গোড়ার কথা:
মুর্শিদাবাদ বললেই আমাদের মনে পড়ে হাজারদুয়ারির কথা। মুর্শিদাবাদ ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্হান। সিল্কের শাড়ি, হাতির দাঁতের কাজ, খাগড়ার কাঁসার বাসন আর বিভিন্ন রকমের আমের কথা বলতেই হয়। ১৭৫৭ সালের আগে মুর্শিদাবাদ একটি প্রাণবন্ত সমৃদ্ধ নগরী এবং মুর্শিদাবাদ ছিল তৎকালীন বাংলা, উড়িষ্যা এবং বিহারের রাজধানী। তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁন ঢাকা থেকে রাজধানী পরিবর্তন করে এনেছিলেন। ১৭৫৭ সালে নদীয়ার পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যান বরং দেশেরই বেশ কিছু বিশ্বাসঘাতকের কুপরিকল্পনায় তাঁকে হারতে হয়। বনিকের মানদন্ড হয়ে গেল রাজদন্ড। উপনিবেশিক শাসনের আগে বাংলায় বহুবিধ কুটির শিল্প ছিল এবং কুটির শিল্প থেকে গ্রামের বহু মানুষই অর্থ উপার্জন করতেন। বিশেষ করে তাঁত শিল্পের কাজে গ্রামীণ মহিলারা অনেকেই যুক্ত ছিলেন এবং তাঁরা বিভিন্ন কাজ করে অর্থ উপার্জন করতেন। এখান থেকে বহুবিধ পণ্য সামগ্রী বিদেশের রপ্তানি করা হতো তার জন্য কোন সমস্যা হয়নি। কৃষিকাজ এবং কুটির শিল্পের মধ্যে একটা নিবিড় সংযোগ ছিল। উপনিবেশিক শাসনের পরে এই গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদ -কুটির শিল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কর আদায় করা ছাড়া কৃষি ও কুটির শিল্প কর্মকান্ডে নবাব সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন না। কৃষকের উপর কোন অত্যাচারের কথা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর কানে পৌছলে সংশ্লিষ্ট জমিদারকের ডেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন। গ্রামীণ মানুষ স্বাধীনভাবেই বহু কাজকর্ম করতে পারতেন। আপনারা সবাই জানেন যে বিখ্যাত মসলিন কাপড় বাংলাতেই তৈরি হতো। সেই কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার ফলে হয় রপ্তানিও বন্ধ হয়ে হয়। বাংলার ধন-সম্পত্তি লুটের মাধ্যমেই ইংল্যান্ডের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি হয়েছিল।
ভৌগলিক অবস্থান ও ফসল বৈচিত্র
সব কয়েকটি ঋতু পরিলক্ষিত হয়। ভাগীরথী নদী জেলার মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। মুর্শিদাবাদের দোঁয়াশ মাটির জমি খুব উর্বর। সব ধরনের ফসল ফলে। ধান, পাট, আলু, সবজি, আখ, ডালশস্য, তৈল বীজ, সব ধরনের ফল, রস ও গুড়ের জন্য খেঁজুর ও তাল, কোন কোন জায়গায় তুলো চাষও হত। রেশম শিল্পের জন্য তুঁত গাছের চাষও হয়। তুঁত গাছের পাতা রেশম মথের লার্ভাকে খাওয়ানো হয়। লার্ভা পরিপক্ক হওয়ার পরে হলুদ রঙের গুটি বাঁধে। সেই গুটি থেকে সুতো নিষ্কাশন করা হয় এবং সেখান থেকে সুতো পাকিয়ে পরে হস্তচালিত তাঁতে রেশম শাড়ি ও কাপড় তৈরি করা হয়। নীল চাষ করে নীল ও সূতী বস্ত্র বিদেশে রপ্তানি হত। চাল রপ্তানি পরিমানও ছিল যথেষ্ট। এখন সর্বত্র রাসায়নিক সার কীটনাশক দিয়ে চাষ শুরু হয়েছে। তথাকথিত বিজ্ঞানের নামে কৃষকদের শেখানো হয়েছে মাটিতে ও ফসলে বিষ দেওয়ার কথা যার বাজারি নাম রাসায়নিক সার, পোকা নাশক ও উদ্ভিদ নাশক। এখন সর্বত্র বিষাক্ত খাবার, মানুষের রোগভোগ বেড়েছে অনেক।
