সধবা নারীর মাথার সিঁদুর যে গাছে ফলে, তা জানার আগে চলুন একটি নামি বাসভবন ঘুরে আসি। এটি এক ফকিরের আস্তানা। সে ফকির ভোগের মাধ্যমে ত্যাগ করেন। তাঁর মনটি বৈরাগ্যের রঙে রাঙা। বিলাস-বৈভব ছেড়ে যে কোন মুহূর্তে চলে যেতে পারেন ঝোলা নিয়ে। কিন্তু শক্তি চাটুজ্জের সেই ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’!
এই বাসভবনের নাম ‘পঞ্চবটী’। যে ফকিরের বাসভবন, তিনি নামকরণে বিশেষ পারদর্শী। আমাদের দেশের যে সব সৌধ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফিরিঙ্গি বা মুসলমানি নাম যুক্ত আছে, সেগুলি তিনি পাল্টে দিয়ে নতুন নামকরণ করেন। এক্কেবারে ভারতীয় নাম। আরও বিশেষ করে বললে, হিন্দু নাম। ফকিরের রক্তে যেমন মিশে আছে রক্তের বদলে সিঁদুর, তেমনি মিশে আছে হিন্দু ঐতিহ্য।
‘পঞ্চবটী’ নামটাই দেখুন। রামায়ণে আছে তার কথা। বনবাসের সময়ে রামচন্দ্র গোদাবরী নদীর তীরে এই পঞ্চবটীতে (বর্তমানে নাসিক শহরের কাছে) বাস করেছিলেন। আমাদের এই ফকির রামভক্ত। একটি মসজিদকে ভেঙে তিনি রামের মন্দির তৈরি করে রামকে তাঁর বাসভবন ফিরিয়ে দিয়েছেন। রাম ও রামায়ণের অনুষঙ্গে তিনি তাঁর বাসভবনের নাম রেখেছেন ‘পঞ্চবটী’।
‘পঞ্চবটী’র ঠিকানা? দিল্লির ৭ নং লোককল্যাণ মার্গ (আগে এর নাম ছিল রেসকোর্স রোড — নামের সঙ্গে ফিরিঙ্গি গন্ধ ভরভর করে)। পাঁচ-পাঁচটি বাংলো নিয়ে গঠিত সে বিশাল এস্টেট। গাছ-গাছালি আছে, সবুজ বাগান আছে, ময়ূর আছে। রামচন্দ্রের যা ছিল না, তাও আছে। আছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। আছে দর্জি, নাপিত, ডিজাইনার, স্টাইলিস্ট, রাঁধুনি, মালি, ইলেকট্রিসিয়ান, গোয়েন্দা, প্র্হরী এবং আরও অনেক কিছু।
এই বাসভবনে ফকিরসাহেব উদযাপন করলেন পরিবেশ দিবস। গত ৫ই জুন। এখানে বলে রাখা ভালো যে আমাদের এই ফকিরবাবা একাধারে যেমন অঙ্কবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানবিদ, তেমনি তিনি পরিবেশবিদ। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে তিনি তাঁর ‘পঞ্চবটী’তে বৃক্ষরোপণ করলেন।
কি বৃক্ষ রোপণ করলেন তিনি?
সিঁদুর বৃক্ষ। তিনি উদাত্তকণ্ঠে বললেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন কচ্ছের মা ও বোনেরা। সম্প্রতি গুজরাট সফরের সময়ে তাঁরা আমাকে একটি সিঁদুর গাছ উপহার দিয়েছিলেন। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সেই গাছটি দিল্লিতে আমার বাসভবনে রোপণ করার সৌভাগ্য হল। এই গাছ নারীদের বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে থাকবে।’
সিঁদুর গাছ কি সত্যি আছে? মনে মনে সন্দেহ। তার পর খোঁজ-খবর করে জানলাম বিষুব অঞ্চলের এক জাতীয় গুল্মজাতীয় উদ্ভিদকে সিঁদুর গাছ বলে। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বিক্সা ওরেলানা’, ইংরেজি নাম ‘আন্নাত্তো’, আর হিন্দিতে একে বলে ‘সিঁদুর গাছ’। এই গাছের ফুলের রঙ সাদা ও গোলাপি। ফল হয় লাল রঙের আর তার বীজ থেকে তৈরি হয় প্রাকৃতিক লাল রঙ। মেয়েরা যে সিঁদুর পরেন, তার সঙ্গে এর সম্বন্ধ নেই অবশ্য।
কে বলল নেই ?
এই তো কদিন আগে আমাদের চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালিত হল তার নাম তো ‘অপারেশন সিঁদুর’। পাকিস্তানি জঙ্গিরা আমাদের হিন্দু নারীর সিঁথির সিঁদুর কেড়ে নিয়েছে বলে অপারেশনের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’।
সম্বন্ধ গড়ে দেবার জন্যই তো পরিবেশ দিবসে সিঁদুর গাছ লাগানো। শুধু কি তাই? গুজরাট সরকার জানিয়েছে যে ভারত –পাক সীমান্ত সংলগ্ন কচ্ছ জেলায় গড়ে তোলা হবে এক স্মৃতি উদ্যান, যার নাম হবে সিঁদুর বন’।
ফকিরবাবা ও তাঁর দল সিঁদুরটাকে প্রচারের হাতিয়ার করতে চান। পরিবেশ দিবসে লাগান সিঁদুর গাছ। যেন পরিবেশ রক্ষায় তাঁরা নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু কি বলছে ইণ্ডিয়া স্টেট অব ফরেস্ট (ISFR)? বলছে সারা ভারতে গাছের সংখ্যা মাত্র ২৪.৪৯%। ১০০ ভাগের মধ্যে ৬.৭৯ শতাংশ সবুজ এখনও বেঁচে আছে ভারতে। তার উপর ফকিরবাবার বন্ধু শিল্পপতিরা খনিজের লোভে আদিবাসী তাড়িয়ে বনাঞ্চল লোপাট করে দিচ্ছে ক্রমাগত।
পরিবেশ দিবসে ক্যামেরার সামনে বৃক্ষ রোপণ করলেও সেটা কি পরিবেশপ্রেম? কোন নিন্দুকও বলবে না সে কথা। অপারেশন সিঁদুরের একদিন পর থেকেই ফকিরবাবা বেরিয়ে পড়েছেন প্রচারে। সিঁদুরের প্রচার। তার মানে দলের প্রচার। তার মানে নিজের প্রচার।
সামরিক পোশাক পরা, হাতে হেলমেট নেওয়া ফকিরবাবাকে দেখে মনের ভেতরে উথলে ওঠে দেশপ্রেম। ভারত আমার, জননী আমার…।