শনিবার | ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
বাড়বে গরম, চোখের নানান সমস্যা থেকে সাবধান : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী আঠালো মাটি ফুঁড়ে জন্মানো শৈশব : আনন্দগোপাল হালদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত ওয়াকফ হিংসার জের কি মুর্শিদাবাদেই থেমে গিয়েছে : তপন মল্লিক চৌধুরী এক বাগদি মেয়ের লড়াই : দিলীপ মজুমদার এই সেনসরশিপের পিছনে কি মতাদর্শ থাকতে পারে : কল্পনা পাণ্ডে শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গায়ন’ থেকেই গাজন শব্দের সৃষ্টি : অসিত দাস কালাপুষ্প : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হোক বাঙালি-অস্মিতার প্রচারযাত্রা : দিলীপ মজুমদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত পেজফোর-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩২ প্রকাশিত হল সিন্ধিভাষায় দ্রাবিড় শব্দের ব্যবহার : অসিত দাস সিন্ধুসভ্যতার জীবজগতের গতিপ্রকৃতির মোটিফ : অসিত দাস হনুমান জয়ন্তীতে নিবেদন করুন ভগবানের প্রিয় নৈবেদ্য : রিঙ্কি সামন্ত গল্প লেখার গল্প : হাসান আজিজুল হক ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (শেষ পর্ব) : জমিল সৈয়দ চড়কপূজা কি আসলে ছিল চণ্ডকপূজা : অসিত দাস অরুণাচলের আপাতিনি : নন্দিনী অধিকারী ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (সপ্তম পর্ব) : জমিল সৈয়দ শাহরিয়ার কবিরকে মুক্তি দিন : লুৎফর রহমান রিটন ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (ষষ্ঠ পর্ব) : জমিল সৈয়দ ওয়াকফ সংশোধনী আইন এই সরকারের চরম মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ : তপন মল্লিক চৌধুরী ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (পঞ্চম পর্ব) : জমিল সৈয়দ যশোধরা — এক উপেক্ষিতা নারীর বিবর্তন আখ্যান : সসীমকুমার বাড়ৈ কলকাতার কাঁচাভেড়া-খেকো ফকির ও গড়ের মাঠ : অসিত দাস ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (চতুর্থ পর্ব) : জমিল সৈয়দ রামনবমী পালন এবং হুগলী চুঁচুড়ার শ্রীরামমন্দির : রিঙ্কি সামন্ত ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (তৃতীয় পর্ব) : জমিল সৈয়দ মিয়ানমারে ভূমিকম্প — প্রতিবেশী দেশের জনগণের পাশে বাংলাদেশ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ১৪১ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

অনেকদিন পর আমার গ্রামে এলাম গাজনের মেলা দেখতে। নদীর সেই উঁচু বাঁধটায় এলাম। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ, নদী মুখ। ওই যে দূরে টালির ঘরটা দেখা যায় ওটা আমার স্কুল, বয়সের ভারে সে এখন ন্যুব্জ। পাশে মাথা তুলেছে তিনতলা ঝাঁ চকচকে পাকাবাড়ি। তার ঠিক আগে যে ঝাঁকরা গাছটা দেখা যাচ্ছে ওটা অশ্বত্থ গাছ, পীরসাহেবের থান, আর এই যে কাছের জঙ্গলটা — হাত বাড়ালে বন্ধু, ওটা শ্মশান। শ্মশানের এই দিকটা খ্যাঁড়েগোড়ার বিল। আমাদের গ্রামের ভাগার বলে পরিচিত। আবার গোচারণ ভূমিও বলতে পারা যায়। এই দিকটা আদাশিমলার বিল। ওই যে দূরে মাটির বাঁধটা দেখা যাচ্ছে, ওটা রামপুরার বাঁধ। আমাদের গ্রামের শেষ সীমানা। ওই বাঁধে বাঁধে একটু এগোলেই গঙ্গাকোন। আমাদের এই নদী আর কেলেঘাই নদীর মিলন স্থল। আর ওই যে দূরে একটা বাঁশের ওপর একটা পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছ — ওটা বীরকটার শিবমন্দির। ওর পোশাকি নাম ছাতারকল।

আমাদের এই গ্রামে দু-টো শিবমন্দির। একটা বীরকটার শিবমন্দির আর একটা কুলাশনির শিবমন্দির। একটা গ্রামের পূব দিকে আর একটা গ্রামের পশ্চিমদিকে। কুলাশনির শিবমন্দিরের সামনেই শ্মশান আর আছে একটা বিশাল ঝিল। মাঝে মাঝে আমি একাএকা ওখানে গিয়ে বসি। কতো পাখি আসে ওই ঝিলে। আমি বসে বসে দেখি। চারিদিকে গাছ গাছ আর গাছ। ঘনো জঙ্গলে ভর্তি। লোকে ভয়ে এই পাশে আসে না। বলে এখানে নাকি ভূতেরা নাচানাচি করে। আমি বহু দিন একাএকা এইখানে এসে বসেছি। কিন্তু ভূত দেখতে পাইনি। তাই আমাকে অনেকে ডাক সাইটে ভূতের স্যাঙ্গাত বলেও ডাকে।

তখন আমার পাঁচ বছর বয়স। বর্ষার সময় ঠান্ডা লেগে ধূম জ্বর। গ্রামে তখন অমূল্যদাদু ছিলেন একমাত্র কোয়াক ডাক্তার। তাতেই গ্রামের লোকেরা বত্তে যেত। কাকা অমূল্যদাদুকে অমূল্যকাকা বলে ডাকত। আবঝা আবঝা কাকার সেই কথা মনে পরে যায়। কাকা দাদুকে বলেছিল — ওর বাপ গেছে, মা গেছে যে কোন শর্তে ওকে তোমায় বাঁচিয়ে তুলতে হবে। আমি ওকে কিছুতেই হারাতে চাই না।

অমূল্যদাদু আমাদের বাড়িতে পরপর তিনদিন ছিল। আমার মাথায় ধারা দেওয়া হয়েছিল, জ্বর নামানোর জন্য। গ্রাম শুদ্ধ লোক উপচে পড়েছিল সেইকটা দিন। যে যেমন ভাবে পেরেছিল কাকাকে এসে সাহায্য করেছিল। আমি যেন গ্রামের সম্পদ, কাকার একলার নয়।

জ্বর সেরে যাবার পর। কাক আমাকে পীরবাবার থানে নিয়ে গেল। আমাকে বললো প্রণাম কর। তোর বাপ এখানে পীরবাবাকে দেখেছিল। তারপর আমাকে নিয়ে গেল, বীরকটার শিব মন্দিরে। গ্রামের লোকেরা বলে বুড়োশিবের থান। এর মাটি গায়ে মাখলে নাকি শরীর খারাপ হয় না। কাকা আমাকে মাটি মাখিয়ে মন্দিরের সামনে ঝিলের জলে স্নান করিয়ে পূজো দিল। সত্যি বলতে কি তারপর থেকে আমার সেই ভাবে কোন শরীর খারাপ হয়নি।

সেই দিন প্রথম কাকার চোখে জল দেখেছিলাম। বাবার নাম ধরে বার বার বলেছিল এ কি গুরুদায়িত্ব তুই আমাকে দিয়ে গেলি। বাবা শিব আমি ওকে তেমার পায়ে রাখলাম। আজ থেকে ওর বাঁচা মরা তোমার ওপর নির্ভর। তুমি যা ভাল বুঝবে করবে।

