ইরানের শিরাজে বায়োসেফটির উপর একটি কনফারেন্সে অংশগ্রহন করার সুযোগ হয়েছিল ২০০৩ সনের এর শেষের দিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অংশগ্রহনকারীরা এসেছিলেন ঐ কনফারেন্সে। আমার জীবনে অনেক সেমিনার, কনফারেন্স, মিটিং এ অংশগ্রহন করেছি দেশে এবং বিদেশে, এটি ছিল তার মধ্যে সবচাইতে বেশি সুসংগঠিত বা অরগানাইজড একটি কনফারেন্স।
রাত দুটোয় তেহরান এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। আমরা চারজন গিয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকে। তিন জনই ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এবং আমি গিয়েছিলাম বায়োটেকনোলজি রিসার্চার বা বিজ্ঞানী হিসেবে। এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এসেছে দুটি সুশ্রী ইরানী তরুণী, যাদের বয়েস ২০-২২ বছর এর মধ্যে হবে। পরনে ল্যাবকোটের মত হাটু পর্যন্ত লম্বা সাদা বোরখা পরা। মাথায় স্কার্ফ, যাতে পুরো মাথার চুল ঢাকে না। মেয়ে দুটোকে দেখে খুব অবাক হলাম। এই বয়েসি মেয়ে এত রাত্রে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিতে এসেছে, যেটা আমাদের চিন্তা ভাবনাতেও সম্ভব নয়।
রাত্রে তেহরানে কাটিয়ে পরদিন প্লেনে শিরাজের দিকে রওনা হলাম। তেহরান থেকে শিরাজ বিমানপথে সোয়া এক ঘণ্টার পথ। শিরাজে পৌঁছলাম। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম শিরাজকে। শিরাজ একটি ঐতিহাসিক শহর, সুন্দর শহর। মহকবি শেখ সাদী আর হাফিজ এর জন্মভূমি। এই শহর বিখ্যাত হয়ে আছে এই দুই কবি, সুফিসাধক, ইরানের প্রাচীন ঐতিহ্য পার্সেপোলিস আর শাহ চেরাগ এর পুণ্যাত্মার নামে।
কনফারেন্স হলো হোমা হোটেলে। ওখানেই থাকার ব্যবস্থা হলো আমাদের। বিলাসবহুল পাঁচ তারকা বিশিষ্ঠ হোটেল। ইরানের হুমা নামের এক লেজেন্ডারি পাখির নাম অনুসারে এই হোটেলের নামকরণ। হুমা একটি পারসিয়ান শব্দ যার প্রকৃত উচ্চারণ হোমা। একটি পাখি যে কখনো ওড়া বন্ধ করে মাটিতে নামে না। হুমা পাখি কখনই বিশ্রাম নেয় না, সারা জীবন পৃথিবীর উপরে অদৃশ্যভাবে উড়ে বেড়ায় রাত দিন। হুমা পাখি তুর্কি লোকসাহিত্যে বিশাল উচ্চতার প্রতীক। হুমা পাখির একই শরীরে পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রকৃতিই রয়েছে। প্রতিটি প্রকৃতির একটি ডানা এবং একটি পা রয়েছে। হুমাকে করুণাময় এবং ‘ভাগ্যের পাখি’ হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেহেতু এর ছায়া বা স্পর্শ শুভ বলে মনে করা হয়। হুমা পাখির প্রতিকৃতি আমরা দেখতে পেলাম পার্সেপোলিস এর ধ্বংসাবশেষ এর মাঝে।
সেমিনারের উদ্বোধনীর দিনে প্রধাণ অতিথির ভাষণ দিলেন একজন বোরখায় আবৃত মাঝ বয়সি সুশ্রী মহিলা। তিনি তখন ওখানকার গভর্নর। আমরা অবশ্য তার মুখটাই শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম। লম্বা বোরখা, পায়ের নিচে লুটিয়ে পড়ে, তাই বাঁ হাতে পুটলি করে ধরা, যাতে মাটিতে না পড়ে।
প্রধাণ অতিথির ভাষণ শুরু হলো ফার্সি ভাষাতে এবং যথারীতি আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম একজন ইন্টারপ্রেটর থাকবেন পার্টিসিপ্যান্টদের বোঝার সুবিধার জন্য। আমাদের অবাক করে দিয়ে ২-৩ মিনিট পরে ইংরেজিতে বিশুদ্ধ উচ্চারণে শুরু হলো তার স্পিচ। নির্ভুলভাবে তিনি বায়োটেকনোলজি এবং বায়োসেফটির উপরে বলে গেলেন অনেকটা সময় ধরে, কোনো কিছু না দেখে। মুগ্ধ হয়ে হয়ে শুনছিলাম তাঁর কথা, শুনছিল পুরো অডিয়্যান্স। স্পিচ শেষ হওয়ার পর করতালিতে ভরে গেল অডিটোরিয়াম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম তার সাথে কথা বলার জন্য, তাঁকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য।
ইরানে যাওয়ার আগে আমাদের ড্রেস কোড দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বোরখা বা হিজাব পড়তে হবে এমন বলেনি তবে ফুল হাতা, লং ড্রেস পরে থাকতে হবে যা হাঁটুর নিচে পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এবং মাথায় থাকতে হবে স্কার্ফ। সেই সাথে জানানো হলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বক্তারা এবং অংশগ্রহণকারীরা আসবেন, তারাও এই নিয়মের মধ্যেই পড়বেন। দুই সেট বোরখা জোগাড় করলাম। তেহরানে পৌছানোর আগে প্লেনের মধ্যেই সবাই বোরখা পড়ে নিল। আমিও তাই করলাম। আমার সাথে আর একটি মেয়ে ছিল। সে সাথে করে নিয়েছিল লম্বা হাতা, লম্বা সালোয়ার কামিজ এবং স্কার্ফ। দেখলাম ওকে কেউ কিছু বলছে না। ওরা পর্দাকে অতটা কঠিনভাবে পালন করে না মোটামুটিভাবে ঢাকা থাকলেই চলে। কিন্তু সরকারী আইন, তাই পর্দা ছাড়াও চলবে না।
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ ওদের দেয়া এই ড্রেস কোড সানন্দে মেনে নিয়েছেন। আমেরিকা থেকে আসা এক মহিলা বক্তা লম্বা কাপড় পরে এসেছেন। মাথায় স্কার্ফ। এক হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে কথা বলছেন আর অন্য হাতে মাথার স্কার্ফ সামলাচ্ছেন। বার বার পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠিয়ে মাথা ঢেকে নিচ্ছেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে যারা এসেছিলেন তারাও একই ভাবে পোষাক পরেছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ ভালো লাগছিল। বাইরে শহরে বেরিয়ে চারদিকে মহিলারা পর্দায় ঢাকা থাকাতে চোখ অহেতুক আহত হয় না, যেটা বেশির ভাগ উন্নত দেশগুলোতে হামেশাই হয়ে থাকে।
পরে লক্ষ্য করে দেখেছি, ইরানি মহিলারা দুই ধরণের বোরখা পরে থাকেন। কম বয়েসি মেয়েরা সাদা ল্যাবকোটের মত বোরখা পড়ে এবং মাথায় থাকে স্কার্ফ। যাদের বয়েস একটু বেশি তারা লম্বা বোরখা পড়েন যা মাটিতে লুটাতে থাকে এবং মাথা ভালোভাবে ঢাকা থাকে। এরা এক হাত দিয়ে লম্বা বোরখা পুটুলি করে ধরে রাখেন। অন্য হাত দিয়ে সমস্ত কাজ করেন। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়েদের এক হাত দিয়ে আমাদের শাড়ির আঁচল ধরে রাখার মত করে।
ইরানের নারীরা হাড়ে-মজ্জায় স্মার্ট এবং একই সাথে সুশ্রী। আমার খুব ভালো লাগছিলো এদের এত সুন্দর পার্টিসিপেশন দেখে। ইরানিদের বেশিরভাগ পেপার প্রেজেন্টেশনেই অগ্রগামী ছিলেন ইরানের মহিলারা। প্রশ্ন করা এবং প্রশ্নের উত্তর দেওয়াতে তাদের দক্ষতা দেখে অবাক হয়েছি। ইংরেজিও ভালো বলেন ইরানের মেয়েরা। আশঙ্কা ছিল, একটি গুরুগম্ভীর কনফারেন্স হতে যাচ্ছে ইরানে। হলো ঠিক তার উল্টো। আমার জীবনে অনেক কনফারেন্সে অংশগ্রহন করেছি, এটা ছিল ওয়ান অফ দি বেস্ট। এদের টেকনিক্যাল সেশন, পেপার প্রেজেন্টেশন, ক্যাটারিং বা খাবারের ব্যবস্থা, থাকার ব্যবস্থা, সবই ছিলো খুবই উন্নতমানের।
মাঝখানে একদিন পার্সেপোলিস দেখাতে নিয়ে গেল আমাদের। পার্সেপোলিস প্রাচীন ইরানের গৌরব এবং মহিমার প্রতীক এবং শিরাজের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রাচীন ইরানের পার্সেপোলিস এর বৃহৎ এলাকা এবং এর ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্ট ভবনগুলিকে বিশ্বের সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে গন্য করা হয়। তাই, সারা বিশ্বের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইরানে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন সময়ে পার্সেপোলিস পরিদর্শন করার জন্য।
পার্সেপোলিস ২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ইরানে আচেমেনিড রাজাদের একটি ধ্বংসাবশেষ। প্রাচীন ইরানে আচেমেনিড সাম্রাজ্যের মাহাত্ম্যের কারণে এটি বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে ছিল। পার্সেপোলিসে এইসব রাজাদের সদর দফতরের গৌরব উজ্জ্বল দিকটা বোঝা যায় এই ধ্বংসাবশেষ থেকে।
পার্সেপোলিসের যে বিষয়টি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো এই প্রাচীন শহরের ঐতিহাসিক প্রাচীনত্ব। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলের শিলালিপি এবং নিদর্শনগুলির যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করার মাধ্যমে প্রাচীন ইরানের সভ্যতার বিকাশের সন্ধান করেছেন। আচেমেনিড যুগের সামাজিক আইনগুলিও অনেক ইতিহাসবিদকে অবাক করেছিল।
দেখলাম, দেয়ালের গায়ে নিখুঁতভাবে খোদাই করা চিত্রকর্ম। বিশাল মূর্তি সহ প্রধান প্রবেশ পথ। হোমা পাখির প্রতিকৃতি, ইত্যাদি। অনেকখানি এলাকা জুড়ে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম। হাজার হাজার বছর আগেকার একদল সভ্য মানুষের কীর্তি দেখছি আমরা এ যুগে দাঁড়িয়ে, দেশ থেকে অনেক দূরে এসে। বোঝাই যায় এরা খুবই অরগানাইজড ছিলেন সে সময়। এদের শিল্প কর্মেও অনেক উন্নত ছিলেন এরা।
দুপুরের রোদে সবারই চেহারা মলিন হয়ে গিয়েছিল, ইরানিরা ছাড়া। লক্ষ করে দেখলাম প্রখর রোদেও ওদের চেহারা এতটুকুও মলিন হয়নি। সবার মাঝে ইরানিদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ছিলো। আমাদের গাইডদের মধ্যে একজন কম বয়েসী সুশ্রী তরুণও ছিল। তার ধূসর চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল সুরমার প্রলেপ পড়েছে তাতে। আমার সাথের ইরানী মেয়েগুলোর মুখটাই শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রচন্ড রোদ তাদের সৌন্দর্যের কোন মলিনতা আনতে পারেনি। ইরানিরা আসলেই সুন্দর।
আমাদের ৫ দিনের টেকনিক্যাল সেশন শেষ হয়ে যাবার পর বিকেলে এক ইরানি ভদ্রলোক জানালেন যে উনি শেখ সাদীর সমাধি দেখতে যাচ্ছেন, আমরা যেতে আগ্রহী কিনা। আমরা রাজি হয়ে গেলাম, যেন এর অপেক্ষাতেই ছিলাম। ভদ্রলোক থাকেন তেহরানে, শিরাজে এসেছেন কনফারেন্সে অংশগ্রহন করার জন্য। তাই শেখ সাদীর সমাধি দেখার ব্যাপারে তারও অনেক আগ্রহ। ছোটবেলা থেকেই যে মানুষটাকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছি তার সমাধিতে যাবার সুযোগটা আমার কাছে বিশেষ পাওয়া মনে হয়েছিল। শেখ সাদীর সমাধি দেখা আমার জীবনের একটি অনন্য ঘটনা। আমরা যখন তাঁর সমাধি কমপ্লেক্সে পৌঁছাই তখন বিকেল এবং সন্ধ্যার আলো আধারীর খেলা চলছে। না শীত না গরম। সুন্দর আবহাওয়া, সুন্দর পরিবেশ। সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা অনুভূতি।
শেখ সাদীর কবিখ্যাতি বিশ্বজোড়া। শেখ সাদীর প্রকৃত নাম শরফুদ্দীন। তাঁর ডাক নাম মসলেহউদ্দীন। সাদী ছিল তাঁর উপাধি। বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি সাদী নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু ও নৈতিকতা পরায়ণ একজন মানুষ। সাদী ছিলেন একাধারে কবি-সাহিত্যক-জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি একাধিক ভাষা জানতেন। ভ্রমণ করেছিলেন অনেক দেশ। শেখ সাদীর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল: গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ, করিমা, সাহাবিয়া, কাসায়েদে ফারসি, কাসায়েদে আরাবিয়া, গযলিয়াত, কুল্লিয়াত ইত্যাদি। গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ গ্রন্থের অনেক কথা আজ প্রবাদে পরিণত হয়েছে যা সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। শেখ সাদীর পোশাক এবং খাবারের গল্পটি আমরা পাঠ্য বইয়ে পড়েছি ছোটবেলায়। তাঁর আরও অনেক নীতি-গল্প শৈশবে শেখ সাদী সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছিল।
শেখ সাদীর মাজারে প্রচুর পর্যটকের ভিড় দেখলাম। এরা যে সবাই বিদেশি পর্যটক তা নয়। ইরানের নাগরিকরাও অনেকেই এসেছেন এখানে। জানা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শেখ সাদীর মাজারে এসেছিলেন ১৯৩২ সালে। মাজারে ঢোকার আগে খানিকটা পথ বাগানের ভিতর দিয়ে পেরিয়ে যেতে হয়। পথের দুই পাশে নয়ন তারার সারি। বেগুনী রঙের নয়ন তারা, যেটা ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের দেশে। খুব আপন মনে হলো- দেশের কথা মনে পড়ে গেল। সাদীর সমাধি ক্ষেত্র অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। সবুজ গম্বুজে ঢাকা শেখ সাদীর সমাধি দেখতে খুবই সুন্দর। দেয়ালের গায়ে তার কবিতা লেখা রয়েছে। সবচেয়ে অবাক করে এ জায়গার গাম্ভীর্য ও আধ্যাত্মিকতা। মনে হয় জীবন এখানে বিছিয়ে রেখেছে অপার শান্তি। মনে হয় এ অমর কবি-দার্শনিক-পণ্ডিত হয়তো এখনি জেগে উঠবেন।
মাজার ভবনটি ফার্সি শৈলীতে নির্মিত হয়েছিল। এতে সমাধির সামনের অংশে 8টি বাদামী পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। মূল নির্মাণ সাদা পাথর এবং টাইলস দিয়ে তৈরি। সমাধির আয়তন প্রায় ২৫৭ বর্গমিটার। সমাধির মূল ভবনটিতে দুটি সোপান রয়েছে যা একে অপরের সাথে লম্ব। সাদির সমাধিটি এই সোপানের কোণে অবস্থিত। সমাধির চারপাশে দেয়ালে রয়েছে সাদির কবিতার সাতটি স্তবক। ইরানের আরেক মহাকবি হাফিজ শিরাজী। পুরো নাম খাজা শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ হাফিজ শিরাজী। তিনি ৭১০-৭৩০ হিজরি সনের মধ্যে ইরানের শিরাজ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার সমাধিও শিরাজে। কিন্তু তাঁর সমাধি দেখার মত সময় করে উঠতে পারিনি আমরা।
শেখ সাদীর সমাধি দেখা শেষ করে আমরা শাহ চেরাগের মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এটি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের ফারস প্রদেশের রাজধানী শিরাজে অবস্থিত একটি ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্থাপনাটি মুসা আল-কাজিমের পুত্র সাইয়্যেদ আহমদের সমাধির চারপাশ ঘীরে গড়ে উঠেছে, যিনি স্থানীয় ঐতিহ্যে শাহ চেরাঘ অর্থাৎ আলোর রাজা, (King of the Light) নামে পরিচিত। এই ভবনটির নাম তার নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে। এই স্মৃতিস্তম্ভে সপ্তম ইমাম, মুসা আল-কাদিমের পুত্র আমির আহমদ, মীর মুহাম্মদ এবং অষ্টম ইমাম রেজা এর ভাইদের সমাধি রয়েছে। এই স্থাপনাটির প্রতিষ্ঠার গল্প এবং এর বিস্ময়কর সাজসজ্জা এটিকে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় তীর্থস্থানে পরিণত করেছে। যদিও দ্বাদশ শতাব্দীতে এই স্থানটিতে প্রথম একটি সমাধি নির্মাণ করা হয়েছিল, তবে বর্তমান কাঠামোর অধিকাংশই কাজার যুগের শেষের দিকে এবং ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সময় থেকে। মুগ্ধ হয়ে মাজারের কারুকাজ দেখছিলাম। এত সুন্দর আর উন্নত মানের কারুকাজ সহসা চোখে পড়ে না।
প্রচুর দেশি ও বিদেশি ভ্রমনকারী এসেছেন। শাহ চেরাগের মাজার দেখতে দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। সবার জন্য ওজু করার ও নামাজ আদায় করার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। আমরাও দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম আর শাহ চেরাগের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করলাম।
শিরাজ ইরানের অন্যতম প্রাচীন শহর। শিরাজ কবিতা ও মদের শহর হিসেবে পরিচিত। সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং প্রকৃতি এই সুন্দর শহরে একত্রিত হয়েছে। এটি তার আশ্চর্যজনক বাগান, ঐতিহাসিক আকর্ষণ এবং এর জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ দিয়ে প্রতিটি ভ্রমণকারীকে সন্তুষ্ট করে। এই আকর্ষণীয় শহর এবং প্রকৃতি এবং ইতিহাসের সাথে এর বন্ধনের প্রশংসা করার জন্য ইরানে ৫ই মে তারিখটিকে শিরাজ দিবসের নামকরণ করা হয়। অনেকেই ইরানের সবচাইতে স্মরণীয় শহর, সবচাইতে সুন্দর শহর হিসেবে শিরাজকে বেছে নিয়েছেন।
সমস্ত ছবি নেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
কভার ছবি শিরাজে পার্সেপোলিস এর একটি শিল্প কর্ম