স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষকে (২৫ এপ্রিল, ১৯২৫-১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) কেন্দ্র করে ২০২৫ সালে তাঁর নিজের শহর কৃষ্ণনগরে ‘মোহনকালী বিশ্বাস জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’ গঠিত হয়েছে। মোহনকালী বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে আরো বহুবিধ কর্মকাণ্ড এই শহরে হতে চলেছে। সেই সকল উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো একটি স্মারকগ্রন্থ নির্মাণ। ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্রভবনে তাঁর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ পেয়েছে। সম্পাদনায় দীপাঞ্জন দে। মোহনকালী বিশ্বাসের অনুরাগীবৃন্দের সহযোগিতা থাকলেও, মূলত তাঁর পরিবারের উদ্যোগেই এই গ্রন্থটি নির্মিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশক ‘মোহনকালী বিশ্বাস জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’। প্রায় আড়াইশো পাতার এই গ্রন্থটিকে স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাসের উপর একটি ডকুমেন্টেশন বলা চলে। তাঁর সম্পর্কিত বহুবিধ তথ্যের সংকলন এই গ্রন্থ। বেশ কিছু নথিপত্র, প্রচারপত্র, দুষ্প্রাপ্য পুস্তিকা, মোহনকালী বিশ্বাসের লেখা, তাঁকে নিয়ে লেখা, তাঁর সম্পূর্ণ জীবনপঞ্জি, বংশলতিকা, চিত্রাবলি ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের সমাহার এই গ্রন্থ।
নদিয়া জেলার অন্যতম স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস শুধু একজন বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ (শনিবার) কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্রভবনে মোহনকালী বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’টি সেখানেই প্রকাশ পায়। মোহনকালী বিশ্বাস জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বিকেল পাঁচটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন লেখক পার্শ্বনাথ রায়চৌধুরী। তাঁর হাত দিয়েই ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’-টির আবরণ উন্মোচিত হয়। সেই সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মোহনকালী বিশ্বাসের বড়োমেয়ে আলপনা বিশ্বাস বসু, গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক রামকৃষ্ণ দে ও স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক দীপাঞ্জন দে। মোহনকালী বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষকে মাথায় রেখে পারিবারিক উদ্যোগে তাঁর রচিত ‘স্বদেশী ডাকাতি (১৯০৮-১৯৩৮)’ এবং ‘নীল বিদ্রোহ দিগম্বর বিশ্বাস শহীদ বসন্ত বিশ্বাস’ গ্রন্থ দুটির দ্বিতীয় সংস্করণ এদিনের সভামঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায়। ‘স্বদেশী ডাকাতি’ (প্রকাশক সাহিত্যশ্রী) গ্রন্থটির আবরণ উন্মোচন করেন দীপাঞ্জন দে এবং ‘নীল বিদ্রোহ দিগম্বর বিশ্বাস শহীদ বসন্ত বিশ্বাস’ (প্রকাশক লোকসেবা শিবির) গ্রন্থটির আবরণ উন্মোচন করেন পবিত্রকুমার সরকার।
‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’ (ISBN: 978-93-92251-55-9)-টির বিন্যাস এইরূপ— বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর শুভেচ্ছাভিনন্দন দিয়ে গ্রন্থের সূচনা হয়েছে। মুখবন্ধ লিখেছেন সুপরিচিত বিজ্ঞান-লেখক অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন বরিষ্ঠ সাংবাদিক প্রবীরকুমার বসু, প্রকাশকের কথা লিখেছেন ‘মোহনকালী বিশ্বাস জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’-র আহ্বায়ক আলপনা বিশ্বাস বসু, প্রাক্-কথন লিখেছেন স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক দীপাঞ্জন দে। এরপর রয়েছে ‘স্মৃতিচারণ’ পর্ব, যেখানে মোহনকালী বিশ্বাসের পরিবার-পরিজনেরা তাঁদের স্মৃতি থেকে মোহনকালী বিশ্বাস সম্পর্কে বহুমূল্যবান কিছু কথা লিখেছেন। এই পর্বে রয়েছে আটটি নিবন্ধ ও একটি কবিতা। সেগুলি হলো— বহুমুখী প্রতিভায় আলোকিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী: প্রবীরকুমার বসু, কাকাবাবুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম: তারক সেন, গানের ভুবনে আমার বাবা: আলপনা বিশ্বাস বসু, শতবর্ষের আলোকে ড. মোহনকালী বিশ্বাস: চঞ্চল সরকার, প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে মোহনকালী বিশ্বাস: পার্শ্বনাথ রায়চৌধুরী, আমার বাবা ও বিশ্বাস পরিবার: হেমন্তকুমার বিশ্বাস, টুকরো কিছু স্মৃতি: রামকৃষ্ণ দে এবং আলোর পথযাত্রী: অন্বেষা বসু। এই পর্বে যে কবিতাটি রয়েছে সেটি হলো— স্মরণে-মননে-আত্মজাগরণে: পার্থসখা অধিকারী। এর পরে রয়েছে ‘উজ্জ্বল-উদ্ধার’ পর্ব, যেখানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত মোহনকালী বিশ্বাসের নির্বাচিত কয়েকটি লেখা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। সেই লেখাগুলি হলো— নীলবিদ্রোহের রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গনে, নেদের-পাড়া: ইতিহাস ও ঐতিহ্য, শহীদ অনন্তহরি মিত্র, জবার বদলে ছিন্নশির (শহীদ অনন্তহরির ফাঁসি এবং অতঃপর), নেতাজীর অন্তিম অন্তর্ধান রহস্য: ড. মোহনকালী বিশ্বাস এবং বিদ্যাসাগর ও ব্রজনাথ। এছাড়া ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া’ গ্রন্থে একজন স্বাধীনতা-সংগ্রামী হিসেবে মোহনকালী বিশ্বাসের সচিত্র পরিচিতি এখানে মুদ্রিত হয়েছে।
এরপরে রয়েছে ‘প্রয়াণলেখ’ পর্ব। এই পর্বে মোহনকালী বিশ্বাসের প্রয়াণের পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি যথাসম্ভব সংগ্রহ করে সূত্র-সহযোগে একত্রে সংকলিত হয়েছে। প্রতিবেদনগুলি হলো যথাক্রমে— প্রয়াত মোহনকালী বিশ্বাস অসামান্য প্রতিভার বর্ণালী: সিদ্ধার্থ পাল (‘বঙ্গরত্ন’ পত্রিকা), বহুমুখী প্রতিভার আলোয় আলোকিত ড. মোহনকালী বিশ্বাস: সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস (‘কৃষ্ণনগর এ.ভি. স্কুল পত্রিকা— দীপশিখা’), বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জননেতার জীবনাবসান (‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকা), স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস প্রয়াত (‘নদীয়া দর্পণ’ পত্রিকা), আমার চোখে সমাজসেবী মোহনকালী বিশ্বাস: রঘুবীর দে (‘বঙ্গরত্ন’ পত্রিকা) এবং সাংবাদিকতা ও সমাজসেবাই ছিল মোহনকালী বিশ্বাসের জীবনের ব্রত (‘গ্রাম গ্রামান্তর’ পত্রিকা)। স্মারকগ্রন্থটি সংকলনে মোহনকালী বিশ্বাসের পরিবার বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। গ্রন্থের অলঙ্করণ ও মুদ্রণে গেটওয়ে গ্রাফিক্স (হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা)। নামাঙ্কন করেছেন সৌরভ ধর জয় (বাংলাদেশ), গ্রন্থসজ্জা দীপাঞ্জন দে ও প্রচ্ছদ করেছেন তন্ময় ধর। ‘মোহনকালী বিশ্বাস জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’-র পক্ষ থেকে আহ্বায়ক আলপনা বিশ্বাস বসু কর্তৃক কৃষ্ণনগর, নদিয়া থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকাল ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রি.। হার্ড বাইন্ডিং, মুদ্রিত মূল্য সাড়ে পাঁচশো টাকা।
‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’-এর পরিশিষ্ট অংশটির কথা বিশেষকরে বলতে হয়। সংখ্যায়নের ভিত্তিতে এই অংশটি সাজানো হয়েছে, যেখানে ২৩টি পর্ব রয়েছে। পরিশিষ্ট-১: স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীবর্ষে মোহনকালী বিশ্বাসকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তাম্রপত্র। পরিশিষ্ট-২: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পিএইচ.ডি. উপাধি অর্জন (১৯৯৩ সাল)। পরিশিষ্ট-৩: মোহনকালী বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষের আমন্ত্রণপত্র। পরিশিষ্ট-৪: মোহনকালী বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানসূচি। পরিশিষ্ট-৫: মোহনকালী বিশ্বাস রচিত ‘স্বদেশী ডাকাতি (১৯০৮-১৯৩৮)’ গ্রন্থে সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের লেখা ভূমিকা। পরিশিষ্ট-৬: মোহনকালী বিশ্বাস রচিত ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অবক্ষয়ের কারণ’ গবেষণাগ্রন্থের উপক্রমণিকা। পরিশিষ্ট-৭: ‘নীলবিদ্রোহ দিগম্বর বিশ্বাস শহীদ বসন্ত বিশ্বাস’ গ্রন্থের সূচনায় লিপিবদ্ধ শহিদ বসন্ত বিশ্বাস সম্পর্কে লেখকের ইংরেজি নিবন্ধ। পরিশিষ্ট-৮: ড. মোহনকালী বিশ্বাস রচিত ‘নীলবিদ্রোহ দিগম্বর বিশ্বাস শহীদ বসন্ত বিশ্বাস’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ। পরিশিষ্ট-৯: নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন (কৃষ্ণনগর শাখা) কর্তৃক গবেষণাকর্মে সাফল্যের জন্য সংবর্ধনা। পরিশিষ্ট-১০: নেতাজী সুভাষ জন্মোৎসব কমিটি (হাঁসখালি ব্লক, বগুলা) কর্তৃক প্রদত্ত মানপত্র। পরিশিষ্ট-১১: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে চাঁদেরঘাট ‘যুব সংস্থা’-র সভ্যবৃন্দ কর্তৃক সংবর্ধনা (১৯৯৭ সাল)। পরিশিষ্ট-১২: মোহনকালী বিশ্বাসের প্রয়াণে ‘অন্যবাক্’ পত্রিকাগোষ্ঠীর শোক-প্রস্তাব। পরিশিষ্ট-১৩: নদিয়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘নদিয়া জেলা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা সমিতি’ গঠিত হয়েছিল। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস (১৯৭২-১৯৭৩ সাল)। পরিশিষ্ট-১৪: মোহনকালী বিশ্বাস রচিত গবেষণাগ্রন্থ এই বিষয়েই তিনি ডক্টরেট উপাধি অর্জন করেন (২০১৭ সালে প্রকাশিত)। পরিশিষ্ট-১৫: মোহনকালী বিশ্বাসের ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অবক্ষয়ের কারণ’ গ্রন্থে মুদ্রিত তাঁর লেখক পরিচিতি। পরিশিষ্ট-১৬: বঙ্গীয় পুরাণ পরিষদ (শান্তিপুর) কর্তৃক মোহনকালী বিশ্বাসকে প্রদত্ত উপাধি-মানপত্র। পরিশিষ্ট-১৭: ‘নদীয়া ও বিভূতিভূষণ’ গ্রন্থে মোহনকালী বিশ্বাসের লেখা ভূমিকা। পরিশিষ্ট-১৮: মোহনকালী বিশ্বাস রচিত গ্রন্থ ‘নাবালকের ফাঁসি’। এটি শহিদ বসন্তকুমার বিশ্বাসের উপর লেখা প্রথম জীবনীগ্রন্থ (১৯৯০ সাল)। পরিশিষ্ট-১৯: মোহনকালী বিশ্বাস রচিত ‘নাবালকের ফাঁসি’ গ্রন্থের ভূমিকা। পরিশিষ্ট-২০: মোহনকালী বিশ্বাস রচিত শহিদ বসন্তকুমার বিশ্বাসের সংক্ষিপ্ত জীবনী সংকলিত একটি প্রচারপত্র। তরুণ বিশ্বাস (বাদকুল্লা, নদিয়া) কর্তৃক প্রকাশিত। পরিশিষ্ট-২১: স্বাধীনতা সংগ্রামী ড. মোহনকালী বিশ্বাস জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি। পরিশিষ্ট-২২: চারণকবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে মোহনকালী বিশ্বাসের শ্রদ্ধাঞ্জলি। এবং পরিশিষ্ট-২৩: ভারত সরকারের ওয়েবসাইটে মোহনকালী বিশ্বাস সম্পর্কিত তথ্য।
গ্রন্থের পরিশিষ্ট পর্বটির পরে সংকলিত হয়েছে মোহনকালী বিশ্বাসের সম্পূর্ণ জীবনপঞ্জি, যেখানে তাঁর চুরাশি বছরের দীর্ঘ কর্মমুখর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলি সাল-তারিখ-সহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর পরে মুদ্রিত হয়েছে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত সংগৃহীত তাঁর পরিবারের বংশলতিকা। গ্রন্থের সবশেষে রয়েছে চিত্রাবলি অংশটি, যেখানে স্বাধীনতা-সংগ্রামী, সংগীতশিল্পী, লেখক, সমাজকর্মী প্রভৃতি বহুবিধ ভূমিকায় মোহনকালী বিশ্বাসকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। চিত্রাবলি পর্বে ২৫টি নির্বাচিত মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য-চিত্র মুদ্রিত হয়েছে। জন্মশতবর্ষে এই নির্মাণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা-স্মরণ এই দুর্বিষহ সময়ে সমাজের বিভিন্ন মহলে বন্দিত হচ্ছে দেখে আমরা আনন্দিত।
লেখক: সম্পাদক, ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ’।