পহেলগাঁও কাণ্ডের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে একটা উত্তপ্ত আবহ তৈরি হয়েই ছিল। তারই জেরে ভারত সামরিক অভিযান অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত জানিয়ে একের পর এক পাক জঙ্গিঘাঁটি যেমন ধ্বংস করে চলেছে পাশাপাশি ভারতীয় সেনার দাবি অনুযায়ী, ভারতের একের পর এক হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাকিস্তান। পাক হামলার পাল্টা অ্যাকশনে ভারতীয় সেনা ইসলামবাদ, লাহোর, পেশোয়ারে প্রত্যাঘাত করে ধ্বংস করে দিয়েছে পাকিস্তানের ডিফেন্স সিস্টেম। জলপথেও ভারত করাচি বন্দরে বড় হামলা চালিয়েছে, ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের ১৬ শহর, হামলা হয়েছে পাকিস্তানি সেনার ফ্রন্টিয়ার কর্পসের সদর দফতরেও। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে সরকার পঞ্জাবে ৩ দিনের জন্য স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিস্থিতি যাই হোক একটা কথা না বলে পারা যাচ্ছে না, মক ড্রিল হোক কিংবা যুদ্ধ শুরুর আগের যুদ্ধ হোক, এই পরিস্থিতি কিন্তু দুটি দেশের মানুষের তৈরি নয় মোটেও, যুদ্ধে মেতেছে দুটি রাষ্ট্রের সরকার। সেই যুদ্ধের ময়দানে ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো সাধারণ নাগরিক কিংবা কোনো পেশাদার মানুষ অথবা খেলোয়াড়, সিনেমার নায়ক-নায়িকা কেউ নেই। এই যুদ্ধ যদি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা কিংবা নাটকও হয় তাহলেও সেই রঙ্গমঞ্চে আছেন কেবল দুই দেশের শাসক ও সেনা প্রধানেরা। স্বভাবতই প্রশ্ন তাহলে এই পরিস্থিতি কেন তৈরি করা হল? এক কথার উত্তর, নাগরিকদের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে কাজ, কোনো কিছুই দিতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে বা নজর ঘোরাতে যুদ্ধই তো সেরা অস্ত্র, তাছাড়া কাশ্মীর ইস্যু তো বিরাট বালাই।
আমরা সবাই জানি, একটা যুদ্ধ লাগা যতটা সহজ, সেটা থামানো ঠিক ততটাই কঠিন বা রীতিমতো অসম্ভব একটা ব্যাপার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলা যায়, আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম, ইউক্রেন দুই সপ্তাহও টিকতে পারবে না। সেই লড়াই দেখতে দেখতে আড়াই বছর পেরিয়ে গেল, এখনও কোনো সমাধানের পথ পাওয়া গেল না। কাশ্মীরের পহেলগাঁওতে যে সন্ত্রাসবাদী অথবা জঙ্গি হামলা হয়েছে, তার তদন্ত ও বিচার অবিলম্বে হওয়া উচিত। কিন্তু অনেকগুলি দিন তো পেরিয়ে গেল। যারা হামলা করেছে, বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের তো কোমর ভেঙে দেওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে এমন হামলার কথা ভাবতে না পারে। পাশাপাশি এটাও বলতে হবে, যাদের ব্যর্থতায় এই হামলা হয়েছে, তাদেরও তো জবাবদিহি করতে হবে। সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষা সরকারের দায়িত্ব। দায়িত্বে ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটলে ব্যর্থতার দায় সরকারকে নিতেই হবে। কেন অমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বা ফাঁক ছিল? কীভাবে জঙ্গিরা এতটা দূর পর্যন্ত এসে মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যেতে পারলো? নাকি কাছাকাছিই ছিল তারা? তাহলেও প্রশ্ন কারা এরা, কোথায় কিভাবে নিরাপত্তার নজর এড়িয়ে ছিল? কেন এত দিন পরও তাদের গ্রেপ্তার করে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা গেল না? ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট কি ছিল? না থাকলে কেন ছিল না? আর থাকলে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে, উক্তিতেই তো দেশ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের কথাটি থাকে। এখন সেই সরকার উত্তর দিচ্ছে না কেন? এই সরকার তো মানুষকে কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করতে দেয় না উত্তর দেওয়া তো বহু দূরের ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমন পাকিস্তান আর কত দিন জঙ্গিদের অভয়ারণ্য থাকবে? কেন দুনিয়ার সব ওয়ান্টেড জঙ্গিদের ঠিকানা পাকিস্তান? এর উত্তর কিন্তু আজ পেতেই হবে কিন্তু ‘যুদ্ধ’, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, রাষ্ট্র নায়কদের যুদ্ধ, যা দারিদ্র মোচনের কিংবা বেকারত্ব ঘোচানোর যুদ্ধ কখনওই নয়, বরং দুর্নীতি আর অযোগ্যতা ও অক্ষমতা আড়াল করার যুদ্ধ তাই কখনই এই যুদ্ধ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
আমরা আশা করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার দেশের তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে। কিন্তু আমাদের সেই আশা দুরাশা হয়ে গিয়েছে কয়েক বছর আগেই কারণ, গত কয়েক বছর সরকারের অধিকাংশ পদক্ষেপই দেশে কেবল বেকারত্ব বাড়িয়েছে আর কর্মসংস্থান সংকোচনের হার বাড়িয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE)-র তথ্য অনুয়ায়ী, ২০২২-২৩ সালে বেকার যুবকদের সংখ্যা ছিল ৪৫.৪ শতাংশ। সরকার বেকারের হার কম দেখাতে ২০২৪ সালে দেশের অর্ধেকেরও বেশি পুরুষ এবং দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মহিলাকে ‘সেলফ এমপ্লয়েড’ বা স্ব-নিযুক্ত’ হিসাবে দেখায়। খুব সহজে বোঝা যায়, উপযুক্ত চাকরি খুঁজে না পাওয়ার ফলেই স্ব-নিযুক্তিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। তবে বহু অর্থনীতিবিদরা কিন্তু স্ব-নিযুক্তিকে ‘সবচেয়ে খারাপ’ কর্মসংস্থান বা কর্মসংস্থান হিসাবে বিবেচনাই করে না। একসময় অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট উদ্যোগগুলি বড় কর্পোরেট সংস্থার থেকেও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে না। গত ৭ বছরে জিএসটি সম্পর্কিত নিয়মগুলি অসংখ্যবার সংশোধন করায় ২৪ লক্ষ মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ (টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, হোম মেকার্স) সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যার ফলে ১.৩ কোটি শ্রমিক কাজ হারা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং আত্মহত্যার রিপোর্ট অনুসারে, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দেশে বেকারত্বের কারণে ১৫,৮৫১ জন আত্মহত্যা করেছেন।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী এ দেশের কৃষকদের মাসিক গড় আয় হল ১০,২১৮ টাকা বা তার চেয়েও কম। অর্থাৎ দৈনিক আয় হল ৩৪০ টাকার মতো। অন্যদিকে হিসাব জানাচ্ছে ২০২১ সালে শিল্পপতি গৌতম আদানির দৈনিক আয় ছিল ১৬১২ কোটি টাকা, অর্থাৎ মাসে তাঁর আয় ছিল ৪৮,৩৬০ কোটি টাকা। একদিকে এক চাষার দৈনিক আয় ৩৪০ টাকা আর এক দিকে এক শিল্পপতির আয় ১৬১২ কোটি। অর্থাৎ একজন চাষার থেকে ৪৭,৪১১,৭৬৫ গুণ বেশী আয় করেন শিল্পপতি। কেবল তিনিই নন, এদেশে এমন অনেক শিল্পপতি এবং কয়েকটি গোষ্ঠী আছে যারা এইভাবে বিপুল সম্পদ বলা ভাল দেশের প্রায় সব সম্পদই তালুবন্দি করে ফেলছে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছি আর মরছি। কিন্তু সর্বক্ষণ চারপাশে যে প্রবল উল্লাস, এই যেমন এখন যুদ্ধ… পাকিস্তানের সাত ডজন জঙ্গি ঘাঁটি নিকেশ, একের পর এক শহর ধূলিসাৎ ইত্যাদি প্রভৃতিতে সবই চাপা পড়বে বা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাছাড়া অন্যমত মানেই দেশদ্রোহী, অথবা পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু যুদ্ধের নায়ক যারা, পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্রের শাসক যারা তারা যুদ্ধ বাধিয়ে যুদ্ধ চালালেও উচ্ছিন্ন হবেন না, মরবেন না, পঙ্গুও হবেন না। মরবেন, উচ্ছিন্ন হবেন, যে বুদ্ধিমান, শিক্ষিত সাধারণ নাগরিক এই জঘন্য কুৎসিত যুদ্ধের উল্লাসে মেতে আছেন তারা। তা নাহলে সরকারকে আজ দেশের তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হত, যুদ্ধের অছিলায় তারা এত সহজে পার পেত না।