ড. সত্যনারায়ণ দাশের লেখা ‘বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ’ বইটিতে আছে, কন্নড় আর তেলুগু ভাষায় ‘অক্কয়’ মানে দিদি। যেমন লক্ষ্মী হল গণেশের অক্কয়। তামিলে আবার ‘অক্কা’ মানে মা। ‘অক্কয়তৃতীয়া’ হল মাতৃসম দিদি লক্ষ্মীর সঙ্গে গণেশের একত্রে পুজো।অপভ্রংশে এটাই আমাদের কাছে অক্ষয়তৃতীয়া। এ-দিনের পুণ্যতিথিতে অনেক দোকানদার হালখাতা করেন।
যদিও অভিধানে অক্ষয়তৃতীয়া এন্ট্রিতে পাই, — “সত্যযুগের প্রথম দিন। এই তিথিতে গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণ করেছিল, দানধ্যানে পুণ্য হয়, অক্ষয়কীর্তি, অক্ষয়পরমায়ু হয় লোকে।”
অভিধানের যুক্তির বাইরে আমার চিন্তাটি সাবঅলটার্ন গোত্রের। যদিও আমার আরাধ্য দেবী গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নন, আমার আরাধ্য দেবতা এদেশে সাবঅলটার্ন স্টাডিজের জনক রণজিৎ গুহ।
প্রচলিত মতের বাইরে কোনও বিকল্প মতের কথা বললে বঙ্গীয় বিদ্বজ্জনসমাজ ভিরমি খায়। নানা রকম বক্রোক্তি ও কটূক্তি ভেসে আসে। তবু আমি নাচার।
অধিকন্তু দ্বিতীয় একটি বিকল্প সূত্রের সন্ধান দিচ্ছি।
রাবণের এক পুত্রের নাম অক্ষয়। রাক্ষসসেনাপতি এই ষোড়শবর্ষীয় কিশোর ছিল মহাবীর। রাবণ তাকে অশোকবনে পাঠিয়েছিল হনুমানকে অশোকবটিকা নষ্ট করার অপরাধে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে। হনুমানের হাতে অক্ষয় বধ হয়। তার মৃত্যু দিয়েই লঙ্কার পতন শুরু। রাবণের মৃত্যু দিয়ে তার শেষ হয়। হনুমানকে যথেষ্ট লড়তে হয়েছিল তাকে মারতে। অক্ষয়তৃতীয়া তার নাম থেকেই এসেছে বললে সত্যের অপলাপ হবে না। অনার্য লঙ্কাসাম্রাজ্যের পতনের শুরু যাকে দিয়ে, তার হত্যা আর্যসমাজের কাছে উৎসবের দিন তো হবেই।
রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ থেকে অনেক হিন্দুউৎসব এসেছে। বিজয়াদশমী, দীপাবলী, রামনবমী, দশেরা, জন্মাষ্টমী, ভীষ্মাষ্টমী ইত্যাদি। অক্ষয়তৃতীয়াও তাই রামায়ণোদ্ভূত বললে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
আসলে অক্ষয়তৃতীয়ার উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতরা এত কথা বলেছেন যে, বিভ্রান্তি জাগবেই মনে। সত্যযুগের প্রথমদিন নাকি এটি। কেউ কেউ বলেন ত্রেতাযুগের। ভগীরথের গঙ্গাকে মর্ত্যে আনয়নের দিন নাকি এটি। পরশুরামের জন্মদিন, চন্দনযাত্রা শুরুর দিন, মা অন্নপূর্ণার আবির্ভাবের দিন। ধরিত্রীপূজার দিন। কুবেরের মহাদেবের কাছে বরপ্রাপ্তির দিন। বৈভবলক্ষ্মীর পূজা শুরুর দিন। ব্যাসদেব ও গণেশকর্তৃক মহাভারত রচনা শুরুর দিন। বিষ্ণু-মহালক্ষ্মীর পূজার দিন, লক্ষ্মীগণেশের পূজার দিন। দানধ্যানের দিন। স্বর্ণসঞ্চয়ের দিন। আরও কত কী। মানুষ বিভ্রান্ত তো হবেই।
এবার একটু ব্যাকরণের কথা বলি। অক্ষয়তৃতীয়ায় অক্ষয় শব্দটিকে যে অর্থে ধরা হয়, তাতে এটি বিশেষণ পদ। কিন্তু আমাদের পূজাপার্বণের দিনগুলিতে সবই নামবাচক বিশেষ্যের পর তিথি যোগ করা হয়েছে। বিজয়াদশমী, রামনবমী, বুধাষ্টমী, ভীষ্ম-অষ্টমী, জামাইষষ্ঠী, — সবই বিশেষ্যের পরে তিথি যোগ করে। অক্ষয় মানে ক্ষয়হীন বা বিনাশহীন ধরা হয়, তাই বিশেষণ পদ। তাই খটকা লাগবেই।
অক্ষয়তৃতীয়া দ্রাবিড় সংস্কৃতি থেকে সনাতন হিন্দু সংস্কৃতিতে এসেছে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। মনসা-চণ্ডী-বনদুর্গা-ঘটলক্ষ্মী-বাসলী-শ্মশানকালী-ইতু-কৃষিজীবী শিব প্রমুখ দেবদেবী যদি দ্রাবিড় সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে, অক্ষয়তৃতীয়া না আসার কিছু নেই।