ছেলের জন্য ‘মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন’ (পৃ-৮১) বলে সন্তানের মৃত্যুর জন্য মায়ের সারাজীবন প্রচন্ড কষ্ট পাবার ব্যাপারটিই স্পষ্টভাসিত হয়।
‘কটুমিঞার পালা’টির মধ্যে পূর্ববঙ্গের এক মুসলিম কটুমিঞার জীবনের ট্র্যাজিক চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। বিনোদের পালাতে আমরা দেখেছি, বিনোদের স্ত্রী বিনোদকে প্রচন্ডভাবে ভালো জানত। কিন্তু কটুমিঞার স্ত্রী ছিল চরিত্রভ্রষ্টা; তার প্রেমিকের মাধ্যমেই সে বিষ আনিয়েছে তার স্বামী কটুমিঞাকে হত্যা করার জন্য। কটুমিঞার সঙ্গে ঘরসংসার না করে তাকে তালাক দিতে পারত তার স্ত্রী। কিন্তু সেই নিষ্ঠুরা ও একটা নারী তার বৈধ স্বামীকে হত্যা করেছে। কটুমিঞা ‘ওজু করে নমাজ করে’ শ্বশুরবাড়ির দিকে যাত্রা করায় বোঝা যায় সে ধর্মপ্রাণ ছিল। অথচ ভাগ্যের এমনই ফের, তার স্ত্রীর তার সঙ্গে বিয়ের পূর্ব থেকেই একজনের সঙ্গে প্রেম ছিল, যার কারণে তার স্ত্রী কর্তৃক হত্যার শিকার হতে হয় তাকে। কটুমিঞা তার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার স্ত্রী তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করিয়েছে, সেটি না বলে রোগে সে মারা গেছে, এটি তার মাকে জানাতে সে অন্তিম সময়ে বলে গেছে :
খবরিয়া খবর কইও আমার মায়ের কাছে।
তোমার ছাওয়াল মারা গেছে বেধের বেরামে। (ওই, পৃ-৮২)
‘শেওলার পালা’ প্রবন্ধটির মধ্যে শেওলাবালা এবং কালাচাঁদের প্রেমের করুণ ট্র্যাজেডি চিত্রায়িত হয়েছে। শেওলাবালার সঙ্গে কালাচাঁদের বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়েছে দূরদেশের অচেনা একজনের সঙ্গে। শেওলা তার বিয়ে হয়ে যাবার পর কালাচাঁদকে বলেছে তার শ্বশুরবাড়ির বিন্নি ধানের ক্ষেতে কালাচাঁদ যাতে হরিণ সেজে আসে। সেখানে শেওলার সঙ্গে কালাচাঁদের দেখা হয়। লোকে সন্দেহ শুরু করে, শেওলা কেন এত ঘনঘন বিন্নি ধানের ক্ষেতে যায়। শেওলার দেবর গুলি ছুড়লে হরিণরূপী কালাচাঁদ মারা যায়। কালাচাঁদের মৃত্যুর কষ্টে শেওলা বিষপান করে মারা যায়; কিন্তু সে শোনায় যে সাপে তাকে দংশন করেছে। শেওলার বিয়ে হয়ে যাবার পর তার প্রেমিক কালাচাঁদকে ছেড়ে সে কীভাবে বাঁচবে, সে-সম্পর্কে গানের ভাষ্য :
হারে শেওলার বক্ষে ভাসে দুই না আইক্ষের জলেরে (ওই, পৃ-৮৩)
শেওলার স্বামী কিন্তু শেওলাকে ভালোবাসত; তার স্ত্রীর মৃত্যুর করুণ অনুধাবনে তার স্বামীর ভাষ্য :
আপন সোয়ামিরে ধুলাতে লটাইল রে
এ জীবনে আর নি হইবে দেখা। (ওই, পৃ-৮৬)
‘বরজের গান’ রচনাটিকে বরজ বা ব্রজের গান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পল্লীর প্রাচীন ও আধুনিক উভয় গানকে লেখক দুভাগে ভাগ করেছেন এ-প্রবন্ধে; ভাগদুটো হলো — প্রেমমূলক ও সাধনামূলক গান। এই দুই ধরনের গান ছাড়াও সমাজে যাতে অনাচার না ঘটে এবং সমাজশাসন যাতে সুনীতিময় হয়, সেই সত্য শুভ্রতাবিষয়ক গানও রয়েছে বলে বর্মণ উল্লেখ করেছেন। এক নিষ্ঠাপরায়ণ ব্রাহ্মণের ছেলে নিম্নজাতের ভুঁইমালি নন্দিনীর প্রেমজালে আটকে পড়ে তাকে বিয়ে করার কাহিনিকৃত নিয়েই বরজের গান উপাখ্যানটি নির্মিত হয়েছে। দূরদেশে যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণ-তনয় পথ চলতে চলতে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ায় এক বাড়িতে উঠে জল প্রার্থনা করলে এক কন্যা তাকে জলপান করায়। অতঃপর জিজ্ঞাসা করে ব্রাহ্মণতনয় জানে যে, সেই কন্যা নিচুজাত ভুঁইমালির নন্দিনী। সে জাতিচ্যুত হয়েছে বলে সে আর তার গৃহে ফিরে যায়নি। ভুঁইমালিকে সে ভালোবেসেছে বলে তাকে নিয়েই তাদের বাড়িতে ঘরসংসার শুরু করেছে। ব্রাহ্মণ যদি তার ঘরে ভুঁইমালিকে নিয়ে গিয়ে অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটাতে পারত তাহলে হয়তো ব্রাহ্মণের সংস্কার-উত্তীর্ণতার প্রশংসা প্রাজ্ঞজন করতে পারতেন।
‘জলসওয়া গীত’ প্রবন্ধে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হিসেবে জলসওয়া বা স্ত্রী আচারকে দেখা হয়েছে। ‘বিবাহের বর এবং কন্যাকে স্নান করাইবার জন্য নিকটস্থ নদী বা পুষ্করিণী হইতে কয়েক কলসী জল তুলিয়া আনাই জলসওয়া।’ (ওই, পৃ-৯০) পল্লীর কতিপয় স্ত্রী ধানদূর্বা সাজিয়ে কলসি নিয়ে নদী বা পুষ্করিণীর ঘাটে যাওয়ার কালে একদল স্ত্রীলোক তাদের সঙ্গে গান গেতে গেতে চলতে থাকে — সে-গানগুলোকে জলসওয়া বা জলভরা গীত নামে অভিহিত করা হয়। মূলত রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের রূপকাশ্রমে এই গানগুলো রচিত হলেও পল্লীবধূদের দুঃখময়তার ও বিরহের সুরই এই গানগুলোর অর্থবক্তব্যে প্রতিভাত হয়। গানভাষ্য লক্ষযোগ্য :
জলে কালো রূপ আমি নিরখি
… … …
জলে ঢেউ দিও না, কথা গো রাখো। (ওই, পৃ-৯০)
কৃষ্ণ যমুনাতীরের কদমগাছের ডালে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন বলে যমুনার জলে কৃষ্ণের ছায়া ভেসে উঠেছিল। জল আন্দোলিত করলে কৃষ্ণের ছায়া ভেঙে যাবে বলে রাধা জলে ঢেউ না দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রিয় পুরুষকে দেখার তাঁর এ-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নারীহৃদয় যে পুরুষের জন্য কত কাতর থাকে, তা স্পষ্টায়িত হয়। রাধা কুলবধূ বলে গাছের ডালের দিকে চোখ করে কৃষ্ণকে তিনি দেখতে সমর্থ হন না; লোকলজ্জার ভয়ে। এতে একজন বাঙালি কুলবধূর পরকীয়ার কথা অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘যমুনাতে যাবে বধূ ননদ করল আড়ি’ (পৃ-৯১) ভাষ্যের মধ্য দিয়ে ননদরা যে ভাবিকে পাহারায় রাখে, সে-কথা স্পষ্টতা পায়। ‘পন্থহারা হয়ে রাধা তখন ‘কৃষ্ণ বলে’ কান্দে।’ ‘কৃষ্ণের হাতেতে বাঁশী মুখেতে হাসি’ (পৃ-৯১) হলেও ‘রাখছে না গো শ্যামকালা’ (পৃ-৯১) বলে কৃষ্ণ যে রাধার চরিত্র নাশ করেছেন, সেই বিষয়টিও স্পষ্টতা পাচ্ছে। এই কৃষ্ণ আসলে মহাভারতের ভগবান কৃষ্ণ নন; এই কৃষ্ণ হলো লোকনায়ক ও লম্পট কৃষ্ণ।
‘নাইওরের গানে’র মধ্যে নববধূর স্বামীগৃহ হতে পিতৃগৃহে যাবার আকাঙ্ক্ষার অনুরণন অভিব্যক্ত হয়। ভাই বোনকে নিতে আসবে এ-আশায় বোন স্বামীগৃহে কালাতিপাত করে। ভাই বলে বোনকে :
আশ্বিন মাসে নিতে আসব পাটের টাকা পেয়ে।
আরো বলে :
অঘ্রানেতে নিতে আসব ধানের টাকা পেয়ে। (ওই, পৃ-৯২)
কিন্তু ভাইয়ের আসা হয় না; অথচ ভাইয়ের মনে কষ্ট ‘এমন সুন্দরী ভইনকে পরে নিয়া যায়।’ (পৃ-৯২)
সরিষার টাকা পেয়ে মাঘ মাসে ভাই বোনকে নিতে আসবে; কিন্তু তার আসা হয় না। বোন শুধু পিতৃগৃহে যাবার আশায় ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকে। একজন নববধূর তার মা, বাবা ও ভাইয়ের প্রতি যে প্রচন্ড ভালোবাসা কাজ করে, এ-বিষয়টিই নাইওরের গানে ফুটে উঠেছে।
‘পাখীর গান’ আসলে পাখি বিষয়ক গান নয়। প্রেমাস্পদকে পাখি কল্পনা করে এই গানগুলো রচনা করা হয়। পাখিকেন্দ্রিক গানগুলোকে লেখক প্রেমমূলক ও তত্ত্বমূলক গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নারী তার প্রেমিকের জন্য বিরহকাতর — পাখি বিষয়ক গানে এটিই বেশি স্পষ্টভাসিত; কারণ প্রেমিকরা পাখির মতো উড়ে যায় তাদের প্রেমিকাদের বঞ্চিত করে। তত্ত্বমূলক গানে মনের সঙ্গে পাখির তুলনা করে মনের মানুষরূপী স্রষ্টার পরিচয় লাভের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। ‘পাখির দুই চরণ বান্ধিয়া রাখিতাম মাথার কেশ দিয়া’ (পৃ-৯৪) ভাষ্যমধ্য দিয়ে একজন নারী তার কেশ নিয়ে তার প্রেমিকের চরণ বেঁধে রাখত বলে তার অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করেছে।
‘ভ্রমর দূত’ শীর্ষক গানটিতে রাধা পিতা, মাতা, ভাই ও স্বজনদের ছেড়েই নয়, শুধু কলঙ্ককে সাথি করে কৃষ্ণকে প্রেমের ধন হিসেবে গ্রহণ করেন, সেই কৃষ্ণ কর্তৃক অবজ্ঞাত হয়ে দুঃখের প্রচন্ড বেদনাময়তা তাঁর জীবনকে আর্ত করে তোলার কথাই অভিব্যক্ত হয়েছে। ‘হলে শুচি মনে রুচি নামের শুচি চাইও’ (পৃ-৯৫) ভাষ্যমধ্য দিয়ে অন্তরকে পবিত্র করে প্রার্থিত মনোধনরূপ স্রষ্টাকে চাওয়ার কথাই ‘মেওয়া মিছরির গান’টিতে ভাষারূপ লাভ করেছে। (ক্রমশ)