যে সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য ফার্মেসি পণ্যের অস্তিত্ব ছিল না, সেই সময়ে রান্নাঘরের অতি পরিচিত রসুন ভেষজ পরিপূরক হিসেবে একটি সম্পূর্ণ ফার্মেসি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করত। রসুন মানব ইতিহাস জুড়ে ব্যবহৃত সবচেয়ে প্রয়োজনীয় স্বাদের কন্দগুলির মধ্যে একটি। ৫০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে মধ্য এশিয়ায় বন্য রসুনের প্রচলন দেখা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ানদের কাছে রসুনের প্রথম লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালে ফ্যারাওদের সমাধিসৌধে রসুনের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইজিপ্টেও রসুনের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। সুমেরীয়রা (খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০-২১০০) রসুনের রোগ নিরাময় গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং সম্ভবত তারাই রসুন চীনে নিয়ে এসেছিল, যেখান থেকে পরে এটি জাপান এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। রসুনের বিস্তার সম্ভবত প্রথমে পুরাতন বিশ্বে এবং পরে নতুন বিশ্বে ঘটেছিল।
প্রাচীন গ্রীকরাও রসুনের মূল্য দিত, যদিও যারা রসুন খেত তাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল (তাদের ‘র্যাঙ্ক গোলাপ’ বলা হত)। গ্রীক দ্বীপ ক্রেটের নসোস প্রাসাদে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময়, ১৮৫০-১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের রসুনের কন্দ আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রাথমিক গ্রীক সেনা নেতারা বড় যুদ্ধের আগে তাদের সেনাবাহিনীকে রসুন খাওয়াতেন। এটি একটি আকর্ষণীয় তথ্য যে আজকাল কিছু ক্রীড়াবিদ বিপজ্জনক ট্রানকুইলাইজারের বিস্তৃত পরিসর গ্রহণ করলেও, গ্রীক অলিম্পিক ক্রীড়াবিদরা ভাল স্কোর নিশ্চিত করার জন্য রসুন খান। থিওফ্রাস্টাসের (৩৭০-২৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মতে, গ্রীকরা তাদের দেবতাদের কাছে রসুনের কন্দ দিয়ে উপহার নিবেদন করত, যা তারা প্রধান রাস্তার মোড়ে রাখত। অরফিয়াস রসুনকে প্রতিকার হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
হিপোক্রেটিস (Hippocrates) (৪৫৯-৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তার রচনায় রসুনকে অন্ত্রের পরজীবী, ল্যাক্সান এবং মূত্রবর্ধক হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ডায়োস্কোরাইডস (Dioscorides) (৪০-৯০ খ্রিস্টাব্দ) রসুনকে কোলিক উপশমের প্রতিকার হিসেবে, একটি কৃমিনাশক, ঋতুচক্র নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিকার হিসেবে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি সাপের কামড়ের প্রতিকার হিসেবেও রসুনের সুপারিশ করেছিলেন (এই উদ্দেশ্যে তারা রসুন এবং ওয়াইনের মিশ্রণ পান করত) এবং পাগলা কুকুরের কামড়ের প্রতিকার হিসেবে (এই উদ্দেশ্যে তারা সরাসরি ক্ষতস্থানে রসুন লাগাত)। তাই, গ্রীকরা রসুনকে ‘সর্বরোগহর’ তকমায় ভূষিত করেছিলেন।
প্রাচীন মিশরীয়রা রসুনকে শ্রদ্ধা করে রাজা তুতানখামুনের সমাধিতে রেখছিলো। তারা বিশ্বাস করত যে এটি পরকালে শক্তি এবং সুরক্ষা প্রদান করে।
এরপর আদি নিবাস ছেড়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিল রসুন। তারপর চীন হয়ে পূর্বদিকে ও ভারত হয়ে দক্ষিণমুখী যাত্রা সবই আজ ইতিহাস। কিছু ঐতিহাসিক এখনও দাবি করেন যে রসুনের উৎপত্তি চীন থেকে।
১৬৬৫ সালে লন্ডনের বিখ্যাত প্লেগ মহামারীর সময় ‘দি লন্ডন কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স’ রসুন ব্যবহারে সুপারিশ করেছিলো। বিখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক সিডেনহ্যম গুটিবসন্ত সারাতে রসুন ব্যবহার করেন। ১৮৫৮ সালে লুই পাস্তুর জানিয়েছেন, রসুনের টাইফয়েড ও কলেরা জীবাণু মারার ক্ষমতা রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে আহতদের ক্ষতস্থান ও আমাশা সারাতে রসুনের বিরাট ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে রসুনকে রাশিয়ান পেনিসিলিন বলা হতো। আহত সৈনিকদের ক্ষত সারাতে রসুনের ব্যবহার করা হতো।
ফরাসি ফাইটোথেরাপিস্ট লেক্রেক ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারী, তথাকথিত ‘স্প্যানিশ জ্বর’-এর সময় প্রতিরোধমূলক প্রতিকার হিসেবে রসুন ব্যবহার করেছিলেন। ১৯১৭ এবং ১৯১৮ সালে আমেরিকায় ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীর সময়, লোকেরা জনসমক্ষে বের হওয়ার সময় রসুনের মালা পরতেন।
প্রাচীন ইসরায়েলিরা রসুনকে ক্ষুধা নিবারণকারী, রক্তচাপ বৃদ্ধিকারী, শরীর গরমকারী, পরজীবী-নাশক ইত্যাদি হিসেবে ব্যবহার করত। ইহুদি ধর্মের ধর্মগ্রন্থ তালমুদে প্রতি শুক্রবার রসুন দিয়ে খাবার খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাইবেলে রসুন এবং পনির দিয়ে খাবারের কথা বলা হয়েছে, যা আগে ফসল কাটার সময় খেত।
তিব্বতিদের কাছে রসুন দিয়ে পেট ব্যথা নিরাময়ের প্রাচীন রেসিপি রয়েছে। এটি ব্যাবিলনের বাগানে জন্মানো হত এবং স্থানীয় জনগণ এটিকে ‘র্যাঙ্ক গোলাপ’ বলত।
প্রথম খ্রিস্টীয় শতাব্দীতে, রসুনকে কামোদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করা হত।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে স্লাভিক লোকেরা উকুন, মাকড়সার কামড় এবং সাপের কামড় এবং আলসার এবং ক্রাস্টের বিরুদ্ধে রসুন ব্যবহার করত। মধ্যযুগে আরবি চিকিৎসাশাস্ত্রে রসুন ছিল একটি বিশেষ মূল্যবান প্রতিকার।
প্রতিক্ষেত্রে রসুন কিন্তু খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে মহৌষধ হিসেবে সম্মান পেয়েছে। তাই আজো রসুনকে ‘রাশিয়ান পেনিসিলিন’, ‘প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক’, ‘উদ্ভিদ ভায়াগ্রা’, ‘উদ্ভিদ তাবিজ’, ‘রাস্টিকস থেরিয়াক’, ‘স্নেক গ্রাস’ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।ক্যালিফোর্নিয়ার গিলরয়কে “বিশ্বের রসুনের রাজধানী” বলা হয়।
বিশ্বে চীনের রসুন উৎপাদন সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮০%। এরপর ভারতের স্থান, এবং অন্যান্য দেশে উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম।
রসুন মানবদেহের জন্য একটি চমৎকার টনিক। প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সবকিছুর চিকিৎসার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়ে আসছে। অতীতে এর প্রমাণিত কার্যকারিতা সত্ত্বেও এটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল, এমনকি নিষিদ্ধও করা হয়েছিল, শুধুমাত্র এর তীব্র এবং অপ্রীতিকর গন্ধের কারণে।
রসুন এককোষী ও বহুকোষী দুই ধরনের হয়।এককোষী রসুন বেশি উপকারী।
