আজ শ্রীনিবাস রামানুজনের মৃত্যুদিন ও গত ২১ শে এপ্রিল ছিল মানব কম্পিউটার শকুন্তলা দেবীর জন্মদিন। দুঃখের কথা রামানুজন এবং শকুন্তলা দেবীকে নিয়ে যতটা মাতামাতি করা হয়, ততটাই উপেক্ষিত বঙ্গদেশের ‘দ্য রাইমিং ম্যাথামেটিশিয়ান’, বিখ্যাত মানসাঙ্কবেত্তা, লোকশিক্ষক, পূর্তবিদ্যাবিশারদ, গণিতবিদ শুভঙ্কর দাস। অঙ্কক্ষ্যাপা এই বাঙ্গালিটি কবিতা আর গণিতের মধ্যে চীনের প্রাচীরটি ভেঙে দিয়ে প্রবর্তন করলেন নিত্য ব্যবহার্য হিসাব-নিকাশে অঙ্কের সহজ সরল পদ্ধতি “শুভঙ্করী” নামে পাটিগণিত, ‘মানসাঙ্ক’ তথা মৌখিক গণিতের (মেন্টাল ম্যাথামেটিক্স) এক সরল ধারা।
আসলে অঙ্কক্ষ্যাপা এই মানুষটি ছিলেন ‘পড়াশোনা না জানা’ খেটে খাওয়া মানুষের অংকের মাস্টারমশাই। তিনি বুঝেছিলেন সমাজের অবজ্ঞা অবহেলার নিরক্ষর মানুষগুলো বই পড়ার সময় নেই। কাজেই এই প্রান্তিক মানুষগুলোকে অংক শেখাতে হবে কোন নতুন টেকনিকে। যদি মুখে মুখে ছড়ার মাধ্যমে এদের অংক শেখানো যায়, তাহলে খুব সহজেই মানুষগুলি অঙ্কের ভাষা বুঝতে পারবে। শুরু হলো কাজ। শুভঙ্কর তার ‘মানসাঙ্ক’র সাহায্যে প্রাথমিক গণিতের পাশাপাশি নানান ধরনের জটিল অংক যেমন জমির পরিমাণ, জিনিসের দাম, রাজস্ব সংক্রান্ত জটিল হিসাব ইত্যাদি সরল পদ্যের মাধ্যমে চালু করলেন। কঠিন গাণিতিক সমস্যাগুলি মৌখিকভাবে গণনা করার জন্য তিনি ছন্দের আকারে সরল বিধিতে (আর্যায় বা তোর্যায়) লিপিবদ্ধ করেন যা ‘শুভঙ্করী আর্যা’ নামে পরিচিত হয়। গণিতের বিধি তথা আর্যাগুলি প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট ও অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে মেট্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত শুভঙ্করী গণিতরীতি প্রচলিত ছিল এবং বাংলার স্কুলগুলিতে পড়ানো হত।
এই শুভঙ্করের জন্ম চতুর্দশ শতকের শুরুতে রাজা, বাঁকু রায়ের রাজ্যে। তারই নামে সেই ভূখন্ডের নামকরণ হয়েছিল বাঁকুড়া। তাঁর পিতা বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের স্বল্পবেতনের কর্মচারী ছিলেন। তাঁর পৈতৃক নাম ভৃগুরাম দাস। “শুভঙ্কর “নাম টি মল্ল রাজার দেওয়া।মেধাবী শুভঙ্কর পনের বৎসর বয়সেই বাংলাসহ ফরাসী ভাষা আয়ত্ত করেন এবং গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর সেই রাজ্যের মন্ত্রী (দেওয়ান) ছিলেন।একটা গল্প বলি —
এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে রাজা বঙ্কু রায় একটি লম্বা তালগাছের মুখোমুখি হন এবং রাজা সেই গাছের উচ্চতা জানতে আগ্রহী হয়ে পড়েন কিন্তু কেউই তার প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর দিতে পারেননি। তাঁর সভাসদদের কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে, রাজা শুভঙ্কর দাসকে ডেকে পাঠান, কাকতালীয়ভাবে শুভঙ্কর সেই সময় গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সহকর্মী কর্মকর্তাদের সাথে মতবিরোধের কারণে সম্প্রতি রাজপ্রাসাদের পদ থেকে পদত্যাগ করা সত্ত্বেও, শুভঙ্কর গাছের ছায়ার উপর ভিত্তি করে গাছের উচ্চতা গণনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করেন।
সেই সময় বাঁকুড়ার জনপদ একদিকে পাঠানদের লোলুপ আক্রমণ ও অবাধ লুঠতরাজ,অন্যদিকে রুক্ষসুক্ষ এবং শস্যহীন দুর্ভিক্ষে ছিলো জর্জরিত। নিছক এক অংকের মাস্টার হয়ে ঘরে বসে না থেকে সমাজ সচেতন শুভংকর তখন গরিব মানুষের বাঁচাতে এলাকার সব জমিদারদের বাড়ি গেলেন।তাদের বোঝালেন পুকুর কাটুন বৃষ্টির জল ধরে রাখুন।শুরু হল অংকের হিসেব কষে ‘দাঁড়া’ তৈরির কাজ। শুভঙ্কর আরও ভাবলেন ‘দাঁড়া’ দিয়ে নয় খরা আটকানো যাবে কিন্তু অতি বর্ষণে গ্রামগঞ্জ বানে ভাসলে কি হবে? বিস্তার অংক মিলিয়ে এই দাঁড়া থেকেই বাঁধ তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং বাতলে দিলেন শুভঙ্কর।সোনামুখী থানার উত্তরাংশে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত ‘শুভঙ্কর দাঁড়া’ ও বড়জোড়া থানার অনুরূপ এলাকায় ‘শুভঙ্কর খাল’ তারই পুরাকীর্তির উদাহরণ।
বিখ্যাত ভাষাবিদ ডঃ সুকুমার সেন ব্যাখ্যা করেছিলেন, ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর অনেক আগে, জটিল বিষয়গুলি বর্ণনাকারী বা ব্যাখ্যাকারী ধাঁধা এবং ছোট শ্লোকগুলিকে বাংলায় আর্যা’ এবং তোর্যা বলা হত। প্রশাসনিক কাজে অঙ্ককে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে শুভঙ্কর একটি বই লিখেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে রাজ্য শাসনের কাজে এইসব ‘শুভঙ্করী’ প্রয়োগ করে ব্যাপক সাফল্য পান বাংলার সেই সময় নবাবেরা। বইটির নাম ‘ছত্রিশ কারখানা’।
এই বইটিতে প্রায় দুই হাজার বা তারও বেশি শ্লোক রয়েছে।
কিন্তু রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে শুভঙ্করের ওপর জোরালো নজর পড়ে নাগরিক বৌদ্ধিক সমাজে। অনেক পরে হলেও, শুভঙ্করের এইসব ‘মেড ইজি ম্যাথ’র উপর ভিত্তি করেই আধুনিক অংকের বিজ্ঞরা ওই সব শ্লোকগাথাগুলিকে বীজগণিতের সূত্রে ফেলতে শুরু করেন।
বীজগণিতের গণৎকারা শুভঙ্করের প্রথম যে দুটি ‘আর্যা’কে এক্স এবং ওয়াই ধরে নিয়ে ছকেছিলেন, তার দুটি উদাহরণ বলি —
১) “ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক উচ্চস্থানে
চূঁড়ায় উঠিবে এক কীট করে মনে।
দিবাভাগে দশ হাত উঠিতে লাগিলো
নিশাযোগে অষ্ট হাত নীচেতে নামিলো
না পায় যাবৎ চূড়া করে সে অটন
কত দিনে উঠেছিল কর নিরূপণ!”
(একটি উঁচু জমিতে ৩০ হাত উঁচু একটি গাছ ছিল এবং একটি পোকামাকড় সেই গাছের চূড়ায় পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিত। প্রতিদিন সকালে এটি ১০ হাত উপরে উঠতে সক্ষম হত কিন্তু রাত নামতে নামার সাথে সাথে সে আট হাত নীচে পড়ে যেত। কিন্তু পোকাটি তার যাত্রা শেষ করার প্রতিজ্ঞা করেছিল। চূড়ায় পৌঁছাতে তার কত দিন সময় লেগেছিল?)
২) “সরোবরে বিকশিত কমল নিকর।
মধুলোভে এল তথা অনেক ভ্রমর।
প্রতি পদ্মে বসি ভ্রমর যুগল।
অলিহীন রহে তবে একটি কমল।
একেক ভ্রমর বসে প্রত্যেক কমলে।
বাকি রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে”
(একটি পুকুরে পদ্মের ফুল ফুটেছিল। মৌমাছি সংখ্যায় এসেছিল, প্রতিটি পদ্মের উপর প্রতিটি জোড়া মৌমাছি বসেছিল, কিন্তু একটি পদ্ম খালি ছিল। যদি প্রতিটি ফুলের উপর একটি মৌমাছি বসে, তবে একটি মৌমাছি একটি ফুল পায় না। সেখানে কত মৌমাছি এবং পদ্ম ছিল?)
যদি আমরা বীজগণিতের সাহায্যে এই সমীকরণটি সমাধান করার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা এইভাবে জানতে পারব:
ফুলের সংখ্যা X এবং মৌমাছির সংখ্যা Y ধরা যাক।
Y = 2 (X -1)…..1
Y= X +1……2
আমরা (1) এবং (2) সমাধান করি এবং পাই
X=3, Y=4
তাহলে, উত্তর হল, পুকুরে তিনটি পদ্ম এবং চারটি মৌমাছি ছিল।
১৯৮০ সালে ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর হিস্ট্রি অফ ম্যাথমেটিক্স প্রকাশিত ‘অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান লিপস্ ইন্টু ম্যাথমেটিক্স’(বি এস যাদব ও মনমোহন সম্পাদিত)
বইয়ে এসব তথ্য রয়েছে। অবশ্য এর অনেক আগেই ভাষাবি সুকুমার সেন এর উল্লেখ করেছেন।সম্ভবত তারই প্রভাবে ১৯৩৭ সালে শিক্ষাবিদ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শুভঙ্করীর ভিত্তিতেই শ্যামচরণ বসুকে দিয়ে ‘অ্যারিথমেটিক ফর স্কুল’ গ্রন্থটি লিখিয়েছিলেন। আরো পরে নিজের বাবারই অনুপ্রেরণায় রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই বইটির বাংলা সংস্করণ ‘পাটিগণিত’ লেখেন মিত্র ইনস্টিটিউশনের অংকের মাস্টার কেশব চন্দ্র নাগ। তবু শহরে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শুভঙ্করের পিছু ছাড়েনি। ‘শনিবারে চিঠি’তে সজনীকান্ত দাস লিখেছিলেন, ‘অংক মঙ্গলের কথা অমৃত সমান/ শুভঙ্কর দাস কহে শুনে পুণ্যবান.’
তাঁর এত অবদান সত্ত্বেও, ক্যালকুলেটর এবং কম্পিউটার, মুঠোফোনের দৌলতে তাঁর গাণিতিক ধাঁধাগুলি স্মৃতি থেকে অনেকটাই মুছে গেছে। মুছে গেছে জীবনের সহজ পাটিগণিত। আজও তিনি বাংলার শিক্ষা ইতিহাসের একজন বিস্মৃত নায়ক হিসেবে রয়ে গেছেন। তাঁর উত্তরাধিকারকে সম্মান জানাতে কেবল কয়েকটি প্রাচীন গ্রন্থ এবং বাঁকুড়ার একটি এলাকা তাঁর নাম বহন করে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কলকাতা টিভি (ভারত আমার ভারতবর্ষ), শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় লেখা, উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য।