কলকাতা থাকতেই আলী আকবর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন রাজস্থানের এক গায়িকা রাজদুলারি খাঁ কে। অসাধারণ গান গাইতেন তিনি। কলকাতায় পাম অ্যাভিনিউতে তার সঙ্গে থাকতেন। সেখানে তাঁদের চার সন্তান হয়। বড়মেয়ে লাজবন্তি, তারপর দুই ছেলে রাজেশ ও দীনেশ, শেষের নাম অনিশা। তারা এখন কেউই ভারতে থাকেন না, সবাই বিদেশে। আকবরের দুই স্ত্রীর মধ্যে যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল।
কলকাতা থাকতে থাকতেই আলী আকবর আমন্ত্রিত হয়ে চলে যান আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে। রবিশঙ্করের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসন, বেহালাবাদক লর্ড ইহুদি মেনুইনের খুবই বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধু রবিশঙ্করের মাধ্যমে আলী আকবরের পৃথিবী বিখ্যাত এইসব সঙ্গীতজ্ঞদের আলাপ হয়। এরা দুজনেই খুব ভালবাসতেন আকবরকে। ইহুদি মেনুইন আকবরকে ডাকতেন বা পরিচয় করাতেন ‘ইন্ডিয়ান বাখ’ (বাখ ছিলেন ওয়েস্টার্নার ঘরানার এক প্রবাদ প্রতিম পিয়ানো বাদক)। পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকে আকবর দেশ বিদেশ করতে থাকেন।
আকবর প্রথমে ১৯৫৫ সালে বেহালাবাদক ইয়েহুদি মেনুহিনের আমন্ত্রণে আমেরিকায় আসেন এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি সান্তা ক্রুজের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের একজন সহকারী অধ্যাপক ছিলেন।
১৯৫৬ সালে খান ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত শেখানো এবং প্রসারের লক্ষ্যে হরিশ মুখার্জি রোডে আলী আকবর স্কুল অফ মিউজিক তৈরি করেন। কলকাতায় তখন তার বাবার ছাত্র হিসেবে নিখিল বন্দোপাধ্যায়, মহাপুরুষ মিশ্র প্রমুখ ছিলেন। এনারাই এই স্কুল চালানোর দায়িত্ব নেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে একই নামে আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরে এটি ক্যালিফোর্নিয়ার সান রাফায়েলে স্থানান্তরিত হয়।
আমেরিকা যাওয়ার আগে আকবর এখানে মুম্বাই ও কলকাতার বেশ কিছু সিনেমাতে সঙ্গীত দেন। তার মধ্যে নবকেতন মুভিজের (চেতন আনন্দের) আন্ধিয়াঁ ছিল অন্যতম। এরপর হামসাফার ছবিতেও তিনি সুর দেন। দেবানন্দ এবং চেতনা আনন্দের সঙ্গে আলী আকবরের গভীর বন্ধুত্ব ছিল এদের সূত্র ধরেই লতা মঙ্গেসকার ও আশা ভোঁসলের সঙ্গে আকবরের সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। জীবনে প্রায় শেষের দিকে আশা ভোঁসলেকে দিয়ে তিনি নিজে তার সংগ্রহের বেশ কিছু বন্দিশ রেকর্ড করান। লতা মঙ্গেশকর “হর কাহিঁ পে শাদমনি” শিরোনামের গানটি গেয়েছিলেন এবং সরোদ বাদকের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কোনও পারিশ্রমিক নেননি।
বাংলা চলচ্চিত্রের বেশ কিছু ছবিতে তিনি সুর দিয়েছিলেন। অরূপ গুহঠাকুরতার ‘বেনারসি’ ছবিতে তিনিও রুমা গুহঠাকুরতার কন্ঠে ঠুংরিও তুলিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের দেবীতেও তিনি মিউজিক দেন। তবে দেবী ছবিতে সত্যজিত রায়ের সঙ্গে কাজ করে আলি আকবর খুব খুশী হননি। বিজয়া রায় একবার একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে লিখছেন যে সত্যজিতবাবু রবিশঙ্কর, আলি আকবর এবং বিলায়েতকে দিয়ে তাঁর ছবিতে সুর দেবার পর কোনো কারণে সমস্ত ব্যাপারটাতেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেষে নিজেই নিজের ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করতে শুরু করেন। ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে। আকবর ‘রাজদ্রোহী’ ছবিতেও অসাধারণ সুর দিয়েছিলেন। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি যে তিনটি গান এই ছবিতে গাইয়েয়েছেন তা অনবদ্য।
দেখা গেছে, ক্লাসিকাল সঙ্গীতের শিল্পীরা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার দিকে খুব একটা যাননা — যদিও যাঁরা মাঝে মধ্যে ওদিকে গেছেন তাঁরা অসাধারণ সুর দিয়েছেন। হয়তো শাস্ত্রমতে ভালো সুর দিলেও তাঁরা জনপ্রিয় সুর দিতে পারেননা, বা মুখ্য পরিচালকের অধীনস্থ থাকাটা তাঁদের সৃষ্টিকর্মে ব্যাঘাত ঘটায় বা অন্য কিছু।
তবে তপন সিংহের ছবিতে সুর দিয়ে তিনি যেরকম আনন্দ পেয়েছেন, তার অন্য পরিচিতদের কাছে পাননি। ক্ষুধিত পাষাণ, ‘ঝিন্দের বন্দি’ এই দুটি ছবিতেই তিনি কি রকম উঁচু মানের সঙ্গীত ব্যবহার করেছেন তা আমরা সবাই জানি। যার জন্য তিনি “বর্ষসেরা সঙ্গীতশিল্পী” পুরস্কার জিতেছিলেন।এই কথার জেরেই বলি, আকবরের পুত্র আশিষ খাঁ ও তপনবাবুর দুটি ছবি ‘জতুগৃহ’ ও ‘আদমি আউর আওরাত’ ছবিতে সুর দিয়েছেন। সীমা ছবিতে শঙ্কর জয়কিশনের সঙ্গীতে তিনি একটি গানের জন্য সরোদও বাজিয়েছিলেন। তিনি বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চির ‘লিটল বুদ্ধ’র জন্য কিছু সঙ্গীত পরিবেশন করেন ।
১৯৪৫ সালে খান বোম্বের হিজ মাস্টার্স ভয়েস স্টুডিওতে ৭৮ আরপিএম ডিস্কের একটি সিরিজ (যা প্রায় তিন মিনিটের সঙ্গীত রেকর্ড করতে পারে) রেকর্ডিং শুরু করেন। এরকম একটি রেকর্ডের জন্য তিনি চারটি সান্ধ্য রাগ — মালকোষ, চন্দ্রকোষ, নন্দকোষ ও কৌশিকানাড়া-র উপর ভিত্তি করে দুটি নতুন রচনা রাগ চন্দ্রনন্দন (“মুনস্ট্রাক”), গৌরীমঞ্জরী তৈরি করেছিলেন। বিদেশী লেবেলে এটিই প্রথম ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পীর বড়ো করে আত্মপ্রকাশ।
এই রেকর্ডটি ভারতে একটি বিশাল সাফল্য অর্জন করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে চন্দ্রনন্দন রাগটি ২২ মিনিট দৈর্ঘ্যে পুনরায় রেকর্ড করা হলে সারা পৃথিবী জুড়ে এই রাগটির নিজস্ব শ্রোতা তৈরি হয়।
এছাড়াও আকবর শিবরঞ্জনী ও যোগিয়া কালাংড়া সৃষ্টি করেন।
ইহুদি মেনুইন আকবর ও রবিশঙ্কর কে দিয়ে প্রথম রেকর্ড করান। সেই রাগের নাম ছিল সিন্ধু ভৈরবী। তবলায় ছিলেন চন্দ্রকান্ত, তানপুরায় ছিলেন শিরীষ। পৃথিবীর বিখ্যাত এঞ্জেল রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ডটি যখন বের হয়, তখন সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে যায়। লালে লাল হয়ে যায় রেকর্ড কোম্পানিটিও।
রবিশংকর, নিখিল ব্যানার্জী ও বেহালাবাদক এল. সুব্রামানিয়ামের সাথে আলি আকবরের অসংখ্য যুগলবন্দী রয়েছে, যেগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিলায়াৎ খানের সাথেও তাঁর কিছু যুগলবন্দী রয়েছে। পাশ্চাত্যের সঙ্গীতকারদের সাথেও তিনি যৌথ কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের অগাষ্ট মাসে আলি আকবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে রবিশংকর, আল্লারাখা, কমলা চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে ম্যাডিসন স্ক্যোয়ার গার্ডেনে সঙ্গীত পরিবেশবন করেন। কনসার্টে অন্যান্য সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন এবং রিঙ্গো স্টার। কনসার্টটির একটি লাইভ অ্যালবাম ও একটি চলচ্চিত্র পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়।
১৯৮৯ সালে খানকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা, পদ্মবিভূষণ প্রদান করা হয়। পাঁচবার গ্র্যামি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত খান ম্যাকআর্থার ফেলোশিপ এবং ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর দ্য আর্টসের ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপেরও প্রাপক ছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ যিনি তথাকথিত “প্রতিভা অনুদান” লাভ করেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, ইন্ডিয়া পোস্ট তাঁর অবদানের স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
খান তার জীবনের শেষ চার দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি ২০০৪ সাল থেকে ডায়ালাইসিসের রোগী ছিলেন। ১৮ জুন ২০০৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান আনসেলমোতে তার বাড়িতে কিডনি বিকল হয়ে তিনি ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।
আকবরের সঙ্গে রবিশঙ্করের সুন্দর সম্পর্কটি ভেঙে যায় কারণ আকবরের বোন অন্নপূর্ণার সঙ্গে রবি শংকরের বিচ্ছেদ এবং তা নিয়ে পরিবারে নানান অবাঞ্ছিত ঘটনা। সেই সময় জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায় অন্নপূর্ণার। অসম্ভব জেদি ও নিয়মশৃঙ্খলাপরায়ন অন্নপূর্ণা দেবী রবিশঙ্করের কাছ থেকে অসম্ভব আঘাত পেয়েছিলেন জীবনে। আকবর শেষের দিকে আশা করতেন কখনো দুই বন্ধুর আবার মিলন হবে। যদিও সে আশা পূরণ হয়নি কারণ ইচ্ছা থাকলেও রবিশঙ্কর আর অসুস্থ আকবরের কাছে গিয়ে উঠতে পারেনি। দুই বন্ধুর এই অপূর্ণ ইচ্ছার মাঝে চিরবিদায় নেন মাইহার ঘরানার এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। উস্তাদ আলি আকবর খানের সঙ্গীত ভারতের তামাম মার্গসঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।