আমার ছোট্ট শরীরটাকে বুকে জরিয়ে ধরে কাকা হাপুস নয়নে কেঁদেছিল।

দুই

এই পুকুরটার নাম দুধ পুকুর। বছরে দুটো সময় এই মন্দিরকে ঘিরে এই অঞ্চলটা জনারণ্যে পরিণত হয়। এখানে একটা মলা বসে। সেখানে ঘর-গ্রেহস্থলির সব জিনিষ পাওয়া যায়। মাটির হাঁড়ি, খাবরি থেকে সংসারের যাবতীয় জিনিষ। কত দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে শিবের কাছে নিজের মনস্কামনা জানাতে আসে। শিবরাত্রির উৎসবটা সেরকম একটা হয় না। তবে গাজন উৎসবটা বেশ জমজমাট।

চৈত্র মাসে এখানে গাজন হয়। সন্ন্যাসীরা একমাসের উপবাস ভাঙে নীলষষ্ঠীর দিন। যারা সন্ন্যাস নেয় তারা ওই দিন এই মন্দিরে পূজো দিয়ে তাদের একমাসের সন্ন্যাস জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। সেদিন সবচেয়ে ভিআইপি মানুষ সেই সব সন্ন্যাসীরা। গ্রামের মনুষরা সন্ন্যাসীদের ভক্তা বলে। এই সন্ন্যাসীরা সবাই দুধ পুকুরে স্নান করে শিবের মন্দিরে এসে পূজো দেয়। তখন মন্দিরে জাত ধর্মের কনো ভেদাভেদ থাকে না।

যারা সন্ন্যাস নেয় তারা কিন্তু সবাই যে ব্রাহ্মণ তা নয়। নীচু জাতের লোকই সবচেয়ে বেশি করে সন্ন্যাস নেয়। ধর্মের অনুশাসন এখনো এখানে আছে। কিন্তু ওই কয়দিনের জন্য কোন অনুশাসন নেই। ভারি অবাক লাগে ওই সময়টা। যাদের আমরা সারাটা বছর নীচু জাত বলে নাক সিঁটকই, তারাই তখন সকলের প্রণম্য ব্যক্তি। সেই নীচুজাতের মানুষগুলোকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার জন্য হুটোপুটি লেগে যায়। কারণ তারা সন্ন্যসী। ওই কয়েকটা দিন তাদের কঠোর কৃচ্ছ সাধনায় সবাই মনে করে তারা শিবের অংশবিশেষে পরিণত হয়েছে।

কি অদ্ভুত আমাদের এই ধর্মের অনুশাসন।

অমরনাথের গল্প অনেকেরই জানা আছে তবু বলি—শুনেছি দূর্গাপূজোর পর ওখানে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যাধিক ঠান্ডা পরে যায়। তারপর আবার শ্রাবণী পূর্ণিমায় যাওয়ার রাস্তা খোলে। ওই দিনটা শিবের জন্মদিন। কিন্তু মন্দিরের দরজা খোলার পর যিনি প্রথম পূজা দেন তিনি নাকি একজন মুসলমান।

গল্পটা যখন প্রথম শুনলাম বেশ অবাক লেগেছিল।

জানার চেষ্টা করলাম কেন এই অনুশাসন। দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা কিন্তু বেশ পন্ডিত মানুষ। কেউ কিন্তু আমার মন মতো উত্তর দিতে পারলো না। সব কেমন ভাষা ভাষা। কমবেশি সবাই বললেন একজন মুসলমান মেষপালক নাকি প্রথম অমরনাথের শিবলিঙ্গ দর্শন করেছিলেন। বলতে পারা যায় তিনিই অমরনাথের আবিষ্কর্তা। যেহেতু ঈশ্বর তাঁকে প্রথম দেখা দিয়েছেন। তাই তার হাত দিয়েই প্রথম ঈশ্বরকে ভোগ অর্পন করা হবে। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন এই রীতি ছিল। তারপর থেকে সেটা প্রচলিত রীতির রূপ ধারণ করলো। তিনি এখন বেঁচে নেই হয়তো তবে তাদের পরিবারের কেউ হয়তো প্রথম পূজোটা দেয়।

