সেই রকমেরই খবর। কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। পহেলগাঁওতে সন্ত্রাসী হামলার পরে গত ২৫ এপ্রিল নেহা X-এ তাঁর একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে বলেন যে সরকারের অবহেলার কারণে পহেলগাঁওতে এই রকম ঘটনা ঘটেছে। তাঁর অভিযোগ বিহারের ভোটে এটিকে কাজে লাগানো হয়েছে। ঘটনাচক্রে পাকিস্তানের কয়েকজন সাংবাদিক নেহার পোস্টকে পুনরায় তাঁদের X-এ পোস্ট করেন। ব্যাপারটা কি কাকতালীয়? অনেকে এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে নেহার পরোক্ষ যোগের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।
উত্তর প্রদেশের অভয়প্রতাপ সিং ভারতীয় ন্যায় সংহিতার (BNS) ১০টি ধারা ও তথ্যপ্রযুক্তির ৬৯এ ধারায় নেহার বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের করেছেন। তাঁকে ও তাঁর বাড়ির লোকজনকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভীত না হয়ে নেহা বলেছেন, ‘পহেলগাঁও’এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় সরকার এখনও পর্যন্ত কি করেছে? আমার বিরুদ্ধে এফ আই আর? যদি সাহস থাকে যান সন্ত্রাসীদের মাথা তুলে আনুন। আপনাদের ব্যর্থতার জন্য আমাকে দোষারোপ করার দরকার নেই… এটা গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে।’
শুধু তাই নয়। এই ঘটনা নিয়ে নেহা গান বেঁধেছেন — ‘চৌকিদার কায়ার বা’। সেই গানে তিনি ‘সাহেব’ সম্বোধন করে ভারতের প্রশাসনিক প্রধানকে বলেছেন : ‘সাহেব বউ-বেটিকে ধমকানো বন্ধ করুন। কথায় কথায় কেন এফ আই আর করেন? আমেরিকার নির্দেশে কেন হল সিজফায়ার? কেন বিশ্বের দরবারে নাক কাটা গেল ভারতের? সাহেব আমাকে গান গাইতে দাও … এটা তো লোকতন্ত্র … তাই গান গাওয়ার অধিকার আমার আছে … আমি আমজনতার একজন — কুর্সিতে যেমন বসাতে পারি, তেমনি সেখান থেকে টেনে নামাতেও পারি। আপনার ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি অন্য জায়গায় ফোলান, আপনার লাল লাল চোখ চিনকে দেখান …. বউ-বেটিকে ধমকানো বন্ধ করুন সাহেব।’
১৯৯৭ সালে বিহারের কৈমুর জেলায় নেহার জন্ম। মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। মা গৃহবধূ হলেও তাঁর গানের চর্চা ছিল। তিন ভাই বোনের মধ্যে নেহা সবচেয়ে ছোট। ২০১৮ সালে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। হিমাংশু সিং-এর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। হিমাংশু একজন লেখক। ২০১৯ থেকে নেহা মোবাইল ফোনে গান রেকর্ড করে তাঁর ফেসবুকে আপলোড শুরু করেন। ভোজপুরি কবি ভিখারি ঠাকুর ও মহেন্দ্র মিশি ছিলেন তাঁর প্রেরণা। ভোজপুরি গান গাইলেও নেহা প্রচলিত ধারাকে অনুসরণ করেন নি। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির নানা ঘটনা তাঁর গানের বিষয়বস্তু। প্রচলিত ভোজপুরি গানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ‘রুচিহীনতা’, তাই নেহার বাড়ির লোক তাঁর ভোজপুরি গানের চর্চায় আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা দেখলেন তাঁদের মেয়ে ভোজপুরি গানের স্রোতকে অন্যপথে পরিচালিত করছে।
২০২০ সাল। মার্চ মাস। লকডাউনের পর অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে যন্ত্রণাকাতর হয়ে উঠলেন নেহা। শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা প্রকাশ করার জন্য তিনি চালু করলেন নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল। ২০২০ সালের মে মাসে। অচিরেই বিপুল জনপ্রিয়তা। তারপর ২০২০ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে নেহার ইউটিউবে প্রকাশ পেল ‘বিহার মে কা বা’ অর্থাৎ ‘বিহারে হচ্ছেটা কি?’ গানটি।
কেন তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন? নেহার উত্তর, ‘কিসি তো কুছ করনা থা’ অর্থাৎ ‘কারও তো কিছু করা দরকার ছিল’। শাসককে প্রশ্ন করার কথাই বলতে চেয়েছেন নেহা। এটা তো গণতন্ত্রের হকের কথা। সেই প্রশ্ন প্রকাশ পেল ২০২২ সালে ‘ইউপি মে কা বা’, ২০২৩ সালে ‘এমপি মে কা বা’ এবং ‘ইউপি মে কা বা — সেশন-২’তে। নেহা বলেছেন, ‘ম্যায়ে কভি সোচা হি নেহি কি ম্যায়ে কেয়া হু লেকিন ম্যায়ে খুদ কো জানকভি মানতি হু’ অর্থাৎ ‘আমি নিজেকে কিভাবে লেবেল করব তা নিয়ে কখনও খুব বেশি ভাবি নি, তবে নিজেকে আমি জনগণের কবি হিসেবে মনে করি।’
নেহা প্রমাণ করেছেন যে গানের শক্তি আছে। তা জনজাগরণের কাজে সাহায্য করতে পারে। আমাদের মনে পড়ে যায় এস্তোনিয়ার SONG REVOLUTION কথা। আমাদের এই বাংলাও তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ তো রণসংগীত হয়ে উঠেছিল। রণসংগীত হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের অনেক গান। ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রেরণা দিয়েছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, নজরুল ইসলাম, মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল, শেখ গুমহানি প্রভৃতির গান। তারপরে এল গণসংগীতের ধারা। সে সব গানে শ্রেণিস্বার্থভোগীদের স্বরূপ উন্মোচন করে তাদের প্রশ্ন করা শুরু হল। গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে বাংলার গ্রাম ও শহরকে মাতিয়ে তুলেছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সুরেশ বিশ্বাস, সত্যেন সেন, সলিল চৌধুরী, কলিম শরাফির গণসংগীত।