রসুন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে ভরপুর। এতে পটাসিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন, জেক্সানথিন, ভিটামিন সি এবং অল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম, তামা, পটাসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন এবং ভিটামিন বি১ থাকে। আসুন জেনে নিই এই মহৌষধের গুণাবলী:
১) এটি প্রদাহ-বিরোধী: রসুনে অ্যালিল সালফাইড থাকে, যা একটি প্রদাহ-বিরোধী, ক্যান্সার-প্রতিরোধী যৌগ যা গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধির হার ধীর করে।
২) গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি লিভারকে কিছু বিষাক্ত পদার্থ থেকে রক্ষা করতে পারে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
৩) কাঁচা রসুনের কোয়া চিবিয়ে গিলে ফেললে ব্যাকটেরিয়া রসুনের শক্ত নিরাময় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারে, যা অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়া রোধ করতে সাহায্য করে ।
৪) কাঁচা রসুনের সক্রিয় যৌগগুলি রক্তচাপ কমাতে পারে
৫) কাঁচা রসুন কোলেস্টেরলের মাত্রা উন্নত করতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে; রসুন মোট এবং এলডিএল কোলেস্টেরল কমাতে পারে। গবেষণা চলছে। রসুনের ট্রাইগ্লিসারাইড কমানোর ক্ষমতা আছে।
৬) কাঁচা রসুন খাওয়া শরীরের ভারী ধাতুর বিষক্রিয়া দূর করতে সাহায্য করতে পারে। উচ্চ মাত্রায়, রসুনের সালফার যৌগগুলি ভারী ধাতুর বিষাক্ততার কারণে অঙ্গের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
৭) দিনে এক কোয়া কাঁচা রসুন চুল ঝরা রোধ করে। রসুনের রস মাথায় মাখলে চুল বেশি পাকতে পারে না।
৮) স্পন্ডেলাইটিস প্রতিরোধ করতে পারে না ঠিকই কিন্তু এই রোগে যারা আক্রান্ত তারা কয়েক কোয়া রসুন থেঁতো করে তেলের সঙ্গে ফুটিয়ে ব্যথার স্থানে লাগালে উপকার পাওয়া সম্ভবনা প্রবল।
৯) রসুন শরীরে উত্তেজনা বাড়ায়। নিয়মিত খেলে বয়সও রোখা যায়।
১০) জলের পর অরুচি কাটাতে তেলের মধ্যে রসুন কুচি দিয়ে ভেজে তার মধ্যে মুড়িটা একটু বাদাম দিয়ে খেলে উপকার হতে পারে।
১১) সর্দি কাশিতে ভালো ফল পাওয়া যায়। হুপিং কাশিতে উপকার হয়।
১২) যাদের কোষ্ঠকাঠি নিয়ে সমস্যা আছে তারা নিয়মিত রসুনকে দেখতে পারে অশ্ব রোগীয় রসুনের ব্যবহার উপকারী
১৩) বিছা বা বোলতা কামড়ালে রসুন থেঁতো করে লাগালে দারুন ফল পাওয়া যায়।
১৪) বাতেন ব্যাথা কমাতে অব্যর্থ ওষুধ।
যারা কোনমতেই কাঁচা রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না বা খেতে পারেন না তারা রসুনের আচার করে খেতে পারেন বা রসুনের কোয়া জলে ফেলে গিলে খেয়ে ফেলতে পারেন।
গরম ভাতের সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা রসুনও খেতে পারেন। ঠান্ডা লাগা তো কমবেই, সাইনাসাইটিসের কষ্ট থেকেও রেহাই মিলবে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ রসুন থেকে চা এবং টিংচার তৈরি করতে শিখেছে এবং একই সাথে সমান পরিমাণে রসুন এবং মধু ইত্যাদি মিশ্রিত করে খেতে শিখেছে। ফলস্বরূপ, তারা অনেক গ্যাস্ট্রিক সংক্রমণকে পরাজিত করে, ঠান্ডা, জ্বর, ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখেছে, যার ফলে অনেক অসুস্থ মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত হয়েছে।
দুর্গন্ধ রসুনের জনপ্রিয়তাকে কাবু করতে পারিনি। মাছ মাংস রসুন ছাড়া তো অচল। আর সাহেবদের দেশের রসুনকে নিয়ে রীতিমত উৎসব পালন করা হয়।
প্রতি বছর ১৯শে এপ্রিল সারা বিশ্বে “জাতীয় রসুন দিবস” হিসেবে পালিত হয়। রসুন প্রেমীদের জন্য এমন উৎসব সত্যি বিরল।