মাঝে মাঝে আমার মাথায় কেমন যেন ঘুরঘুরে পোকা নড়ে ওঠে। একবার যেটা মাথায় ঢোকে তার সমাধান না করা পর্যন্ত মনে মনে শান্তি পাই না। এই বিষয়টা নিয়ে লেগে পরলাম। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। আমাদের দেবতাদের মধ্যে তিন ক্ষমতাবান মক্কেল। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তিনজনেই নমস্য ব্যক্তি।

একটু ভালকরে লক্ষ্য করলে দেখা যেবে মহেশ্বর মানে শিবকে ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে। সে ছোটজাত, বড়োজাত, মধ্যজাত, নীচুজাত যতো রকমের জাত আছে। বিষ্ণুকে তুমি শিবের মতো সবার ঘরে ঘরে পাবে না। যাদের একটু পয়সা-গড়ি আছে বলতে পারো অবস্থাপন্ন গেরস্থ তাদের ঘরে পাওয়া যাবে। শিব যেমন মাঠে ঘাটে গড়া গড়ি খায়, বিষ্ণু তেমনি শোকেশে বন্দি। নারায়ণ বলে কথা।

আর ব্রহ্মা। এনার পূজো আদৌ হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে শুনেছি রাজস্থানের আজমীরে পুষ্কর বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে নাকি ব্রহ্মার একটা মন্দির আছে। শিবের মন্দিরে কোন জাতিভেদ নেই। কিন্তু বিষ্ণুমন্দিরে অনেক আইন কানুন, অনেক বাধ্য বাধকতা। ধর্মীয় অনুশাসনের বহর সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ ভারতে গেলে এটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যাবে।

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় — দেবতাদের মধ্যেও শ্রমিক মালিক সম্পর্ক আছে। আমার মতে শিব হচ্ছে কম্যুনিস্ট, আর বিষ্ণু হচ্ছে ক্যাপিটেলিস্ট।

তিন

গাজনের সময় এখানে দশদিন ধরে মেলা চলে। যাত্রা, কবিগান, জলসা হয় আরও অনেক কিছু হয়। কিন্তু ভক্তাদের আগুন ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ দেখার জন্য এতো ভিড় হয় কল্পনা করা যায় না। এখানকার কমিটির লোকেরা ভিড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যায়।

সেই সময় সবাই মজা করে ভক্তাদের কাঁটা ঝাঁপ, আগুন ঝাঁপ দেখে। তখন সেই সব সন্ন্যাসীদের এক একজনকে মনে হয় সবে মাত্র স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। এক একজন টপ ক্লাসের ম্যাজিসিয়ান। তারা যেন সব ভিন গ্রহের বাসিন্দা। ভোজবাজিতে ওস্তাদ।

এই দুধ পুকুরে সকলে স্নানকরে শুদ্ধ হয়। তারপর তাদের দোলায় করে কাঁধে চাপিয়ে মন্দিরের সামনে নিয়ে আসা হয়। সেই দোলায় কাঁধ দেবার জন্য হুরোহুরি পরে যায়। সন্ন্যাসীদের কাঁধে চাপাতে পারলে পুন্যার্জন হবে। কি অদ্ভূত বিধি ব্যবস্থা। এই দীঘির চারপাশে সারাবছর পানা হয়ে থাকে। পরিষ্কার হয়না। বছরে একবার পরিষ্কার হয়। গাজনের সময় কাজে লাগে।

ছোট সময় এইসব ভোজবাজি ব্যাপারটা অতো বুঝতাম না। একটু বড়ো হতেই মাথার মধ্যে তেলাপোকা নরতো। এটা কেন? সেটা কেন? উত্তর খোঁজার জন্য গুণীন কাকার পেছন ধরতাম। বুড়ো বড়ো তেঁয়েটে। কিছু বলতো, বাকিটা কিছুতেই বলতো না। হ্যাট হ্যাট করে গরুখেদানর মতো খেদিয়ে দিত। তখন নিজের মতো করে উত্তর খুঁজে নিতাম।

