হিমাচলপ্রদেশের ডালহৌসি ধরমশালা আমরা যেসময়ে গেছি সেসময় সাধারণ ভ্রমণার্থী এই স্থানটি ঘোরার জন্য চট করে বাছতেন না। প্রধানত ডালহৌসি দেখার ভয়ানক সাধ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালের কথা পড়ে। উনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ডালহৌসি গিয়েছিলেন এবং সেখানকার প্রতিদিনের যে বর্ণনা সেটা পড়ে ওই নির্জনতা পাবার লোভ সত্যিকারের ভ্রমণপিপাসু মাত্রেই হবে। তবে সকলের যে হয় না সেটাও জেনেছিলাম কয়েকজনের মুখে। তাঁরা গেছিলেন এবং বলেছিলেন, “ধুর! ধুর! কিসসু নেই তেমন। আর বড্ড শান্ত, নিরিবিলি।” আসলে সকলেই যে নিরিবিলি পছন্দ করবেন এমনটি নয়। আমরা ওই নিরিবিলি আর রবীন্দ্রনাথের গন্ধ পেতে চলে গেছিলাম ডালহৌসি ও ধরমশালা। কিন্তু তখনও অতটা জানতাম না যে যাঁর জন্য যাচ্ছি তাঁর কিছুই প্রায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাওয়া যাবে আরও এক বাঙালি বীরের নানান স্মৃতি মাখা উপাখ্যান। তিনি বাঙালির নয়নমণি সুভাষ।
আমরা ডালহৌসি ক্লাবে ছিলাম। একেবারে ইংরেজ আমলের বাংলো। পুরোনো কাঠের বাড়ি, কাঠের সিঁড়ি, ফায়ারপ্লেস, বাথটাব সহ বিশাল স্নানঘর ও তার সংলগ্ন একটি Antiroom, যেখানে বেলজিয়াম গ্লাসের বিরাট আয়না, মানে আলাদা সাজঘর। প্রত্যেকটি সিঁড়িতে পা রাখলেই একটা অদ্ভুত আওয়াজ ওঠে — টক টক টক। সন্ধ্যায় সে আওয়াজ এই নিরিবিলি পরিবেশে বেশ জম্পেশ করে একটা ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করে। তার সাথে দাঁতে দাঁত লাগানো ঠান্ডা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।
জগদীশজী ছিলেন ওই ডালহৌসি ক্লাবের ম্যানেজার কাম কুক। সন্ধ্যায় আমরা দোতলা থেকে আর ঠান্ডায় নেমে নীচের বিলাসবহুল ডাইনিং হলে যেতে পারতাম না। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার সঙ্গে ভূতের ভয়ও কম ছিল না। তার থেকে ঘরে বসে জগদীশজীর হাতের গরম গরম রান্নার কথা আজও স্মৃতিতে অম্লান। প্রথম রাতেই ওই রান্না খেতে খেতে মজা করে জগদীশজীকে বলা হয়েছিল যে আপনার রান্না আর ডালহৌসির আবহাওয়ায় কিছুদিন থাকলে আমাদের আর কোনদিন ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন পড়বে না। এই কথা শুনতেই জগদীশজী বলে উঠেছিলেন, “একদম সহী বোলা আপনে। ইঁহাপর সুভাষ চন্দ্র বোস ভী আয়ে থে। একদম স্বস্থ হো কর ইঁহাসে গয়ে থে।” এসেছি রবীন্দ্রনাথের বাসা দেখব বলে কিন্তু জগদীশজী অন্য মণিমানিক্যের খোঁজ দিলেন।
১৯৩৭ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ৭ই অক্টোবর, এই পাঁচ মাস সুভাষ চন্দ্র বসু ডালহৌসিতে ছিলেন। The Tribune কাগজে ১৯৩৭ এর ২২ জুলাই তিনি লিখেছিলেন, “আমি আশা করি স্বাধীনতার পরে, আমাদের এইরকম প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর Water Bodies এবং Health Resorts গুলোকে আমরা যদি সুচারুভাবে সুস্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে পারি — তবে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে আগ্রহী ভারতীয়দের তো বটেই, বিদেশীদেরও আমরা পরিষেবা দিতে পারব। ধনী ভারতীয়রা এখন বিদেশে গিয়ে যে অর্থ খরচ করেন, তাও ভারতেই থাকবে। এছাড়া বিদেশী মুদ্রা উপার্জন করে আমরা আত্মনির্ভরতার পথেও কিছুটা এগিয়ে যেতে পারব।” তিনি অস্ট্রেলিয়ান আল্পস-এর ‘BAD GASTEIN’ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিতুলনা করে রাজগীর ও ডালহৌসির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন — এইসব স্থানই উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে খুবই আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়।
তিনি প্লুরিসিস সারানোর অভিপ্রায়ে ডালহৌসি এসেছিলেন। তার আগের পাঁচ বছর তিনি ইংরেজদের বিভিন্ন কারাগারে ও ভারতবর্ষের বাইরে বিভিন্ন দেশে নজরবন্দী অবস্থায় ছিলেন। ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি গান্ধী-আরউইন চুক্তি ভঙ্গের প্রতিবাদে বম্বেতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে নেওয়া প্রস্তাবের ফলস্বরূপ লর্ড ওয়েলিংডনের পুলিশ সুভাষকে ফেরার সময় কল্যাণ স্টেশনে গ্রেপ্তার করে চালান দেয় মধ্যপ্রদেশের সিডনী সাব-জেলে। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলে।
কিন্তু এবার বাদ সাধল দেহ। তাই পাঠানো হল ভাওয়ালী স্বাস্থ্য নিবাসে। কিন্তু সেখানে গিয়েও তাঁর অসুখ কমার লক্ষণ দেখা গেল না। গায়ে সব সময় অল্প জ্বর, পেটে অসহ্য জ্বালা। হজমশক্তি একেবারেই ছিল না। এবারে তাঁকে পাঠানো হল লক্ষ্ণৌ এর বলরামপুর হসপিটালে। সেখানকার ডাক্তার কর্নেল বাকলি তাঁকে দেখেই বললেন — অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাঁচতে হলে সোজা চলে যাও ইউরোপ। ইংরেজ সরকার রাজি হল। তবে শর্ত সাপেক্ষে। বলা হল, যেতে হবে নিজের খরচে। আর কলকাতা হয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ কলকাতার ছেলে কলকাতায় ফিরলে আবার আগুন জ্বলতে পারে।
১৯৩৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বম্বের জাহাজঘাটা থেকে পাড়ি দিলেন সুভাষ বোস ভিয়েনার উদ্দেশ্যে। বিশেষ পরিচিত ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারলেন না। যাবার আগে সুভাষ দুজনের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন পরিচয়পত্র চেয়ে, যাতে বিদেশে তাঁর রাজনৈতিক কাজের সুবিধা হয়। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে যথাসময়ে চিঠি পেয়ে গেলেন। এখন অপেক্ষা গান্ধীজীর চিঠির। কিন্তু নোঙর তোলার সময়েও সে চিঠি এল না। এলেন গান্ধীজীর সেক্রেটারী মহাদেব দেশাই। তিনি জানান গান্ধীজী কোনও পরিচয়পত্র দিতে পারবেন না। বিস্মিত স্তব্ধ সুভাষ ক্ষোভে দুঃখে রবীন্দ্রনাথের চিঠিও সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিলেন। এবার তিনি যা করবেন নিজের পরিচয়ের জোরে করবেন। কারো সুপারিশের জোরে নয়।
ভিয়েনাও কিছুদিন পর সুভাষকে রাখতে অস্বীকার করল। আবার শুরু বিভিন্ন দেশ পরিক্রমা। ভিয়েনা থেকে জেনিভা, জেনিভা থেকে ফ্রান্স। তারপর একে একে বুদাপেস্ট, সোফিয়া, বুখারেস্ট ও বেলগ্রেড। সেই সঙ্গে চলতে থাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনার কাজ। খবর এল পিতা জানকী নাথ বসু মৃত্যুশয্যায়। সুভাষ শাসকের সমস্ত নিষেধ অমান্য করে ফিরে এলেন বিমানযোগে করাচী ১৯৩৪ সালের ৩ ডিসেম্বর। সেখান থেকে কলকাতা। কিন্তু পিতার সঙ্গে শেষ দেখা হল না। এবার এলগিন রোডের নিজের বাসভবনে অন্তরীণ হলেন। ১৯৩৫ সালের ৮ জানুয়ারি আবার ইউরোপে নির্বাসনে যেতে হল।
প্রথমে নেপলস। তারপর রোম, সেখানে দেখা হলো মুসোলিনীর সঙ্গে। রোম থেকে ভিয়েনা, জেনিভা ও ফ্রান্স। জেনিভায় দেখা হল শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ রোমা রোঁলার সঙ্গে। ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গেলেন ডাবলিন। তারপর আবার ইংরেজের নিষেধ অমান্য করে বম্বে ফিরে এলেন এবং গ্রেপ্তার হলেন। এবার দেশের বিভিন্ন জেল ঘুরিয়ে ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনা হল কার্শিয়াঙের গির্দা পাহাড়ে নজরবন্দী করে।
