রবিবার | ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:২৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
একটু রসুন, রসুনের কথা শুনুন : রিঙ্কি সামন্ত ১২ বছর পর আরামবাগে শোলার মালা পরিয়ে বন্ধুত্বের সয়লা উৎসব জমজমাট : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কোনিয়াকদের সঙ্গে দু’দিন : নন্দিনী অধিকারী স্বচ্ছ মসলিনের অধরা ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস বাড়বে গরম, চোখের নানান সমস্যা থেকে সাবধান : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী আঠালো মাটি ফুঁড়ে জন্মানো শৈশব : আনন্দগোপাল হালদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত ওয়াকফ হিংসার জের কি মুর্শিদাবাদেই থেমে গিয়েছে : তপন মল্লিক চৌধুরী এক বাগদি মেয়ের লড়াই : দিলীপ মজুমদার এই সেনসরশিপের পিছনে কি মতাদর্শ থাকতে পারে : কল্পনা পাণ্ডে শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গায়ন’ থেকেই গাজন শব্দের সৃষ্টি : অসিত দাস কালাপুষ্প : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হোক বাঙালি-অস্মিতার প্রচারযাত্রা : দিলীপ মজুমদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত পেজফোর-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩২ প্রকাশিত হল সিন্ধিভাষায় দ্রাবিড় শব্দের ব্যবহার : অসিত দাস সিন্ধুসভ্যতার জীবজগতের গতিপ্রকৃতির মোটিফ : অসিত দাস হনুমান জয়ন্তীতে নিবেদন করুন ভগবানের প্রিয় নৈবেদ্য : রিঙ্কি সামন্ত গল্প লেখার গল্প : হাসান আজিজুল হক ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (শেষ পর্ব) : জমিল সৈয়দ চড়কপূজা কি আসলে ছিল চণ্ডকপূজা : অসিত দাস অরুণাচলের আপাতিনি : নন্দিনী অধিকারী ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (সপ্তম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শাহরিয়ার কবিরকে মুক্তি দিন : লুৎফর রহমান রিটন ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (ষষ্ঠ পর্ব) : জমিল সৈয়দ ওয়াকফ সংশোধনী আইন এই সরকারের চরম মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ : তপন মল্লিক চৌধুরী ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (পঞ্চম পর্ব) : জমিল সৈয়দ যশোধরা — এক উপেক্ষিতা নারীর বিবর্তন আখ্যান : সসীমকুমার বাড়ৈ কলকাতার কাঁচাভেড়া-খেকো ফকির ও গড়ের মাঠ : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

স্বচ্ছ মসলিনের অধরা ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস

অসিত দাস / ৮১ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

‘মসলিন’ শব্দটি আমাদের ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে। কোথা থেকে যে এসেছে এই ম-অশালীন শব্দটি, তা বুঝতে হিমসিম খেতে হয়। মসলিন শাড়ির কথা সকলেই জানেন।

ঢাকাই মসলিন কাপড় তৈরি হতো বর্তমান বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত পানাম নগরের গ্রামগুলোতে। মসলিন কাপড় বয়নের দক্ষ কারিগররা এই কাপড়কে ঘিরেই তৎকালীন বৃহৎ ব্যবসায়িক কেন্দ্র পানাম নগর গড়ে তোলেন। এই কাপড়ের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ব্যবহারকারী ছিলেন মুঘল শাসকরা। কথিত আছে, একটি ছোট আংটির ভেতর দিয়ে মসলিনের পুরো একটি কাপড় চলে যেত। ১৮৫১ সালে বিলেতে প্রদর্শিত আধ টুকরো (১০ গজ) মসলিন কাপড়ের ওজন মাত্র ৮ তোলা ছিল। ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত মসলিন কাপড়ের ওজন ৭ তোলা। সুতোর ওপর নির্ভর করে মূলত কাপড়ের মান নির্ধারণ হতো। যে সুতো যত সূক্ষ্ম সে সুতোর তৈরি কাপড়ও ছিল তত মিহি আর কদরও ছিল বেশি। মিশরীয় প্রাচীন সভ্যতার মমিগুলোর গায়ে মসলিন কাপড় পাওয়া গেছে। এমনকি রোমান নারীরাও মসলিন কাপড় খুব পছন্দ করতেন বলে জানা যায়।

ঢাকাই মসলিন বললে মসলিনকে তাই এক ডাকে চেনা যায়। বস্তুত উৎকৃষ্টমানের মসলিন তৈরি হত ব্রহ্মপুত্রতীরে উৎপন্ন ফুটি কার্পাসের সুতোয়। মসলিনশিল্প যে অবলুপ্ত হয়েছিল একসময়, তা সকলেই জানে। বাজার অর্থনীতির যে গ্যাঁড়াকলে পড়ে মসলিন তৈরি বন্ধ করে তাঁতিরা, তাও আমাদের জানা। দেশীয় তাঁতবস্ত্রে বিপুল পরিমাণ কর চাপিয়ে, বিলেত থেকে আমদানিকৃত বস্ত্রে অত্যন্ত কম শুল্ক রেখে অত্যাচারী ইংরেজ শাসক তাঁতিদের বাধ্য করে লোকসান-কবলিত মসলিন আর না বুনতে। অনেকের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হয় যাতে তারা আর মসলিন শাড়ি বয়ন করতে না পারে। তবে হাতের বুড়ো আঙুল ইংরেজরা কেটেছিল, না প্রতিবাদস্বরূপ তাঁতিরা নিজেরাই কেটেছিল, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। দুটি মতের পক্ষেই জোরালো যুক্তি আছে।

মসলিন অবলুপ্ত হল, কিন্তু মসলিন শব্দটি থেকে গেল। তবে জামদানি শাড়িকে মসলিনের রকমফের বা উত্তরসূরী বলা যায়।

এই মসলিন শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালাভাষার অভিধানে আছে, [(মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত) মোসল > ফ্রেঞ্চ. মোসসেলিন > মসলিন]। অর্থ, কোমল সূক্ষ্ণ কার্পাসবস্ত্রবিশেষ।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। মসলিন শব্দটিকে বিশেষ্য ধরে তিনি ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন, [ সং মসৃণ > মসৃন(?) > মসলিন]। মসলিন বিশেষ্যপদ হলেও মসৃণ কিন্তু বিশেষণ।

তবে বঙ্গীয় শব্দকোষের পরিশিষ্টে প্রচলিত ব্যুৎপত্তিটিও দেওয়া হয়েছে। লেখা হয়েছে, [Mosul (the city on the Tigris) > Mousseline > মসলিন। Babylonian name for muslin ‘sindhu’ (exported from Sindh)। অর্থ, সূক্ষ্ণ বস্ত্রবিশেষ।

সংসদ বাংলা অভিধানে এই দু’টি ব্যুৎপত্তিই আছে, নতুন কিছু বলা হয়নি।

বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান লিখেছে, [মসৃণ > মসলিন]। ব্রহ্মপুত্রতীরবর্তী অঞ্চলে উৎপন্ন ফুটি কার্পাস থেকে যে এই মসলিন তৈরি হত, তাও জানানো হয়েছে।

সুবলচন্দ্র মিত্রর ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’-এ মসলিন শব্দটিই নেই। নেই রাজশেখর বসুর চলন্তিকা-তেও। কেন নেই, সেটাই বিস্মিত করে পাঠকদের। মসলিনকে পরিত্যাগ করেছে উক্ত অভিধানদু’টি।

নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ জানাচ্ছে, — ‘ইংরাজ বণিকগণ মাদ্রাজপ্রেসিডেন্সীর মছলীপত্তন-বন্দর হইতে মসলিন লইয়া যাইতেন’। তাই মছলী বা মসলী বা অপভ্রংশ মসলিয়া থেকে মসলিন আসতে পারে বলে লিখেছেন তিনি। যদিও ইরাকের টাইগ্রিসতীরবর্তী মোসল বন্দরের প্রসঙ্গও রেখেছেন। তবে মসৃণ থেকে মসলিনের বন্ধুর পথে তিনি হাঁটেননি।

মসলিন শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে ভাষাবিদরা স্পষ্টতই দু’ভাগ। একদল যখন মোসল-নগরের কথা বলেছেন, একদল সংস্কৃত বা তৎসম মসৃণ থেকে মসলিন আসার কথা বলে গেছেন। যদিও মোসল বন্দরের মসলিনের কথা বিশ্ববাসীকে সর্বপ্রথম জানিয়েছিলেন দুই সাহেব, এস. সি বার্নেল ও হেনরি ইউল, তাঁদের লেখা হবসন-জবসন অভিধানে। স্বভাবতই তাঁরা বাংলার তাঁত ও তাঁতিদের উপেক্ষা করেছেন। মসলিন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছেন পশ্চিম এশিয়ার মোসল বন্দরকে, সোনারগাঁওকে নয়।

মসলিন শব্দটির আর কোনও ব্যুৎপত্তি হয় কিনা ভাবতে শুরু করলাম। হাতের কাছে থাকা অভিধানই ভরসা। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হল আর কোনও ব্যুৎপত্তি আছে কিনা।

বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ একটি শব্দ আছে, মসিল। মসিল (মসীল) শব্দটির অর্থ পীড়ন ও পেয়াদা। আরবি থেকে শব্দটি বাংলায় এসেছে। পীড়ন করা, পেয়াদা লাগানো-র মত লব্জের উল্লেখও আছে এই অভিধানে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানেও আছে মসীল শব্দটি। মানে জুলুম, উৎপীড়ন। ‘মসীল করিবে রাজা দিয়ে হাথে দড়ি’, — কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্য থেকে উদ্ধৃতিও তিনি দিয়েছেন। তাহলে কি এই সূক্ষ্ণ কার্পাসবস্ত্রের প্রস্তুতকারক তাঁতিদের উপর ইংরেজ পেয়াদাদের উৎপীড়ন ও অত্যাচারের সাক্ষ্য দিচ্ছে এই ‘মসলিন’ শব্দটি? মসিল > মসিলি > মসিলিন > মসলিন, এই পথেই কি এসেছে মসলিন? এই পেয়াদাদের নেতৃত্বেই কি কেটে নেওয়া হয়েছিল মসলিন-তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল?

মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অভিধান’-এ ‘মসলন্দি’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে, ‘রাজকীয় জাঁক-জমকপূর্ণ’। মসলিন বস্ত্র বিশেষ প্রিয় ছিল দিল্লির মুঘল রাজদরবারের মহিলামহলে। সম্রাট ঔরঙ্গজেব যে স্ত্রী নূরজাহানকে না কন্যা জেব-উন্নেসাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন তেমন কিছু না পরে থাকার জন্যে, তা মসলিনের গৌরবগাথারই পরিচায়ক। এতই সূক্ষ্ণ ছিল সেই খাস-মসলিন যে রমণীদের দেহসৌষ্ঠবও দৃষ্টিগোচর হত। কন্যারত্নটি পরে কী পরিধান করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন, তা জানা যায় না অবশ্য। যদিও এটি ঐতিহাসিক তথ্য না নাট্যকার ব্রজেন দে-র সংযোজন, তা জানি না। শুধু মুঘল রাজদরবার নয়, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলিতেও মসলিনের বিরাট কদর ছিল। ফরাসি সম্রাঞ্জীদের মসলিনের পোশাকপরিহিত নয়নাভিরাম ছবি এখনও বিভিন্ন সংগ্রহশালায় দেখা যায়। সম্প্রতি ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামে গিয়ে স্বচক্ষে তা দেখেছি। রাজকীয় মহিমায় একদা উদ্ভাসিত ছিল মসলিন। জাঁকজমকে, আড়ম্বরে কোনও শাড়িই এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না। তাই ‘মসলন্দি’ শব্দটি থেকে আসতে পারে মসলিন শব্দটি।

মসলন্দি > মসলন্নি > মসলনি > মসলিন।

শব্দের বিবর্তন তো এভাবেই হয়। অর্থাৎ মসলিন শব্দটি নবাবি বাংলার তথা দিল্লির ও অন্যান্য রাজদরবারে বাংলার তাঁতিদের তৈরি সূক্ষ্ণ কার্পাসবস্ত্রের প্রশংসা ও সমাদরের বাহক।

আসলে দেড়শো বছর আগে অবলুপ্ত মসলিন-শিল্প অনেকগুলি প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায়। আবার কি পুনরুজ্জীবিত করা যাবে বাংলার গর্ব এই মসলিনকে? মসলিন-বয়ন যে বংশপরম্পরায় বয়ে চলা একটি সাধনা, তা সকলেই জানে। দেড়শো বছরের পরিসরে সেই পরম্পরা নষ্ট হয়ে গেছে। হাতের আঙুলের যে সূক্ষ্ণ কাজে তৈরি হত এই অপরূপ বস্ত্রসম্ভার, তা কি আর কেউ শেখাতে পারবে? মিসিং লিংকটা ধরাবে কে? তবুও চেষ্টা চলছে দু’বঙ্গেই। পরীক্ষামূলক মসলিন-নির্মাণ সফল হয়েছে। এবার দেখা যাক মসলিন শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের মত মুঘল ও নবাবি আমলের মসলিন-গরিমা ফিরিয়ে আনা যায় কিনা।

পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়, মসলিন শব্দটিকে ‘মসৃণ’ শব্দজাত ভেবে আমাদের ভাষাতাত্ত্বিকরা বিশেষ্য-বিশেষণের বিশেষ ধার ধারেননি। মসৃণ যখন বিশেষণ, মসলিন নিখাদ বিশেষ্য। ভাষাবিজ্ঞানে সেটা কতটা শাস্ত্রসম্মত, তা অবশ্য জানি না।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন