায় এই নদীর জল ঢুকে যেদিন তার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেলো, সে বুঝলো — ‘যে নদীকে বন্ধু ভাবতাম, সে-ও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে’। এই দুটি গল্পের কেন্দ্রেই রয়েছে জীবনযুদ্ধে হেরে -যাওয়া দু’টো মানুষ। কিন্তু তাদের পরাজয়ের আড়ালে রয়েছে গোটা একটা সিস্টেম এবং অবশ্যই দর্শনগত অবক্ষয়ের একটা নগ্ন চেহারা। তাহলে এই ভীত, সন্ত্রস্ত, হীনবল সত্তাকে কি করে বাঁচাবে মানুষ! সব দ্বন্দ্ব নিয়ে, গ্লানি নিয়ে ব্যাধিজর্জর মানুষেরা তখন ঈশ্বরী নামক এক অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রণত হয়, যেমন হয়েছে সরসী (বি পি এল স্কলারশিপ)। এক চিলতে আশার আলো দেখেছিলো সরসী। ঠিক তখনই ঘর থেকে আধার কার্ড, বি পি এল কার্ড -সব হারিয়ে গেলো। কী করে? কি করে আবার! সরসী জানে, সবই করাচ্ছেন মা মনসা। এ মোটেই অদৃষ্টের খেলা নয়। যার কাছে দড়ি আছে, তিনিই পুতুল নাচান। হারিয়ে যাওয়া কাগজ অফিস থেকে আবার বের করার জন্য সরসী এবার দালালের শরণাপন্ন হয়। এই ছোট্ট গল্পটিতে আজকের সমাজের দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন গল্পকার। এখানে শ্লেষ আছে, তিক্ততা আছে এবং সমাজ সচেতন বক্তব্যও আছে, কিন্তু কোথাও তত্ত্বের প্যাঁচপয়জার নেই। আদ্যন্ত সরল বিন্যাসে গল্পটি বুনেছেন বিজয়া আর পৌঁছে দিয়েছেন বাঞ্ছিত লক্ষ্যে।

ধূসর নগরজীবনের অন্ধকার বাস্তব উঠে এসেছে আরো একটি গল্পে। ‘শ্যাম্পুর পাউচ ও মনোরমা’। মনোরমার মতো ফুটপাতবাসী মেয়েদেরকে সমাজ বরাবরই অস্বীকার করে চলে। তবে এই প্রত্যাখানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ধনী- গরীবের চিরন্তন টিপিক্যালিটিতে ঢোকেন নি গল্পকার। বরং মনোরমাকে একটি শক্তপোক্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। একরাশ উকুন মাথায় নিয়ে সে এসে দোকানের সামনে দাঁড়ায়। দু-প্যাকেট শ্যাম্পু চাই তার। হারুর বউকে বলে —’ভাবছ কি? পয়সা দেব না? হ্যাঁ দেব না। ভিখিরির কাছ থেকে পয়সা নেবে কেন? বরং আমাদের ডেকে দেবে। বলবে — তোর মাথায় উকুন হয়েছে। চুলে ভাল করে শ্যাম্পু কর…’। এই মেয়েটি দুঃখী দুঃখী মুখ করে ঘুরে বেড়ায় না। বরং জীবন সম্পর্কে তার একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। কাজেই একটা চিরুনি চাওয়ার সাহস নেই তার, কে বলে? হারুর বউকে সে মুখের উপর বলে দেয় — ‘সাহস নেই এটা ঠিক বললে না গো বউদিদি, কথা হল গে সময় নষ্ট’।আর কথাটা বলেই মনোরমা ভাবে, হারুর বৌটার চাইতে সে নিজেই বোধহয় অনেক বেশি ভালো আছে। অনেক বেশি স্বাধীন আছে। শুধু হারুর বউ কেন, মনোরমা হয়তো অনেক মধ্যবিত্ত বাড়ির গৃহবধূর চাইতেই ভালো আছে। আড়াই হাজার ফুটের সাজানো গোছানো ফ্ল‌্যটবাড়ির নিরাপত্তাকে লতানো গাছের মতো জড়িয়ে ধরেছে যে গৃহবধূ (যেমনটা হয়ে থাকে), সে খুব সন্তর্পণে সব দ্বন্দ্ব, সংশয়কে এড়িয়ে যেতে চায়। এমনকি স্বামীর বহুগামিতাকেও, পাছে জীবনের ছন্দ এলোমেলো হয়ে যায় ।তাই এতো সমঝোতা। কিন্তু সম্পর্ক, বিশ্বাস আর যৌনতার দ্বন্দ্বময় অবস্থানের টানাপোড়েন থেকে নেমে -আসা অনিবার্য বিপর্যয়কে ঠেকাতে পারে নি সে-ও। অন্যদিকে সদানন্দের বউ কিন্তু ছিধরের হাত ধরে যাওয়ার সময় কোনো রাখঢাক না করেই বলেছিলো — ‘যে মাথার উপর ছাদ দেবে, তার সাথেই থাকব’ (সদানন্দের আয়না সেলফি ও লকডাউন) । নিরাপদর পা দু-টো যখন অচল জগদ্দল পাথরের মতো হয়ে গেলো, তখন তার বউ রঙ্গিলাও নতুন সঙ্গী জুটিয়ে গোটা পলিথিনের ছাউনিটাই দখল করে নিয়েছিলো (নিরাপদর পদযাত্রা ও শিমূলগাছ)। এই চারটি গল্পে চারজন নারীর জীবনচর্যা ভিন্ন। কিন্তু একটি বিষয়ে তাদের মিল আছে। এই চারজনের পৃথিবীই সমান নিঃসঙ্গ, সমান নিরুপায়। জীবনে আছে শুধু ভাঙনের শব্দ। এই সামগ্রিক অবক্ষয়ের কথা জীবনানন্দ বলেছিলেন বহু আগেই — ‘দূর কাছে, কেবলি নগর, ঘর ভাঙে /গ্রামপতনের শব্দ হয়’। যদিও এই ভাঙন প্রতিরোধে নিম্নবর্গের নারীরা তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় এবং সোচ্চার। এরা আমাদের অচেনা নয় আবার চিরচেনাও নয়। কিন্তু বিজয়ার আখ্যানে এরা সবাই এক একটি স্বতন্ত্র চরিত্র হয়ে উঠেছে। এই ইন্টারেস্টিং নারী চরিত্ররা ‘এলিয়েন’-এর পাঠকদের কাছে একটা উপরি পাওনা অবশ্যই।

এই গল্পগ্রন্থেই রয়েছে ‘নিশিরাত’ আর ‘মহানন্দা’র মতো ভিন্ন আঙ্গিকের গল্পও। চেতন অবচেতন, মূর্ত বিমূর্তকে নিয়ে এক যথার্থ প্যারানর্মাল আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে আখ্যান দু’টিতে। অবচেতনের চিন্তা প্রসারিত হয়ে চেতনার স্তরকে ছুঁয়েছে এখানে। রহস্যগল্পের আদলে রোমাঞ্চের মিশেল প্রয়োগ করার জন্য গল্পে গা ছমছমে আধো অন্ধকার, ধূসররঙা বেড়াল কিংবা অদ্ভুত রকমের অশরীরী সাদা রঙ -সব ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও বিন্দুমাত্র অতিনাটকীয়তা নেই। ঘটনার বিন্যাসে বিজয়া অসাধারণ ভারসাম্য দেখিয়েছেন। যে কোন রহস্যগল্পের জোরের যায়গা এটাই।

এক কাহিনী থেকে অন্য কাহিনী। অন্য নির্যাস, ভিন্ন প্রেক্ষিত। কিন্তু ট্রানজিশনের সব পরিসরেই বিজয়ার অনায়াস বিচরণ। কারণ, প্রতিটি গল্পের পেছনেই থাকে তার নিজস্ব প্রস্তুতি। ‘ঋতুদিদি’, ‘মীরা আয়াসেন্টার’, ‘বটগাছ’, ‘স্বপ্নের কোলাজ’, আর ‘মা’ — এই সবগুলো গল্পের মূল সুতো ঋতুদিদি। যদিও কাহিনীসূত্রে কোথাও এতোটুকু ওভারল্যপিং ঘটে নি। ঋতুদিদি স্বপ্ন ফেরি করতে শিখিয়েছিলো। কিন্তু তন্দ্রাকে তবুও কলাইয়ের বড়ি ফেরি করতে হয়। তাতেও সংসার চলে না। মায়ের এ্যাপেনডিকস অপারেশন হয়েছে, টাকার বড় দরকার। অতঃপর ভরসা ছিলো ‘মীরা আয়াসেন্টার’। কিন্তু সেখানেও চরম অসুরক্ষিত বোধ হওয়ায় তন্দ্রা গ্রামে ফিরে আসে। ছায়া ছায়া পথ ধরে হেঁটে এসে বসে থাকে সেই বটগাছের নীচে। এই গাছে একদিন অটোচালক নবীন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলো। ব্যাগ থেকে আঁকার খাতা ‘স্বপ্নের কোলাজ’বের করে আঁকতে শুরু করে তন্দ্রা। সেদিন প্রথম বাবা তার আঁকা ছবির দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। তারপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো — ‘ঠিক আছে। চল, বাড়ি চল’। ঋতু দিদি আবার বাঁচিয়ে দিলো। ‘ঐ ঋতুদিদি যদি গাঁয়ে না আসত,… যদি খুঁটিনাটি না চেনাত তাহলে আমিও তো পাঁচটা দরিদ্র মেয়ের মত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যা জোটে তাই দুমুঠো খেয়ে বিবশ ঘুমোতাম’। ভাবনার এই কেন্দ্রবিন্দু থেকে যদি তন্দ্রার উপলব্ধিকে বিচার করা হয়, তাহলেই বোঝা যাবে গল্পকার গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনের দুঃখ, গ্লানি, স্বপ্ন এবং অবশ্যই উত্তরণকে এক আশ্চর্য মায়াবী কাব্যময়তায় ধরেছেন গল্পগুলোতে। সে জন্য আলাদা করে বিজয়াকে সাধুবাদ জানাই।

আজকের আলোচনার এই সীমিত পরিসরে ‘এলিয়েন’ গল্পগ্রন্থের সবগুলো গল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই, তাই সেই চেষ্টা থেকে বিরত রইলাম। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সবগুলো গল্পেই বিজয়া তার সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রেখেছেন। তবে এতো কিছুর পরেও পাঠক হিসেবে কোন একটি বিশেষ গল্পের প্রতি আলাদা আকর্ষণ অনুভব করা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘এলিয়েন’ এরকমই একটি গল্প। আগেই বলেছি, বিজয়া তার লেখায় বরাবরই জীবনের অন্তর্নিহিত চেহারাকে ধরার চেষ্টা করেন। ‘এলিয়েন’ এও তা-ই করেছেন, এবং খুব ব্যতিক্রমী ভঙ্গিতেই করেছেন। এই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছে সব সত্যই ভাঙা ভগ্ন, কোনোকিছুই এ্যবসোলিউট নয়, তখন প্রাত্যহিক জীবনটাও নিজের হয়েও যেন নিজের হয় না। আমার আলোচ্য গল্পের শুরুটাও সেখান থেকেই। হোমিওপ্যাথির ছোট ছোট শিশিকে ডেন্ড্রাইড দিয়ে কার্ডবোর্ডে এঁটে এঁটে ভারতবর্ষের মানচিত্র বানিয়েছে শৌভিক। নীচে লিখে দিয়েছে —’ইহা একটি নবতর সৃষ্টি’। কেন যেন নবতর লিখলো? তার মানে ‘পুরনো’ নয়, তাহলে পুরনো কি? কী যে নতুন আর কী যে পুরনো কিছুই মনে পড়ছে না শৌভিকের। আশাবরীর শুধু মনে হয় শৌভিক একটা অদ্ভুত প্রাণী, আর পাঁচজনের মতো নয় মোটেই। শৌভিক যে ঘরে বসে কাজ করে, সেখানে এলিয়েনের একটা ছবি বাঁধাই করে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছে আশাবরী। শৌভিককে বলেছে —’ওটাই দেখো… নিজেকে দেখা হবে’। স্বামী স্ত্রীর অন্তর্বর্তী সম্পর্ক এসে তলানিতে ঠেকেছে। শৌভিকও তো মনে মনে সহকর্মী শুভেচ্ছাকে চায়, কিন্তু বলতে পারে না। শুভেচ্ছার হাতে একটা বেগবান অশ্বের ট্যাটু আঁকা রয়েছে। শৌভিক আর্ট ক্লাসের বোর্ডে শূকর এঁকেছে, তারপর আরো কীসব লিখেছে। কিছু যেন ভেবেই চলেছে আনমনে। সব খেই হারিয়ে যাচ্ছে। জীমূতবাহন বলে ‘হবেই মশাই। সব সূত্রহীন তো… ভাববেন এক, হবে আরেক’। সত্যিই তো! শৌভিক হেঁটে যাচ্ছে রোজ গন্তব্যহীন, পেরিয়ে যাচ্ছে কিছু অন্ধ বাঁক। চারপাশের পৃথিবীটাকে সঠিকভাবে আর বুঝতে পারছে না সে। ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। মুক্তি খুঁজছে স্বপ্নে ডুব দিয়ে, যে স্বপ্নে দাদু আসেন। শৌভিককে বলেন, যা কিছু স্মৃতিচিহ্ন আছে, তাই দিয়ে আরো নতুন কিছু বানাতে। ঘরের সবুজ আলোয় দাদুর ছায়াময় অবয়ব হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে যেনো।কিন্তু আশাবরী হঠাৎ করে আলো জ্বালিয়ে দিতেই মিলিয়ে গেলো দাদুর ছায়াশরীর। শৌভিক আবার হেরে গেলো। সে মেধাবী, কিন্তু গভীরে বিভ্রান্ত। ফলে তার সমস্ত লড়াই তার নিজের সঙ্গেই। এখানেই শৌভিকের চরিত্রের আসল ডাইমেনশন। চরিত্রটির চূড়ান্ত মনস্তাত্বিক জটিলতা নিপুণ কুশলতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বিজয়া। মধ্যবিত্ত যাপনের ছোট ছোট আশা এবং তুলনায় অনেক বেশি নিরাশা এঁকেছেন বিভিন্ন অনুষঙ্গ আর মেটাফরের মাধ্যমে। আসলে যাপনের এই জটিলতাকেই কাহিনির ভরকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন বিজয়া, কোথাও মরাল পারফেকশনকে ধরতে চাওয়ার কোন চেষ্টাই করেন নি। এই পরিমিতিবোধের জন্য বিজয়ার গল্পের কাছে বার বার ফিরে আসা যায়।

লেখক : ডক্টর শ্যামলী কর ভাওয়াল, সহযোগী অধ্যাপক, গুরুচরণ কলেজ (জিসি কলেজ) শিলচর, অসম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন