রবিমাসে রয়েছি আমরা এখন। বৈশাখ মাস পড়ল মানে রবিমাসের শুরু। পয়লা বৈশাখে প্রভাত ফেরি শুরু হয় সেই রবীন্দ্রগানে। সমাপ্তি ঘটে সেই রবির গানে। তবে ঠাকুর বাড়ির ওই একটি ঠাকুর নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকি সারা মাস, আবার মাস গড়িয়ে গোটা বছর। কিন্তু ঠাকুর বাড়িতে একটি হীরক খন্ড ছাড়াও অনেক মণি মানিক্য ছিল। যে মণি মানিক্যের ঝলকানি এখনও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগত জুড়ে রয়েছে। পলকাটা হীরের জৌলুস বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব যে কারিগর নিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়িতে, তিনিই রবির জ্যোতি অর্থাৎ জ্যোতিদাদা।
“সাহিত্যের শিক্ষায়, ভাবের চর্চায়, বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার প্রধান সহায় ছিলেন। তিনি নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিতে তাঁহার আনন্দ। আমি অবাধে তাঁহার সঙ্গে ভাবের ও জ্ঞানের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতাম — তিনি বালক বলিয়া আমাকে অবজ্ঞা করিতেন না।” রবীন্দ্রনাথ যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পরিবারে এমনিতেই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ছিল। সে ভাব প্রকাশ বা মতামত প্রকাশ যাই হোক না কেন। তবুও সেই ঠাকুর পরিবারের অনেক স্বাধীনতার মধ্যেও যিনি রবিকে আলাদা করে সমস্ত বিষয়ে উৎসাহ এবং স্বাধীনতা দিয়ে গেছিলেন তিনি রবির জ্যোতিদাদা।
বাল্মীকিপ্রতিভা ও কালমৃগয়া এই দুখানি রচনা অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে রচিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবির জ্যোতিদাদা, তখন প্রায় প্রতিদিনই সমস্ত দিন ধরে ওস্তাদি গানগুলো পিয়ানোতে সুর বসাতেন। কবির মতে — ‘গানগুলিকে পিয়ানোতে যথেচ্ছ ফেলিয়া মন্থন করা হইত।’ এরফলে ক্ষণে ক্ষণে রাগিনীগুলির অপূর্ব ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশ পেত। এই যে প্রথার বিরুদ্ধে সুর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা এটাতে রবীন্দ্রনাথ ছোট থেকেই অভ্যস্ত হতে পেরেছিলেন তাঁর জ্যোতিদাদার জন্যই। এর ফলস্বরূপ বাল্মীকিপ্রতিভার দুটি ডাকাতের মত্ততার গানে লেগেছে বিলাতি সুর এবং বনদেবীর বিলাপগানে বসেছে আইরিশ সুর।
রবির নাটকের প্রতি টান, নাটকের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলাতেও সেই জ্যোতিদাদার হাত। বাল্যকাল থেকেই কবির নাটকে অভিনয় করার প্রবল ঝোঁক ছিল। নাট্যমঞ্চে সর্ব সাধারণের সামনে তিনি আসেন জ্যোতিদাদার ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রহসনে। কবি এতে অলীকবাবু সেজেছিলেন। এটাই তাঁর জীবনের প্রথম অভিনয়। যৌবনের প্রাচুর্যে কবি লিখেছেন, অভিনয় করেছেন, গান গেয়েছেন অর্থাৎ উৎসাহে কখনো ভাটা পড়েনি। আর সেই উৎসাহে সবসময় ইন্ধন যুগিয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবির জ্যোতিদাদা।
যখন কবির বালক বয়স তখনও কবিকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছেন জ্যোতিদাদা। বালক রবিকে ঘোড়ায় তুলে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছেন, একবারও ভয় পাননি বা ভয় পেতেও দেননি রবিকে যে সে ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে পারে। এমনকি শিলাইদহে একবার খবর এল যে বাঘ বেরিয়েছে। জ্যোতিদাদা তখন বাঘ শিকারে বের হলেন, সঙ্গী সেই রবি। ছোট রবির হাতে একটা কঞ্চি থাকলেও রবির সুবিধা হত – এমনটিই রবির তখনকার ভাবনা ছিল বটে, কিন্তু তাতেও কঞ্চি ছাড়াই দাদার যথার্থ সহযোগী হয়ে তিনি বনে প্রবেশ করেছিলেন। এমনকি বনে প্রবেশের পূর্বে কেন যে তাঁর জ্যোতিদাদা জুতো পর্যন্ত খুলিয়ে প্রবেশ করিয়েছিলেন সে বোধ কবির বড় বয়সেও হয় নাই। আর আমরা তো বুঝতে পারবোই না যে বাঘ মারতে গিয়ে জুতোজোড়া কেন বনের বাইরে রাখা হয়েছিল। বোধকরি জুতোর আওয়াজ যাতে বাঘের কানে না যায় সেইজন্য অথবা বাঘ বনের রাজা আর রাজার সঙ্গে প্রজারা দেখা করতে গেলে জুতো তো খোলাই উচিত।
জ্যোতিদাদা মানেই ছিল রবির কাছে একটা হৈ হৈ ব্যাপার। শিকারে মাঝে মাঝেই যেতেন জ্যোতিদাদা। আর তাতে শিকারের শিকারটি ছাড়া বাকি আর যা আনুষঙ্গিক লাগে সবটা থাকত। যেমন বন্দুক, বেশ কিছু লোকজন, বসার সতরঞ্চি, আর নতুন বৌঠানের হাতে তৈরী লুচি, তরকারি এবং মিষ্টান্ন। শিকারে গিয়ে সর্ব প্রথম সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাদ্যের উপযুক্ত সদ্ব্যবহার হত। আর যেহেতু রক্তপাত একটি ভয়ানক ব্যাপার, তাই এই শিকার রক্তপাতহীনই থাকত। তাতে রবির মনও প্রশান্ত থাকত।
Exchange Gazette সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন দেখে একদিন ভর দুপুরে রবির জ্যোতিদাদা নিলামে গিয়ে পুরো সাত সাতটি হাজার টাকায় একটা জাহাজের খোল কিনে বাড়ি ফিরে খবরটা জানালেন। এরপর জাহাজের খোলে এঞ্জিন জুড়ে কামরা তৈরি করলে তবে একটা পুরো গোটা জাহাজ নির্মাণ হবে। বাঙালি লেখাপড়া করে, কলম পিষে কেরানি হয়, কিন্তু ব্যবসা চট করে করতে ভয় পায়। আর জাহাজ চালানোর কথা তো বাঙালি স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। রবির ধারণা সম্ভবত এই ক্ষোভ থেকেই তাঁর জ্যোতিদাদার এই জাহাজ কেনা। আসল কথা জ্যোতিদাদার অন্তর ছিল নানান উৎসাহে পরিপূর্ণ। নতুন কিছু করা নতুন কিছু গড়ার তাগিদ। যে উৎসাহ তিনি অনুজ রবির মধ্যে বপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
সেই জাহাজের খোল একদা ভরে উঠল বটে, তবে ঋণে ও সর্বনাশে। তবু রবির মনে হয়েছে যে জ্যোতিদাদার এই জাহাজ কেনার শুভটুকু দেশের খাতায় জমা পড়েছে, আর লোকসানটুকুর দায় একা জ্যোতিদাদা নিয়েছেন। কবি এখানে ব্যথিত চিত্তে যে উপমাটি টেনেছেন তা হল — নিষ্ফল অধ্যবসায়ের যে বন্যা বারবার আসে আবার হঠাৎ চলে যায়, তার ফলে স্তরে স্তরে যে পলি রেখে যায় তাতে দেশের মাটি উর্বরা হয়, তারপর ফসলের দিন ওই বন্যার কথা, পলিমাটির কথা কেউ মনে রাখে না। কিন্তু যাঁরা সমস্ত জীবন শুধু ক্ষতি বহন করতে পৃথিবীতে আসেন, তাঁরা এই ক্ষতি খুব সহজেই মেনে নিতে পারেন।
জাহাজের ক্ষতি দেখে রবি তাঁর জ্যোতিদাদাকে অনায়াসে ‘অব্যবসায়ী’ ‘ভাবুক’ বলে বুঝতে পেরেছেন। জ্যোতিদাদার ‘স্বদেশী’ নামক জাহাজের যাত্রীরা দিনের পর দিন বিনে পয়সায় যাতায়াত করতে লাগল এবং জ্যোতিদাদার জাহাজের কর্মচারীরা যাত্রী টানার অছিলায় বিনামূল্যে মিষ্টান্ন খাওয়াতে শুরু করলেন। ঋণ আরও বাড়ল। অবশেষে ‘স্বদেশী’র পরিপূর্ণ স্বখাত সলিলে ডুবে যাওয়ার খবর এল। জ্যোতিদাদার ব্যবসাও বন্ধ হল।
একের পর এক নাটক লিখেছেন। আবার যেই মঞ্চে উপস্থিত হলেন নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, অমনি মুহূর্তে সব ছেড়ে সরে আসেন — ‘গিরিশ চন্দ্র প্রবেশ করিয়াছে, আমার আর প্রয়োজন নাই’ বলে। অসংখ্য নাটক তিনি অনুবাদ করেছেন। মুদ্রারাক্ষস, চন্ডকৌশিক, মৃচ্ছকটিক, বেণীসংহার প্রভৃতি যেমন সংস্কৃত নাটক থেকে অনুবাদ করেছেন। তেমনই ফরাসি সাহিত্য থেকে মোপাসাঁ, জোলা, গোতিয়ের, বালজাক ইত্যাদির অনুবাদ করেন। এছাড়াও ছিল ইংরাজি ও মারাঠি ভাষার অনুবাদ। কখনো তিনি চন্দননগরে গঙ্গার ধারে, কখনো শিলাইদহের বোটে এঁকে দেন লালন সাঁইয়ের প্রতিকৃতি।
সাংঘাতিক প্রতিভাবান এই মানুষটির প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতিতে ছিল গভীর অনীহা। যেমন রবিরও ছিল। গুরুমশাই-এর বেত মারা থেকে তাঁর গোঁফজোড়া, এমনকি অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় গুরুমশাই-এর তেল মাখার দৃশ্য — সবেতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছিল প্রবল বিতৃষ্ণা। অভিনব রুচি, সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ, অদম্য উৎসাহ আর এক বিরহী অনুভবী মনের অধিকারী জ্যোতি পেলেন কাদম্বরীকে, যোগ্য সহধর্মিনী হিসাবে। রবিকে যেমন গড়েপিঠে নিয়েছিলেন, তেমনই রবিরই কাছাকাছি বয়সী কাদম্বরীকেও গড়েপিঠে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তুললেন জ্যোতিদাদা। কাদম্বরীর তেতলার ছাদবাগানে আসতেন অনেক গুণীজন। থাকতেন বন্ধু ও দেবর রবিও। সাহিত্য আলোচনার শেষে থাকত কাদম্বরীর হাতে তৈরি অভিনব মিষ্টান্ন।
কিন্তু যিনি tragic hero তাঁর ভাগ্যে কি সুখ সয়? অদ্ভুত অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ ষোল বছরের দাম্পত্য শেষ করে দিলেন কাদম্বরী। আত্মহত্যা করে ছিঁড়ে দিলেন রবির সঙ্গে বন্ধুত্বের সুতোটাকেও। ১৮৮৪ তে রবির মনে গভীরতম মৃত্যুর দাগ এঁকে বিদায় নিলেন কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে এই দাগ কতটা গভীর আমরা নিজেদের মতো করে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি মাত্র। কিন্তু এতে রবির জ্যোতিদাদা কতটা কষ্ট পেলেন সেকথা কেউ কোনোদিন জানতে পারলো না।
প্রতিকৃতি আঁকায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কোন মুখ দেখে মানুষটা কেমন, বুদ্ধিমান না নির্বোধ বলতে পারতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে বসে তাঁর প্রতিকৃতি এঁকেছেন জ্যোতিদাদা। সঞ্জীবনী সভা (হা ম চু পা মু হা ফ) স্থাপনের মাধ্যমে জাতির উন্নতিকল্পে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। ঠনঠনের কাছে এক পোড়োবাড়িতে বসত সভা। টেবিলে থাকত মড়ার খুলি (পরাধীন দেশের প্রতীক) খুলির চোখে জ্বলত মোমবাতি (জ্ঞানচক্ষু)।
এই জ্যোতিদানকারী মানুষটির জন্মদিন আজ (৪ মে ১৮৪৯)। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁকে ছেড়ে গেছে অনেক কিছু। আবার তিনি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন অনেক কিছু। স্ত্রী চলে যাবার পর থেকে তিনি নিজেকে নিজের মধ্যে গোটাতে শুরু করলেন। একা নিঃসঙ্গ জ্যোতিদাদা চলে গেলেন রাঁচির মোরাবাদি নামে এক ছোট্ট পাহাড়ে। সেখানে তৈরি করলেন ‘শান্তিধাম’। সঙ্গে থাকত রূপী নামে এক বাঁদর ও গোঞ্জু নামে কুকুর। জাগতিক সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ১৯২৫ এর ৪ মার্চ (২০ ফাল্গুন ১৩৩১) সন্ধ্যায় চলে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবি কবির জ্যোতিদাদা। যিনি না থাকলে রবিকিরণ হয়ত কিছু কম হত, বা হয়ত নয়। অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই সেই কারিগরকে।