যেখানে আগুন ঝাঁপ হয়। তার চারপাশে মোটা করে এই পুকুরের পানা ফেলে রাখা হয়। আগুন ঝাঁপের জায়গাটা পনেরো-কুড়ি ফুট লম্বা হয়। চওড়া পাঁচ ফুট। কাঠ কয়লা জ্বালানো হয়। তাও আবার যে সে কাঠ নয়, বেল কাঠ। আগুনটা গণগণে করা হয় কুলোর হাওয়া দিয়ে। তিন-চারজন মিলে কুলোর হাওয়া দেয়। তারপর প্রচন্ড জোরে ঢাক বেজে ওঠে। ঘন্টা বাজে, কাঁসর বাজে, শিবের নাম করে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে সকলে। ভক্তারা তখন ওই গণগণে আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে এপার থেক ওপারে যায়। ওপার থেকে এপারে আসে। সেই সময় পুকুর থেকে ঘড়া ঘড়া জল নিয়ে এসে এই পানার ওপর ঢেলে পানাকে ভিঁজে সপ সপে করে রাখা হয়। ভক্তারা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে ভিঁজে পানার ওপরে দাঁড়িয়ে পরে।

পায়ে একটুও ফোস্কা পরে না! এটাও একটা সাইন্স।

কেন?

আমাদের পায়ের তলায় আগুনের ছেঁকা মারলে দেখা যাবে সেই উত্তাপ লাগতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। গোড়ালির চামড়াটা মোটা। ছোট বয়েসে দেখেছি পায়ে বাবলা কাঁটা কিংবা বেল কাঁটা ফুটলে বিষ ব্যাথা হতো। বাড়ির গুরুজনেরা চুন লাগিয়ে পলতে পোড়ার ছেঁকা লাগাত। এখনো সেই ছবিটা মগজের মধ্যে খোদাই করে রেখেছি। এখন তাকে বাস্তবে আনার চেষ্টা করেছি।

ওই কুড়িফুট রাস্তাটা ওরা হাঁটতে সময় নিত পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড। এক একটা পা ওই আগুন স্পর্শ করতো চার থেকে পাঁচবার, খুব বেশি হলে ছ-বার। গিয়েই ওই জলে ভেঁজা পানার ওপর দাঁড়িয়ে যেত। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার ওরা একই ভাবে ফিরে এসে এপাশের ভেঁজা পানার ওপর দাঁড়াত। অতএব হাঁটার সময় পায়ের তলাটা যতটা গরম হতো, জলে ভেঁজা পানায় এসে দাঁড়াতেই তা ঠান্ডা হয়ে যেত। তা বলে আমি কখনো তাদের কৃচ্ছসাধনাকে ছোট করে দেখছি না। তবে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে আগুণের ওপর দিয়ে হাঁটা সম্ভব নয়। মনের মধ্যে যতো বড়ো ঐশ্বরিক শক্তির উপলব্ধি আসুকনা কেন। কিছুনা কিছু ইনজিওরড হবেই। ওরা কিন্তু বহাল তবিয়েতে থাকে।

অনেককে দেখেছি এখানকার উৎসবের পরের দিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে ওই টানা বারান্দার বেঞ্চে বসে কাকার সঙ্গে চা খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা মারছে। যদি অসুবিধে হবে তাহলে এতটা পথ হেঁটে আমাদের বাড়িতে গিয়ে চা খেল কি করে?

আমাদের স্কুল থেকে একটু দূরে গেলে দত্তদের জমিদার বাড়ি। এই গোটা অঞ্চলটা জমিদার বাবুদের। এই মন্দির তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই পুকুরটা তারা খনন করেছিলেন। শোনা কথা এই পুকুরের মাঝখানে নাকি অনেক কুয়ো আছে।

আমাদের লোকগাথার মধ্যে অনেক গল্প পাওয়া যায়। বাচ্চাদের ঘুম পারাবার সময় মায়েরা গায়। ঘুমপাড়ানি গান!

আয় ঘুম যায় ঘুম বর্গী এলো দেশে/বর্গীদের ছেলেগুলো পথে বসে কাঁদে/আর কেঁদো না আর কেঁদো না ছোলা ভাজা দেবো/এবার যদি কাঁদো তুমি তুলে আছাড় দেব। এইরকম আর কি, আমি ঠিক বলতে পারলাম না। আরও অসংখ্য আছে। আমি জেনেছি পদি পিসির কাছ থেকে। পদি পিসি ফণি জ্যেঠুর খুড়ী। মরে গেছে।

বর্গীরা এক সময় বাংলা আক্রমণ করেছিল। তখনকার দিনের জমিদারদের পয়সা-গড়ি খুব একটা কম ছিল না। বেশ অবস্থাপন্ন গেরস্থ। এই বর্গীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য, এইসব জমিদাররা প্রচুর মন্দির তৈরি করেছিল। মন্দিরের সামনে এক একটা পুকুর। আর পুকুরের মধ্যে যে সব কুয়োর গল্প শুনি বা দেখি, সেখানে তাদের সোনাদানা এক একটা ঘড়ায় ভরে মুখ বন্ধ করে লুকিয়ে রাখত। বর্গীরা আক্রমণ করলে। ঘর লুঠ করবে। মন্দির লুঠ করবে না। জানতেও পারবে না এই রকম একটা পুকুরের মধ্যে তাদের ধন সম্পদ লোকান আছে।

মাঝে মাঝে গুপ্তধনের গল্প পড়ি, এই কনসেপ্ট থেকে তৈরি।

ফণিজ্যেঠুর বাবা ওই জমিদার বাড়ির লেঠেল ছিলেন। আমি তখন ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। একদিন কি কথায় কথায় ফণিজ্যেঠু আমাকে বলেছিল, ওই বাড়িতে যে মন্দির আছে, তার তলায় একটা অন্ধকার ঘর আছে, জমিদারবাবু নাকি যারা দুষ্টুমি করে তাদের ওখানে আটকে রেখে দেয়। আমি দুষ্টুমি করলে আমাকেও ওখানে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে দেবে। ছোট ছিলাম। ফণি জ্যেঠুর দশাসই চেহারা দেখে সত্যি বেশ ভয় পেতাম। কালো কষ্ঠি পাথরের মতো গায়ের রং। মাথায় একটা গামছা পাগড়ির মতো বেঁধে রাখতো। ঝাঁটার মতো ইয়া গোঁফ। যখন বড় হলাম দেখলাম তার আগেই জমিদারদের জমিদারিত্ব চলেগেল। জমিদারবাবুরা এখান থেকে টাউনে চলে গেলেন। বাস্তু রয়ে গেল, মন্দির রয়ে গেল। ওই বাড়ির একটা কাজের মেয়েকে পটিয়ে, আমি একদিন সেই অন্ধ কুঠরির খোঁজ পেলাম। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে তার ইতিহাস জানলাম। ফণিজ্যেঠুকে এসে ধরলাম। জ্যেঠু আমার কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে বললো, তুই জানলি কি করে! আমি বললাম তুমি হ্যাঁ অথবা না বলবে। জ্যেঠু আমার কথায় শায় দিয়েছিল। দেবদাসী।

এখন গোধূলি। মিহি কুয়াশার মতো অন্ধকার, আকাশটাকে ঢেকে ফেলছে। ঝিঁ-ঝিঁর ডাকে চারদিক ম ম করছে। সন্ধ্যাতারা পূব আকাশে জ্বল জ্বল করছে। মন্দিরে শিবমূর্তির সামনে মোমবাতিগুলো জ্বলছে। মোমবাতির শিখা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।


আপনার মতামত লিখুন :

2 responses to “শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়”

  1. গৌতম ব্যানার্জী says:

    দারুণ হয়েছে লেখাটা। মনে হচ্ছিল আমি যেন ওই গ্রামের রাস্তা ধরেই যাতায়াত করছি।

  2. Ranjan sen says:

    ভালো লিখেছিস।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন