আজ ৩০ এপ্রিল আমার জন্মভূমিসংলগ্ন অঞ্চল, কাঁথি ও দিঘায়, মন্দির রাজনীতির নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। দিঘায় উদ্বোধন করা হল পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি জগন্নাথ মন্দিরের। এই মন্দির তৈরির পরিকল্পনা মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় আসে ২০১৮ সালে। তখন তাঁর পাশে ছিলেন শিশির অধিকারী এবং তাঁর সুপুত্র শুভেন্দু অধিকারী। ২০ একর জায়গা নির্বাচন করা হয়েছিল। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হল জগন্নাথ মন্দির।
এর মধ্যে শুভেন্দু ও তাঁর পুজ্য পিতা দলবদল করেছেন। সনাতন হিন্দু হয়েছেন। তাই দিঘার জগন্নাথ মন্দিরকে সহ্য করতে পারছেন না। শুভেন্দু একই দিনে কাঁথিতে সনাতনী হিন্দুদের নিয়ে সভা ডেকেছেন। সেখানেও যজ্ঞ হবে। শুভেন্দু বলেছেন, দিঘায় জালি হিন্দুরা যাবে, কাঁথিতে আসবে আসল হিন্দুরা। কে জালি, কে আসল — তার নির্ণয় কে করবে, তা অবশ্য সনাতনী শুভেন্দু বলেন নি।
দিঘায় জগন্নাথ মন্দির করে মমতা ব্যানার্জী তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছেন নানাভাবে। প্রথমত, সংখ্যালঘু তোষণের তকমাটা ম্লান হবে। দ্বিতীয়ত, বিজেপির মধ্যে বিভাজনরেখাটা প্রকট হবে। শুভেন্দুর মতো আর কোন বিজেপি নেতা উচ্চকণ্ঠে গালমন্দ করতে পারছেন না এই ব্যাপারে। দিলীপ ঘোষ সস্ত্রীক মন্দির দর্শনে ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছেন, ভগবানকে নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। তৃতীয়ত, দিঘার জগন্না্থ মন্দিরে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকারের ঘোষণা করা হয়েছে। পুরীর মন্দিরে অ-হিন্দু ও বিদেশিদের প্রবেশ নিষেধ। এমন কি সে মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, বাবাসাহেব আম্বেদকর, ইন্দিরা গান্ধীকেও ঢুকতে দেওয়া হয় নি। দিঘার মন্দিরে মুসলমান ও খ্রিস্টানরাও ঢুকতে পারবেন। সুতরাং তাঁরাও বলতে পারবেন না যে মুখ্যমন্ত্রী হিন্দু তোষণের নামে তাঁদের অবজ্ঞা করছেন। এ যেন এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মেরে দেওয়া।
ভগবানকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বলে নাস্তিকেরা বিদ্রূপ করলেও তিনি মানুষকে কিছু কিছু পাইয়ে দেন। আর সেটাই হল মন্দিরের অথনীতি (Temple Economy)। এই তো কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মন্দির সম্মেলন ও প্রদর্শনীর (ITCX) একটা প্রতিবেদন পড়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ভারতের প্রতিনিধি বলেছিলেন যে ভারতের মন্দির অর্থনীতি ৬ লক্ষ কোটি টাকার এবং এটি ভারতের বৃহত্তম অর্থনৈতিক কার্যকলাপ। ভারত মন্দিরময়। তার মধ্যে ১৯ টি মন্দিরের বার্ষিক আ্য়-উপায়ের হিসেবটা এই রকম :
কেরালার পদ্মনাভস্বামী মন্দির — ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি, অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি বালাজি মন্দির — ৬৫০ কোটি, জম্মুর বৈষ্ণোদেবী মন্দির — ৫০০ কোটি, নাসিকের সিরডির সাই বাবা মন্দির — ৩২০-৪০০ কোটি, গুরুভায়রের শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির — ৫০০ কোটি, কেরালার সবরিমালা মন্দির, মুম্বাইএর সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির — ১২৫ কোটি, তামিলনাড়ুর মাদুরাই মীনাক্ষী মন্দির — ৬ কোটি, ওড়িশার শ্রী জগন্নাথ মন্দির — ১৫০ কোটি, বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির — ৬ কোটি, গুজরাটের সোমনাথ মন্দির — ১১ কোটি, কোলাপুরের মহালক্ষ্মী মন্দির — ১৪ কোটি, দিল্লির স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম মন্দির — ৬০-১০০ কোটি, কর্নাটকের কুক্কে সুব্রহ্মন্ন মন্দির — ৯০ কোটি, বিহারের মহাবোধি মন্দির — ১০৬ কোটি। আপশোশ, তালিকায় বাংলার নাম নেই। বাংলার ভগবানেরা বোধহয় তেমন বড়লোক নন। দেখা যাক দিঘার জগন্নাথ মন্দির কোন খেলা দেখাতে পারে কিনা !
খোঁজ-খবর করতে গিয়ে আরও তাজ্জব হয়ে গেলাম। মন্দির-অর্থনীতি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হয়েছে। যেমন রণজিৎ কুমার বিন্ধানির ‘টেম্পল ইকোনমি : আনভেইলিং দ্য মেজর কনট্রিবিউশন তো ইণ্ডিয়াজ জি ডি পি; যতীন এস ভাটিয়ার ‘টেম্পল ইকোনমি ইন ইণ্ডিয়া ড্রাইভিং লোকাল প্রসপারিটি অ্যাণ্ড ন্যাশনাল প্রগ্রেস’; এস ভার্মার ‘এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন থ্রু রিলিজিয়াস ট্যুরিজম’; ড. রণবীর সিংহের ‘দ্য কনট্রিবিউশন অব ইণ্ডিয়ান টেম্পলস ইন ইণ্ডিয়াজ ইকোনমি’ প্রভৃতি।
গবেষকরা মন্দির অর্থনীতিকে দুভাবে ভাগ করেছেন। প্রথম ভাগে আছে স্থানীয় উন্নয়নের প্রভাব (Ripple effect)। এই বিভাগে সংস্কৃতি সংরক্ষণ, ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকার সুযোগ, পরিকাঠামোর উন্নয়ন, সম্প্রদায়গত শিক্ষা-স্বাস্থ্য – সামাজিক সুবিধার ব্যবস্থা ইত্যাদি আছে।
দ্বিতীয়ভাগে ‘পিলগ্রিমেজ ট্যুরিজম’ বা তীর্থযাত্রীদের ভ্রমণের ফলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে পরিবহন, হোটেল, স্থানীয় ব্যবসা লাভবান হবে।
অধ্যাপক বিন্ধানি বলছেন, ‘Temples could contribute to the economic dimensions through their revenue streams, tourism impacts, and socio-economic initiatives, for which they have played a significant role in the development of the GDP of the country.’
ধর্মকে আপনি আফিং মনে করতে পারেন, ভগবানকে আপনি আমার মতো নাও মানতে পারেন, কিন্তু অর্থনৈতিক কার্যকলাপের দৃষ্টিকোণ থেকে মন্দিরের উপযোগিতা আপনাকে স্বীকার করতে হবে। মমতা ব্যানার্জী এই মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে যুগপৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের পথ প্রস্তুত করে নিতে চেয়েছেন।