কুও হিস (Kuo Hsi) (১০২০-৯০) ‘প্রকৃতির কোলে প্যাগোডা’ শীর্ষক চিত্রটি এঁকেছেন। এ-ছবিটিতে landscape-এর অপূর্ব দৃশ্যময়তা-সহ ভাবতন্ময় মিস্টিক ভাব এবং হালকা কুয়াশার বর্ণমধুর ব্যঞ্জনা স্পষ্টায়িত হয়েছে।
স্মর্তব্য যে, চীনের শিল্পকলার চরমোৎকর্ষ তেরোশো বছরের প্রাচীন। চৈনিক শিল্পীরা রঙের চেয়ে রেখার চমকের দিকেই অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। সোনালি রং তাঁদের খুব পছন্দের ছিল। বৌদ্ধযুগের চিত্রে রঙের প্রাধান্য ও রঙের চাতুর্য বেশি প্রত্যক্ষগোচর হলেও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অাঁকতে তাঁরা রেখাকেই অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছেন।
চীনের একটি প্রবাদে আছে : ‘ছবি জিনিসটা একটা নির্বাক কবিতা মাত্র।’ (ওই, পৃ ১১৭) খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকে যশস্বী কবিও ছিলেন। একই ভাব, ভাবনা ও তন্ময়তা দিয়ে অবশ্যই চিত্রশিল্পী আঁকবেন চিত্রকলাকর্ম এবং কবি লিখবেন শব্দের ক্যানভাসে জীবনের অপরাজেয়তার গান।
‘আম্রতত্ত্ব’ প্রবন্ধটি যেহেতু মূলত আম নামক ফল বিষয়ক সে-কারণে এটিকে বিষয়নির্ভর প্রবন্ধ বলা যায়। মধ্যপ্রাচ্যীয় খলিফা হারুন আল রশিদের আমলের একটি গল্পে ভারতের আম জয়যুক্ত হয়েছে বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের অন্তর্দৃষ্টি যে সুদূরপ্রসারী এবং আর্থনীতিকভাবে বাঙালি সমাজকে লাভবান করে তোলার পক্ষে, তা এই প্রবন্ধে স্পষ্ট হয়েছে। বাড়িতে আমের অধিক ফলন ঘটিয়ে আম বিক্রি করে এবং কাঁচা আম নষ্ট না করে তা শুকিয়ে ‘আমশি’ প্রস্ত্তত করে বিক্রি করলে সাধারণ গ্রামীণ জনতার আর্থনীতিক সচ্ছলতা সৃষ্টি হবে বলে বর্মণের মতো আমরাও মনে করি। বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জায়গায় ‘কৃষি ফলাইলে নিজেদের প্রয়োজন মিটানো ছাড়াও দু-পয়সা আয় হইতে পারে।’ (ওই, পৃ ১২৩) বলে তিনি যে-ভাষ্য দিয়েছেন, এতে দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাঙালির আর্থিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও স্পষ্টায়িত হয়েছে।
বর্মণের ‘ছোটদের ছবি অাঁকা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি শিশুদের ছবি অাঁকাকে তাদের মনের স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ গতিময়তার ওপর নির্ভর করে তাদের সৃষ্টিশীল চেতনাকে যাতে জাগ্রত করতে পারে শিক্ষকদের এমন মমত্ববোধসম্পন্ন ও দূরদৃষ্টি নিয়ে শিক্ষা দানের কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন। শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে যে তাঁর সুগভীর পঠন ছিল, এ-প্রবন্ধটিতে তাঁর অনুধাবন ও বিশ্লেষণের মধ্যে তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। শিশুদের একটি নিজস্ব ইচ্ছা ও কল্পনাশক্তি থাকে। স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের সে-কল্পনাময়তার মধ্যে বিরাজ করতে দিয়ে তাদের অাঁকানোর বা শেখানোর কাজটি অব্যাহত রাখতে দিলে তাদের সৃষ্টিশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটবে বলে বর্মণের মতো আমিও মনে করি। বারো-তেরো বছর বয়স থেকে