আমরা সকলেই কোনও না কোনও বর্ণান্ধ ব্যক্তিকে চিনি, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বা পরিবারেই হয়ত কোনও কালারব্লাইন্ড বা সিভিডি রোগি আছেন। সিভিডি-র পুরো কথাটি হল Colour Vision Deficiency। বর্ণান্ধ লোকেরা সাধারণত অদ্ভুত রঙের কম্বিনেশনযুক্ত পোশাক পরে থাকেন, যেটা সাধারণ মানুষের চোখে অদ্ভুত ঠেকে। এটা জানলে আশ্চর্য হতে হবে যে সারা বিশ্বের প্রতি ক্লাসরুমে গড়ে একজন করে বর্ণান্ধ ছাত্র থাকে।
প্রতি বারো জন ছেলের মধ্যে একজন আর প্রতি ২০০ জন মেয়ের মধ্যে একজন বর্ণান্ধ থাকে। বর্ণান্ধতা হল এক্সলিঙ্কড রিসেসিভ ডিসর্ডার (X-Linked Recessive Disorders)। মেয়েদের যেহেতু দুটি এক্স ক্রোমোজোম (X Chromosome), তাদের ভোগার চান্স কম। কারণ দুটি এক্স ক্রোমোজোমই তাহলে ত্রুটিযুক্ত হওয়া দরকার। বাস্তবে তার সম্ভাবনা কম। অপরপক্ষে ছেলেদের সেক্স ক্রোমোজোম এক্স আর ওয়াই। যেহেতু তাদের একটিই এক্স ক্রোমোজোম, সেটিতে গোলমাল থাকলেই অশেষ ভোগান্তি। তাই মেয়েরা কম ভোগে, ছেলেরা বেশি ভোগে সিভিডি-তে। আর, একজন বর্ণান্ধ মায়ের পুত্রসন্তান বর্ণান্ধ হতে পারে।
কালার ব্লাইন্ডনেস বা সিভিডি বা বর্ণান্ধতা
একটি জিনগত ব্যাধি যেখানে কোন সেল (Cone cell) রঙের কুলগোত্র চিনতে অপারগ হয়, এক্স ক্রোমোজোমের ডি এন এর ত্রুটিযুক্ত জিনপরম্পরার জন্যেই এটা দেখা যায়।
আমাদের রেটিনায় তিন প্রকার কোন সেল থাকে। এরা কেউ লাল, কেউ সবুজ, আবার কেউ নীল রঙ চিনতে পারে। সিভিডি কেসে এই কোন সেল-গুলির যে কোনও একটি টাইপ আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিচারের ক্ষমতা হারায়। এইজন্য মস্তিষ্ক কোন্ রঙের আলোকরশ্মি তার সংকেত পায় না। রঙের পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
বর্ণান্ধ ব্যক্তিদের সাধারণত লাল, সবুজ, বাদামি, কমলা আর হলদে রঙ দেখতে অসুবিধে হয়। সবগুলিই পাঁশুটে সবুজ লাগে তাদের কাছে। নীল রঙ আর পার্পল (নীলাভ লাল) রঙকে একই লাগে বর্ণান্ধদের কাছে। প্যাস্টেল কালার গ্রে বা ধূসর লাগে। সবুজ-ঘাটতিযুক্ত লোক সবুজকে ধূসর বা গোলাপী দেখে, লাল-ঘাটতিযুক্তরা লালকে কালো বা সবুজ দেখে।
স্কুলে রঙ চেনার প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি।
সাধারণ বর্ণবোধসম্পন্ন ছাত্রের কাছে রঙ একটি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস, কিন্তু একজন বর্ণান্ধ ছাত্রের কাছে রঙ একটি দুঃস্বপ্নমাত্র। আত্মবিশ্বাসকে এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দেয় রঙ চেনার অক্ষমতা। জ্ঞানার্জন-প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় বর্ণান্ধতা। সাধারণ, সিলি মিসটেক করে তারা। শিক্ষকের নির্দেশ পালনে শ্লথতা বা দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায় বর্ণান্ধদের মধ্যে। ক্রমে ক্রমে তাদের মনের মধ্যে দেখা দেয় হতাশাবোধ, এবং অনিবার্য ক্রোধ।
রবীন্দ্রনাথের স্কুলজীবনে রঙচেনার ব্যাপারে ঘাটতি যে ছিলই, সেটা হলফ করে বলতে পারি। কবি জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “তাসখেলায় আমার কোনোদিন মন যায় নাই, তাহা আমার কাছে বিশেষ বিরক্তিকর বোধ হইত।”
আরও লিখেছেন, “ইস্কুলে আমি কোনোদিন পুরস্কার পাই নাই, একবার কেবল সচ্চরিত্রের পুরস্কার বলিয়া একখানা ছন্দোমালা বই পাইয়াছিলাম।”
রবীন্দ্রনাথ রঙ না চেনায় মাঝে মাঝেই তাঁকে বিরাট বিড়ম্বনায় পড়তে হত। এর ফলে তাঁর জুটত সহপাঠীদের উপহাস, ব্যঙ্গবিদ্রুপ। যা তাঁকে একাকী, দলছুট করে তুলেছিল। তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন, সেই হতাশা থেকে জন্ম নিত ক্রোধ। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে (মতান্তরে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি) তার সাক্ষ্য তিনি নিজেই রেখেছেন। বারান্দার এক কোণে একটি চৌকির উপর বসে সামনে কাঠের গ্রিলের উপর তাঁর মাস্টারি ফলাতেন তিনি। কোন গ্রিলটা ভালোছেলে, কোনটা দুষ্টু ছেলে, কোনটা বুদ্ধিমান, কোনটা বোকা, সেটা তিনি চিহ্নিত করে নিয়েছিলেন। দুষ্টু গ্রিলের উপর তাঁর কাঠি বা বেতের প্রহারের লীলা তিনি নিজমুখেই ব্যক্ত করে গেছেন। এক বিজাতীয় ক্রোধ জন্ম নিত তাঁর সুকুমার ছাত্রমনে। এটা যে শিক্ষক ও সহপাঠীদের উভয়ের উপরই, তা বেশ বোঝা যায়।
নর্মাল স্কুলে এসে তাঁর অবস্থা আরও দুঃসহ হয়ে ওঠে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন ছাত্রদের সঙ্গে তিনি মিশতে পারতেন না। ছাত্ররা অধিকাংশই গালিগালাজে অভ্যস্ত ছিল, তাদের কাছে বালক রবিকে নিয়ত অপমানিত হতে হত। তাই তিনি সহপাঠীদের সংস্রব এড়িয়ে চলতেন। ছুটির সময় বাড়ির চাকরকে নিয়ে দোতলার রাস্তার দিকের বারান্দায় একটি জানলার ধারে বসে থাকতেন। কারোর মুখোমুখি হতে চাইতেন না বলেই বাকিদের নিষ্ক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করতেন।
কেন কবি মিশতে পারতেন না, তা নিয়ে আধুনিক গবেষকরা অনেকেই অনেক তত্ত্ব দেবেন। এমনকি অটিজিম বা ডিসলেক্সিয়ার (Dyslexia and autism) মতো বলিউডি তত্ত্বও কেউ দিতে পারেন। আমার মতে ওসব কিছুই নয়, বর্ণান্ধতাই তাঁকে সমস্যায় ফেলত। বর্ণান্ধরা রঙ ঠিকমতো (বিশেষত লাল আর সবুজ) চিনতে না পারায় আউটডোর বা ইনডোর গেমসে অংশ নিতে চায় না। বোর্ড গেম, ম্যাচিং গেম, মেমোরি গেমে তারা অস্বস্তি বোধ করে। আমি নিজে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় কমন রুমে ক্যারম খেলায় গোপাল সরকার বলে আমাদের এক সহপাঠীকে খেলতে দেখতাম। প্রতিবার স্ট্রাইকের পর রেড স্ট্রাইকারটি খুঁজে দিতে বলত সহ-খেলোয়াড়দের। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে খেলা ছেড়ে চলে যেত। ক্রিকেটেও লাল ডিউস বল সে সবুজ মাঠে দেখতে পেত না। ফলে মিসফিল্ড করত। গোপালের এই দুরবস্থা কেন সেটা আমরা বুঝতে পারতাম। সে নিজেই বলত জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পর মেডিকেল টেস্টেই ধরা পড়েছিল সে রেড-গ্রিন কালার ব্লাইন্ড। তবে তাতে তার ডাক্তারি পড়া আটকায়নি।
বালক রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে নর্মাল স্কুলে পড়তেন (১৮৭০-৭৫-এর মধ্যে কোনও এক সময়ে), সে সময় বর্ণান্ধতার ধারণাটিই পরিষ্কার ছিল না। লাল জিনিসকে কেউ সবুজ বললে তাকে খ্যাপা-পাগল বলে তিরস্কার করা হত। কেউ মিশতে চাইত না। মাস্টারমশাইরাও অকথা-কুকথা বলতেন, অশ্রাব্য গালিগালাজ করতেন। ঠিক এই জিনিসটাই রবীন্দ্রনাথের উপর ঘটেছিল নর্মাল স্কুলে। ইন্ডোর ও আউটডোর গেমসে অংশ নিতে চাইতেন না রঙ গুলিয়ে ফেলার ভয়ে। ফলে সহপাঠীদের কাছে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। এক মাস্টারমহাশয় তাঁকে এত অশ্রাব্য গালি দিতেন যে তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তরই দিতেন না। সকলের শেষে লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকতেন মৌনীবাবা হয়ে।
এত বিরূপতা সত্ত্বেও বাংলায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন মধুসূদন বাচস্পতি স্যারের কাছে। কারণ বাংলায় রঙের ব্যাপারই নেই, ব্যাখ্যা আর ভাবসম্প্রসারণ করেই নম্বর পাওয়ার উপায় আছে, ভূগোলের ম্যাপের মতো, ইতিহাসের সচিত্র চরিত্রের মতো বিপজ্জনক জিনিসে রঙটঙ গুলিয়ে ফেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না তাঁকে।
আজকাল যেমন বর্ণান্ধ ছাত্রছাত্রীকে প্রথমেই শনাক্ত করার উপায় বেরিয়েছে ক্লাসে, ঊনিশ শতকের শেষে তেমন কোনও উপায় ছিল না। আজকাল কেউ বর্ণান্ধ (আংশিক বা পুরো) কিনা ধরার জন্যে বিদেশে শিক্ষকরা তার উপর লক্ষ রাখেন। সকলে মিলে রঙিন কোডিং করা বাক্স সরাতে বলা হলে অন্য ছাত্রদের থেকে সে দূরে দূরে থাকে, সাহায্য করতে ইতস্তত করে। বোর্ডগেম, ম্যাচিং গেম, বিশেষ বিশেষ মেমোরি ও সিকোয়েন্স গেমে অংশ নিতে সে ভয় পায়।
যখন রঙের ব্যবহারের ক্লাস থাকে, তখন সে অসহায়ভাবে পাশের ছাত্রের ব্যবহার করা রঙপেন্সিল চেয়ে নেয় একের পর এক। সেইমতো সহপাঠীর অনুকরণে বোলাতে থাকে পর্যায়ক্রমে।
তাদের আরও সমস্যায় পড়তে দেখা যায় ভূগোলের ক্লাসে। ম্যাপের মধ্যে রঙের ব্যবহার উল্টোপাল্টা করে। ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো করেও অনলাইনে, রঙিন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এমন পরীক্ষায়, তারা হঠাৎই খারাপ ফল করতে থাকে।
ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির প্র্যাক্টিক্যালেও তাদের বর্ণান্ধতা ধরা পড়ে যায়। রঙ চিনতে ভুল করে।
রঙকানা হওয়া তো আর অপরাধ নয়। তাই তাদের শণাক্ত করে আজকাল বিশেষ পদ্ধতিতে ক্লাস করানো হয়। আজকাল বিদেশে অনেক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বর্ণান্ধ পরীক্ষার্থীকে সাধারণ বর্ণবোধযুক্ত ‘রিডার’-এর সাহায্য নিতে দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এটা চালু হয়েছে কিনা জানি না।