আমের কথা
মুর্শিদাবাদের ফসলের কথা বললে আমের কথা প্রথমেই বলতে হবে। আমের চর্চা এদেশের গুরুত্ব পায় মোঘল সম্রাট এর সময় এবং মুর্শিদাবাদের নববী আমলে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নবাব নাজিম মুজাহউদ্দিন মুর্শিদাবাদে আম চাষে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি প্রথম মুর্শিদাবাদে আম্বাখানা তৈরি করেন যেখানে আমের চর্চা হত। আম সংগ্রহের বিশেষজ্ঞের নাম ছিল আমতারাশ। শীতকালে যাতে আম খাওয়া যায়, সেই জন্য আম মধুর মধ্যে চুবিয়ে রাখা হতো। তখন ফ্রিজ ছিল না। মধু একটা আদর্শ সংরক্ষক।
আম সঠিক পেকেছে কিনা বা খাওয়ার উপযোগী হয়েছে কিনা একজন বিশেষজ্ঞ থাকতেন। পাকা আম কাটাও কিন্তু একটা শিল্পের পর্যায়ে ছিল। অনেক আম বাঁশের চোঁচ দিয়ে কাটা হতো, লোহার ছুরি ব্যবহার করা হতো না। আম কাটার আগে বোটার অংশটি কেটে জলে অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রাখা হতো। পাকা আম খাওয়া ছাড়াও আমের মোরব্বা, আমের পরোটা, আমের পোলাও খাবার চল ছিল। আমের মোরব্বা তৈরি করা হতো রানী পসন্দ আম থেকে। এই মোরব্বা গুলো কাঁচা আমের মতো দেখতে। আমের পোলাও তৈরি হতো আনারস জাতের আম দিয়ে। আনারস আমের বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন আমের স্বাদ পরখ করার মাঝে আনারস আমের টুকরো খাওয়া হত যাতে একটি আমের স্বাদ থেকে আরেকটি আমের স্বাদকে পৃথক রাখা যায়। এর স্বাদটা ছিল কিছুটা আনারসের মত। এখনো মুর্শিদাবাদে কিছু কিছু জায়গায় আনারস আম পাওয়া যায়।
জেলার রইস মির্জার বাগানে এককালে প্রায় ১৫০ ধরনের আমের জাত ছিল আর সেগুলো সব নির্বাচিত করেছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবরা। সেই আমগুলো হল দিল খাস, রইস পসন্দ, রানী পসন্দ, ভবানী চৌরস (রানী ভবনের নামে) কালাপাহাড় সরদার পসন্দ, লজ্জত বক্স (সুগন্ধী আম) ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য আম হলো বিড়া। আঁশবিহীন ছোট আম। মোলায়েম জাম (জাং) আকার একটু বড়, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে পাকে, ওজন ৫০০ গ্রামও হতে পারে। লজ্জত বক্স বা সারঙ্গা আমের গায়ে রং কালো হলে খাওয়ার উপযোগী বলে মনে করা হয়। এটা পাকে জৈষ্ঠ মাসে। রানীর পছন্দের আম রানীপসন্দ। কাশিমবাজারের রানীরা এটা পছন্দ করতেন। এই আরো একটি আম হল বেগম পসন্দ। রইস পসন্দ আরেকটি উল্লেখযোগ্য আম। তলাবি আম এখন দুর্লভ। আমের ফালি কেটে রাখলে ধীরে ধীরে গলে যায়। ছোট আকারের বিমলি আম এখনো কিছু কিছু জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আমের না বললেই নয়। হিমসাগর, কালাপাহাড়, কহিতুর, চম্পা (হুঁজুর পসন্দ- চাঁপা ফুলের গন্ধযুক্ত), চন্দনকোশা (চন্দনের গন্ধ যুক্ত সুগন্ধি আম ) ফকুল বয়ান (কর্পূরের গন্ধযুক্ত), গোলাপ খাস, মিশ্রি কন্দ, বারমেসিয়া, দোফলা, কিষান ভোগ, খিরসাপাতি, ঝুমকা ফজরী,জরদালু, শাহ পসন্দ, বড় ফজরি-আম পেকে যাওয়ার পরে এটা শুকিয়ে যায় অনেকটা খেঁজুরের মত। অনেকদিন ঘরে রেখে দেওয়া যায়। কোহিতুর আমের বৈশিষ্ট্য হলো অনেকটা কালাপাহাড় আমের মতো দেখতে, তবে গোলাকার। আর বেশিদূর পরিবহন করে নিয়ে আসা যায় না।বাগানেই বা বাগানের কাছেই দাঁড়িয়ে খেতে হয়।একটু চাপ লাগলে সেই জায়গাটি নরম হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে আম উৎসব করা হয় আম বৈচিত্র্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য। তবে তথাকথিত উন্নয়নের জন্য বহু আম বাগান কেটে ফেলে নষ্ট করা হয়েছে। বহু জাতই হারিয়ে গিয়েছে। আমেও ভয়ংকর বিষ স্প্রে করা হচ্ছে, প্রত্যেক বছর ফুল আসার জন্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী বিষাক্ত প্লাকলোবিউট্রাজোল গাছের গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে ফল পাকানো হচ্ছে কার্বাইড দিয়ে।
ফারাক্কায় প্রচুর লিচু চাষ হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গাতেই এর নামডাক কাছে। এছাড়া কম বেশী কাঁঠাল, জাম, পেয়ারা, কলার চাষ হয়। আমের মত কাঁঠাল ও লিচুর স্বাদ খুব ভালো।
বেলডাঙ্গার লঙ্কা বিখ্যাত। সরু আকারের খুব ঝাল লঙ্কা। বেলডাঙ্গা স্টেশন থেকে ট্রেনে লঙ্কা যায় শিয়ালদা এবং সেখান থেকে দিল্লি এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তে চলে যায়। বাজারে অনুরুপ লংকাকে বেলডাঙ্গার লংকা বলে বিক্রি হয়। বেলডাঙ্গা ব্লকে একটা আখের মিল স্থাপন করা হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে মিলটা চলে নি। বা কোন এক বিশেষ কারণে সেটাকে চালানো হয়নি। আখের রস থেকে জাল দিয়ে গুড় হয় আর সেই গুড়কে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় দানাদার চিনিতে পরিণত করা হয়। গুড় কিন্তু পুষ্টিকর চিনি কিন্তু পুষ্টিকর নয়। গুড়ে অনেক খনিজ পদার্থ থাকে। আখ চাষের একটা ভালো এলাকা ছিল। আখের এলাকা কমেছে। প্রসঙ্গক্রমে জানাই নদিয়ার পলাশীতেও একটা বড় আখের মিল ছিল, সেটাও কিন্তু বন্ধ।
ধানের কথা
মুর্শিদাবাদ জেলায় আমের পরে ধানের কথা বলতেই হবে। উইলিয়াম উইলিয়ামসন হান্টার ১৮০০ সালের শেষ দিকে স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট সব বেঙ্গল এ তৎকালীন জেলাভিত্তিক ধানের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। তবে সেই তালিকাটাই সম্পূর্ণ নয়। তবুও সেই সময়ের সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। মুর্শিদাবাদে প্রায় ৩১ রকমের দেশী ধানের তিনি উল্লেখ করেছিলেন সেগুলো হলো বলরাম ভোগ, বনকাটা, বেনাফুলি, চিত্রশালী, গন্ধেশ্বরী, গন্ধমালতী, কুঞ্জিল, কুসুম শালী, নোনা, ওরা, পরমান্নশাল,পর্বত জিরা ইত্যাদি। এই ধানগুলি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু যে ধানগুলো এখনো বেঁচে আছে মানে এখনো কিছু কিছু জায়গায় চাষ হয়, অন্য জেলায়ও চাষ হয় সেগুলো হলো বাঁশফুল, দাঁদখানি, দহন