শিশুদের ইমপ্রেশন বা ভাবকল্পনাভাবনা বিশ্লেষণমুখিতার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অাঁকতে বা শিক্ষাদান করতে গিয়ে তাদের ব্যর্থতার জন্য তাদের তিরস্কার না করে বরং তাদের ঘাটতিগুলো সহজভাবে ধরিয়ে দিয়ে সৃষ্টিশীলতার দিকে তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করা উচিত। শিল্পের প্রকাশের তিনটি ধারাকে লেখক কথাশিল্প, সুরশিল্প এবং চিত্রণশিল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রত্যেকের শৈশবকাল তার কাছে স্মৃতি রোমন্থনের আনন্দময়তার সময়, যেহেতু তখন সে বিশ্বের বিচিত্র বিষয়কে কৌতূহল, বিস্ময়, সচেতনতা ও অন্তরঙ্গতা দিয়ে প্রত্যক্ষ করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ শিশুদের শিল্পমনকে সুস্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন বলেই শান্তিনিকেতনে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্কন ও বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ‘শিশুর প্রকৃতিদত্ত শিল্পবোধ যাতে উপযুক্ত পরিচালনায় বিকাশলাভ করতে পারে তার সর্ববিধ সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল’ (ওই, পৃ ১২০) শান্তিনিকেতনে। শিশুশিক্ষা সম্পর্কে বর্মণের অভিমত খুবই দূরদর্শী; তা নিম্নরূপ : ‘শিক্ষাকে এখন মুখস্থ করানোর মধ্যে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। শিক্ষা বলতে এখন আত্মবিকাশ বলে মেনে নিতে হবে। এ বিকাশ তিক্ততার মধ্যে, জটিলতার মধ্যে, অনিচ্ছার মধ্যে হতে পারে না।’ (ওই, পৃ ১২০)।
বয়স্কদের এবং শিশুদের অভিজ্ঞতার জগৎ ভিন্নরকম। শিশুর শিল্প ও কল্পনা শক্তিকে শিশুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড়দের বিবেচনা করতে হবে। সহানুভূতি ও সমবেদনার আলোকে শিশুর মনের তলদেশ শিক্ষক যদি উদ্ঘাটন করতে পারেন, তবেই শিশুর সৃজনশক্তিকে তিনি সৃষ্টিশীল করতে সমর্থ হবেন।
শিশুদের চিত্রকলা শিক্ষা দিলে তারা সকলেই যে চিত্রশিল্পী হবে এমন নয়। শিক্ষার কারণে নিজের ও পরিবারের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের সমস্যা যেমন মিটানো যায়; তেমনি শিল্পশিক্ষার মাধ্যমে মননকে গভীর এবং কামনা ও রুচিকে মার্জিত করে তোলা যায় বলে চিত্রশিল্প-শিক্ষণ শিশুদের সুকুমার বোধকে শানিত ও কল্যাণময় করে তুলতে পারবে বলে বর্মণের মতো আমিও মনে করি।
‘বর্ষার কাব্য’ প্রবন্ধটিতে সাহিত্যকর্মে বর্ষাঋতু ব্যবহৃত হবার বিষয়টি ভাষারূপ পেয়েছে। বর্ষা উপভোগের তিনটি যুগধারাকে লেখক এ-প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। কালিদাসের মেঘ যে বিরহীমনের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, বিষাদ ও বিরহকে ধারণ করেছে, সেটি হলো একটি ধারা। বৈষ্ণব কবিগণ প্রিয়সুখবঞ্চিতা ও ব্রজাঙ্গনাগণের ব্যাকুলতা ও প্রতীক্ষমানতা নিয়ে যে শিল্পনিপুণ বর্ষাকাব্য রচনা করেছেন, তা দ্বিতীয় ধারার মধ্যে পড়ে। তৃতীয় পর্বটি হলো রবীন্দ্রনাথের বর্ষাভাবনা বিষয়ক। বৈষ্ণব ও রবীন্দ্রনাথ — উভয়ের বর্ষাভাবনার পার্থক্য সম্পর্কে লেখক-ভাবনা উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘বৈষ্ণব বর্ষাকাব্যের মূলতত্ত্ব ছিল পাওয়ার উৎকণ্ঠা বা গভীর আসঙ্গলিপ্সা। রবীন্দ্র বর্ষাকাব্যের পরমাত্মা পাওয়া না পাওয়ার হর্ষ দোলায় আন্দোলিত।’ (ওই, পৃ ১২৪) রবীন্দ্রনাথ বর্ষার সমগ্র রূপকে জীবনের সঙ্গে অভিন্ন করে উপলব্ধি করে মূলত ঔপনিষদিক স্রষ্টাচেতনার মধ্যে মানুষের বিরহচেতনাকে সমীকৃত করে তাঁর বর্ষাচিন্তার মধ্যে অনুলিপ্ত করেছেন।