আবার বাদ সাধল দেহ। বাধ্য হয়ে ন’মাস পরে ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে আনতে হল কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে। এবার তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল ১৭ মার্চ। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বিনা শর্তে। বোধহয় ইংরেজ সরকার ভেবেছিল তাঁর স্বাস্থ্যের যা অবস্থা তাতে তাঁর দ্বারা আর বিদ্রোহ বা বিপ্লবের আগুন জ্বালানো অসম্ভব। ৬ এপ্রিল তাঁকে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সংবর্ধনা দেওয়া হল। সভাপতি ছিলেন সাংবাদিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সুভাষ অত্যন্ত দুর্বল। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য এমন কোথাও যেতে হবে যাতে তিনি পরিপূর্ণ বিশ্রাম পান এবং সেখানকার জল হাওয়ায় সেরে ওঠেন। নাহলে আবার অসুস্থ হতে পারেন। ১৯৩৭ সালের ২৫ এপ্রিল সুভাষ পা রাখলেন ডালহৌসিতে ডা. ধরমবীরের অতিথি হয়ে। লাহোর নিবাসী ডা. এন আর ধরমবীরের স্ত্রী ছিলেন সুভাষের সহপাঠিনী। সেই সূত্রে ১৯৩৩ সালে নির্মিত ধরমবীরের ডালহৌসিস্থিত বাসভবন ‘KYNANCE’ এ বসবাস শুরু করেন সুভাষচন্দ্র বোস। এই বাড়িটি শহরের মাঝে থাকলেও তার চারপাশের দৃশ্য অতীব সুন্দর এবং তখন অত্যন্ত নিরিবিলি ছিল।
সুভাষ এখানে প্রতিদিন দু-কিলোমিটার হেঁটে একটা প্রস্রবণের ধারে যেতেন এবং সেই জল পান করতেন। সেখানে একটি পাথরের উপর বসে দু-ঘন্টা কাল ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সেই জলেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করলেন। এই প্রস্রবণের জল এখন ‘সুভাষ বাউলি’ নামে বিখ্যাত। আমরা সেই জলের একটা ভগ্ন ও বদ্ধ রূপ দেখতে পেলাম যা পানের অযোগ্য। কিন্তু স্থানটিতে পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকেছি শুধু এক আলোকোজ্বল মানুষকে স্মরণ করে। চারপাশে বরফ ঢাকা পীরপাঞ্জালের সারি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে।
ডালহৌসির অনেক মানুষ সুভাষ বোসকে চেনেন। সুভাষ বাউলি, সুভাষ চক এরকম বহু নাম এখানে ছড়িয়ে আছে। গান্ধী চক থেকে সুভাষ চকের রাস্তাটি মল রোড নামে পরিচিত। স্থানীয় নাম ‘ঠান্ডি সড়ক’। বোধহয় নিবিড় গাছের ছায়াঢাকা বলেই এই নাম। সম্ভবত KYNANCE বাসভবনটি এখন মেহের হোটেলে রূপান্তরিত। এখনও সুভাষ চন্দ্র বোসের ঘরটি সেরকম ভাবে সংরক্ষিত আছে।
গান্ধী চকের এক কোণে মূল মার্কেট। অসংখ্য দোকান। শীতবস্ত্র, সাজের জিনিস, ঘর সাজানোর জিনিস। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়েছিল একটি দোকানে সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি জ্বলজ্বল করছে। দোকানটা এক সর্দারজীর। তাঁর কাছে শুনলাম দোকানের আসল মালিক ছিলেন গোপাল সিং। সুভাষচন্দ্র যতদিন ডালহৌসিতে ছিলেন ততদিন গোপাল তাঁর সঙ্গী ছিলেন। এঁদের আদিবাড়ি ছিল লাহোর। এখন পাকাপাকি ভাবে ডালহৌসি। এই দোকান আগে ছিল সুভাষ চকে। তারপরে গান্ধী চকে চলে আসে। দোকানের নাম নভেল্টি স্টোর্স। এটা একটা অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা।
নেতাজী বলতেই মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়নের সৃষ্টি হয় আপামর ভারতবাসীর। তিনি এমন এক নায়ক যিনি কখনও আপোষের পথে হাঁটেন নি। যাঁদের সহযোগিতা পাবেন আশা করেছিলেন, তাঁরা যখন সরে গেছিলেন, সুভাষ আশাহত হন নি। পরিব্রাজক বিবেকানন্দের মত নেতাজী সুভাষচন্দ্রও শুধু ছুটে বেরিয়েছেন বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। সেই নেতাজী তাঁর জীবনের পাঁচটি মাস নিরিবিলিতে কাটিয়েছিলেন এই ডালহৌসিতে। হেঁটেছিলেন রোজ সুভাষ বাউলির পথে। বসতেন একটি উপলখন্ডে। সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে পারার অর্থ একটি তীর্থ পরিক্রমা করে আসা। যদিও সেভাবে ডালহৌসি কোনও তীর্থ স্থান নয়।