নাগরা,ঝিঙ্গাশালি, কনকচূঁড়, লঘু, মেঘি, রাঁধুনী পাগল, রামশাল। কিন্তু এটা বলা সম্ভব নয় যে মুর্শিদাবাদের নবাবরা কোন কোন চালের ভাত খেতেন। সরুচাল বাঁশফুল, দাদখানি, লঘু, পরমান্নশাল, রামশাল এখনো অনেক জায়গাতে হয় এবং সুস্বাদু ভাত। লঘু লাল রঙের ছোট সরুচাল। মুড়ি ও ভাতের জন্য বিখ্যাত। আউশে মরসুমে লাল চাল ও বাকড়ি আউশের আবাদ হত। ভাত ও মুড়ি ভালো হতো। গঙ্গা ও পদ্মার মাঝখানে জায়গায় যেমন ইসলামপুর, রানীনগর, জলঙ্গি ইত্যাদি অঞ্চলে আউশ ধানের চাষ ছিল। আউশের পাথরকুচি, কাদাচাপ, জামরে, ষেটে জামরে ইত্যাদি ধানের চাষ হতো। ডোমকল এবং অন্যান্য ব্লকেও আউশ ধানের খুব বড় এলাকা ছিল। এখন ধীরে ধীরে আউশ ধানের চাষ কমে গিয়েছে। সেখানে রাসায়নিক সার যুক্ত আমন ধান জায়গা করে নিয়েছে। আমন মরসুমে মুক্তহার নামে একটা ধানের চাষ হতো সেটা আজ আর নেই। সুগন্ধি কনকচুঁড়ের কথা আপনারা সবাই জানেন। এখানকার কনকচুঁড় কিন্তু অসুগন্ধি এবং আউশে চাষ হতো। দক্ষিণ ২৪ পরগনাতে এখনো কিছু জায়গায় আছে। ধানের সুগন্ধি খই থেকে বিখ্যাত জয়নগরের মোয়া তৈরি হয়। রাঁধুনি পাগলও সুগন্ধি চাল। বীরভূমে কিছু জায়গায় বাঁকুড়ায় সামান্য কিছু জায়গায় চাষ হয়। তথাকথিত উন্নয়নের দাপটে এই অমূল্য ধান সম্পদ আমের মত হারিয়ে গিয়েছে। আধুনিক রাইস মিল স্থাপন করা হয়েছে সেগুলি বেশিরভাগই মোটা চাল বিক্রি করে। বর্ধমানের রাইস মিলের মত সেই মিলগুলো নয়।
অন্যান্য
মুর্শিদাবাদে আগে কাউন, কোদো, শিয়াল লেজ ইত্যাদি মিলেটের চাষ হতো। কোন সময় কোদো খেতে একটু তেতো লাগতো। একটু ভিজে আবহাওয়ায় বিশেষ দুটি ছত্রাকের আক্রমনের ফলে কোদো মিলেটে বিষাক্ত সাইক্লোপিয়াজোনিক এসিড তৈরী করে। ভুল করে খেয়ে ফেললে বমি হত, ঝিমুনি লাগতো। বেশ কয়েকদিন থাকার পরে সেটা কেটে যেত। গবাদিপশুরও তাই হতো। যব এবং গমের চাষ হতই কিছু জায়গায়।
জেলায় পাট একটি অর্থকরী ফসল। তবে এখানে সবই মিঠাপাট। এখন আর তেতো পাটের চাষ হয় না। এখানে কোন জুট মিল সেই অর্থে নেই এবং পাটকাঠির অনেকটা অংশ পানের বোরোজে কাজে লাগে নওদা ইত্যাদি ব্লকে। বাকি পাটকাঠি জেলার বাইরে চলে যায়।
কলাই ডাল, মটর ডাল, মাষকলাই এবং সোনামুগের চাষ আছে কম বেশী। সোনামুখ ভাদ্র মাসে চাষ করা হতো নতুন পলিতে এবং তার একটা বিশেষ গন্ধ পাওয়া যেত। এখন এর এলাকা অনেকটাই কমে গিয়েছে। কালো মটর বেসনের জন্য ব্যবহৃত হয় এখনো। খেসারির চাষ এখন অনেক জায়গাতে আছে যদিও খেসারির নামে অনেক বদনাম করা হয়েছিল সেগুলো সত্যি নয়। শীতকালীন ডাল শস্য বক্রম ডাল বা বাকলা ডাল এর চাষ আছে ডোমকল, জলঙ্গি ও জিয়াগঞ্জে। জিয়াগঞ্জের চানাচুরের কারখানায় অনেকটাই চলে যায়। নদীয়া জেলাতেও বাকলার একটা ভালো এলাকা আছে। এই ডাল বিক্রির কোন সমস্যা নেই অনেকটা মটর ডালের মত খেতে। চানাচুরে যে বড় ডাল আপনারা দেখতে পান সেটা কিন্তু বাকলা ডাল।
পশু খাদ্যের জন্য ব্যাপক পরিমাণে ভূট্টা চাষ হচ্ছে। বহু জায়গায় গম এবং পাটের চাষের বদলে ভূট্টা চাষ হচ্ছে।আলু চাষের এলাকা বেড়েছে এবং বেশ কয়েকটা জায়গায় আলু সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ তৈরি হয়েছে।