বর্ষার চতুর্থ স্তর সম্পর্কে বর্মণ যা বলেন, তা বাংলার আপামর সাধারণ দরিদ্র জনতা যে বর্ষার কারণে কখনো প্লাবনে, কখনো ফসলহানিতে পর্যুদস্ত হয় — সে-কথা বলে দরিদ্র জনগণের প্রতি তাঁর অন্তরের প্রকৃত মমত্ববোধের কথাই চিত্রিত করেছেন।
‘এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়’ প্রবন্ধটির মধ্যে বর্মণ হিন্দু ও মুসলিম — উভয় সম্প্রদায়ের কিছু ভিখারির কথা উল্লেখ করেছেন। ভিখারিদের নিয়েও যে প্রবন্ধ লেখা যায় — বর্মণের মানবিক মমত্ববোধ সেটিও সত্যতায় পর্যবসিত করলো। পূর্বকালের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা মনে করত, ভগবান মানুষের দ্বারে ভিখারি বা আর্ত ব্রাহ্মণের বেশে আসেন। সে-কারণে তাদেরকে খালি হাতে ফেরানো হতো না।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষ্ণব, বোষ্টম বা বৈরাগী হিসেবে ভগবানের কাজে তারা ব্যাপৃত — এ অনুধাবন মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তারা ভিক্ষাবৃত্তি করে। মাজারে মাজারে অনেক মুসলমান ফকির সেজে বা লালসালু পরিধান করে ভিক্ষাবৃত্তি করে। মানুষের কাছে হাত পেতে মানবতা ও মনুষ্যত্বকে কলঙ্কিত করার মতো এমন নিচু কাজ আর নেই। লেখকভাষ্য উদ্বৃতিযোগ্য : ‘কর্মহীন অলস জীবনযাত্রায় আর আত্মার ও দেহের অবমাননাকর ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে ভগবানের কোনো সত্তাই যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না একথা তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলিবার দিন আজ আসিয়াছে।’ (ওই, পৃ ১১৩)
ভিখারিদের সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়ার কথা লেখক বলেছেন। গ্রামের হাট-বাজার ঝাড়ু দিলে দোকানদাররা খুশি হয়েই তাদেরকে পারিশ্রমিক স্বরূপ কিছু দেবে, এতে ভিক্ষাবৃত্তির মতো গ্লানি ও লজ্জাকর কাজের যেমন অবসান ঘটবে; তেমনি মানুষের মর্যাদাও কর্ম করার মধ্যে তৃপ্তি খুঁজে পাবে। গৃহস্থের বাড়িতে ধান ভেনেও ভিখারিরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। সস্তা দরে বাঁশ কিনে চুপড়ি, ঝাঁপি ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করেও ভিখারিরা জীবনযাপন করে মানবমর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে পারে। মাথা গোঁজার ঠাঁই যে জমিটুকু ভিখারিদের আছে, সেখানে তারা লাউ, কুমড়া ও শিমগাছ লাগিয়ে তার ফলন দিয়েও জীবিকার প্রচেষ্টা চালাতে পারে বলে লেখক মন্তব্য করেছেন। লেখকভাষ্য উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘নির্ঝঞ্ঝাটে ভগবৎ আরাধনা করিতে চাও, বেশ ত কর না, কিন্তু পরের নিকট ভিক্ষা চাহিয়া করিও না। নিজের শ্রমের দ্বারা পেট চালাও, সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম উপাসনা যাহা করিতে হয় কর।’ (ওই, পৃ-১১৪) (ক্রমশ)