গোপালনের চল ভালোই। ভাগীরথী মিল্ক কো-অপারেটিভ চলছে। রেশম শিল্প কোনরকমে চলছে। খাগড়ার কাঁসার বাসন একটা বড় ধরনের কুটির শিল্প ছিল। সেটাও প্রায় লুপ্তপ্রায়। হাতির দাঁতের নানা সামগ্রী বানানো হত।
জেলার মিষ্টি খুব বিখ্যাত। কান্দির মনোহরা, বহরমপুরের ছানাবড়া, জঙ্গীপুরের রসকদম্ব, রেজিনগরের পটলের মোরোব্বার কথা না বললেই নয়।
ইতিহাসে আমরা পড়ি কোন রাজার পরে কে মসনদে বসলেন, যুদ্ধের সাল তারিখ, শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব কত ছিল, প্রজাদের উপর অত্যাচার হতো কিনা এইসব। কিন্তু ইতিহাস বলতে সাধারণ মানুষের কথা খুব কম থাকে। কি চাষবাস করা হত, কুটির শিল্প কেমন ছিল, কে কি খেতেন, হাটবাজার কেমন ছিল এগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। আর ইতিহাসের বেশীর ভাগটাই লেখা হয়েছে শাসকের কথায় বা পরবর্তী শাসককে তুষ্ট করা বা কোন শ্রেনী স্বার্থকে তুলে ধরার জন্য।
শেষের কথা
উপনিবেশিক শিক্ষা আমাদেরকে এটাই শিখিয়েছে যে যাহাই পাশ্চাত্য তাহাই উৎকৃষ্ট। তাই দেশীয় সংস্কৃতি, দেশজ শিক্ষা ব্যবস্থা, দেশজ ফসল, কৃষি ব্যবস্থা সবই হচ্ছে অবজ্ঞার বিষয়। অবহেলায় আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ত্যাগ করেছি। হারিয়ে ফেলেছি আমাদের অমূল্য দেশজ ফসল সম্পদ, পুষ্টি বৈচিত্র্য। আমরা চাষ করছি এখন রাসায়নিক সার, কীটনাশক দিয়ে যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষের রোগভোগের বৃদ্ধি, মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি, পরাগ মিলনকারী মৌমাছি সহ বিভিন্ন উপকারী পোকার মৃত্যু ঘটছে। সেই সাথে কৃষকের চাষ করার খরচ ও বেড়েছে। এটাই নাকি উন্নয়নের মডেল। অনান্য জেলা শহরের মত বহরমপুর শহরে ওষুধের দোকানের সামনে রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। মানুষ বিষাক্ত খাবার খেয়েই অসুস্থ হচ্ছেন। সেই সাথে ফাস্ট ফুড, ঠান্ডা পানীয় ও জীবন যাপন। আশার কথা অনেক কৃষকই দেশজ ফসল ও জৈব চাষের প্রতি ইদানিং সচেতন হচ্ছেন। জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসল এর প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে। তেল মিল, খাদ্য প্রক্রিয়াকরন ও কোল্ডস্টেরেজের প্রয়োজন আছে। আসুন না এই পৃথিবীটাকে নবজাতকের জন্য বাসযোগ্য করে রাখি।
তথ্যসূত্র : পলাশীর পূর্ব বাংলার ৫০ বছর, ২০১৯, বিশ্বেন্দু নন্দ, খড়ি প্রকাশনী। হারিয়ে যাওয়া আমের খোঁজে, ২০১৯, সংকলক দীপক কুমার দাঁ, গোবরডাঙ্গা গবেষনা পরিষদ।
কৃতজ্ঞতা : শ্রী তাপস কুন্ডু, প্রাক্তন উপ কৃষি অধিকর্তা ( প্রশাসন) মুর্শিদাবাদ জেলা, শ্রী শান্তি কুমার পান, ধান সংরক্ষক ও জৈবকৃষক, সালার, মুর্শিদাবাদ, শ্রী বিমান পান্ডে, ধান সংরক্ষক ও জৈবকৃষক, ডোমকল , মুর্শিদাবাদ
অনুপম পাল, প্রাক্তন উপ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন), ঝাড়গ্রাম