শিবরাত্রির ভাঙের নেশা এখনো কাটেনি ছেলেবুড়োর। শেখাওয়াটির গলি মহল্লায় ধাপের সঙ্গতে হোলী ধামাল শুরু, “যারাসা বাহার আ যা শাঁওরে, খেলেলা হোলী”।
প্রতিবছরের মত ধামাল টোলীতে জুটেছে বহুরূপীরা। চটকদার ঘাঘরা, নকলবেণী, নথ, চুড়ি আর ঘোমটা পরা নারীসাজা পুরুষ বহুরূপীদের সঙ্গে ছেলে ছোকরার নকল রোম্যান্স। ‘উড়ত গুলালে’ যে শুধু ব্রজের হোরী নয়, থাকে চটুল ইশারাও। ভাঙ আর শস্তা দারুর নেশায় দুষ্টুমির ইচ্ছে। এখানে ঘরওয়ালীরা পথে বেরোয় না। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে হোলীর হুরদঙ্গ দ্যাখে। ফিরিঙ্গী ম্যাডামদের গোরে গোরে গালে তাই গোলাপী রঙ লাগানোর প্রবল বাসনা।
শেখাওয়াটিতে এই হোলী আর হাভেলীর টানে ছুটে আসে কত দেশী বিদেশী অতিথি! আধা মরুভূমিতে ইতস্তত ফোটে লাল-হলুদ-কমলা রোহিডা ফুল। বসন্তের নতুন পাতায় কৈর-সাংরী গাছ আবার সেজে ওঠে। চাষীর ঘরে, খামারে নতুন গমের ফসল। হাতে কিছু পয়সা।
পয়সার স্রোত দেখেছে বটে একসময় শেখাওয়াটি। রেশম পথের নিশানা ধরে উটের পিঠে এখানে আসত কত বিদেশী বণিক! আঠেরো শতকের শুরু থেকে রাজস্থানের এই উত্তরপূর্ব অঞ্চল সূতিরকাপড়, সিল্ক, মশলার কারবারে ফুলেফেঁপে উঠল। এখানকার শেঠেরাও ব্যবসার টানে দূরদূরান্তে পাড়ি দিল। এক প্রভাবশালী শেঠ শেখারামের নামে এ ব্যবসাক্ষেত্র হল শেখাওয়াটি। ধনরত্নের সঙ্গে বিদেশের বিলাসবৈভব ছুঁয়ে গেল তাদের জীবনে। বার্মা বা এখনকার মায়ানমারের শেগুন কাঠ, মকরানার পাথর ছেড়ে ইটালিয়ান মার্বেল, বেলজিয়ামের কাঁচ দিয়ে বানালো তাদের বিশাল বিশাল প্রাসাদ বা হাভেলী। প্রাসাদে বৈঠকখানা, খাজাঞ্চিখানা, নাচঘর, মেয়ে মহল, রান্নাঘর, মন্দির কি নেই! মৃত্যুর পর প্রাসাদ সংলগ্ন ছত্রী বা সমাধি মন্দিরে নিজেদের অমর করে রাখার আশা পূর্ণ হল। পরোপকারের খাতিরে, সমাজে প্রতিষ্ঠার লোভে কুয়ো, রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতালে শেখাওয়াটিকে সাজালো শেঠেরা।
এই কর্মকাণ্ডের বিশালতার মাঝে যা সুন্দরতম হয়ে ফুটে উঠল, তা হ’ল প্রাসাদের দেওয়ালে চিত্রকথা। অজানা শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় সেখানে রামসীতার বিয়ের উৎসবের ঘটা, শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, রাসলীলা, বিষ্ণুর দশাবতার, মহাদেব-পার্বতীর সংসার, মহাভারতের যুদ্ধের মত অগণিত ছবি।
oppo_48
দেবদেবীর পরবর্তী স্থানে আছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের দিনচর্যা, বৈদেশিক বাণিজ্য, যুদ্ধবিগ্রহ, উৎসব, পুজো পার্বণ। পরবর্তীকালে আরো একটু সাহসী হয়ে বাড়ির মালিক পূর্বপুরুষ ও নিজেদের ছবিও আঁকিয়েছেন। বৃটিশরা এদেশে নিজেদের পাকাপাকি বন্দোবস্ত করার পরে রাজভক্ত বণিক সম্প্রদায় তাদেরকেও ভোলেন নি। দেওয়ালের ছবিতে সাদা সাহেব তাদের রেলগাড়ি, কামান নিয়ে উপস্থিত। বাড়ির স্থাপত্যেও কলোনিয়াল ছোঁওয়া।
রেশম পথের ব্যবসায় গণেশ উল্টোলে শেখাওয়াটীর বেশিরভাগ পোদ্দার,খেমকা,রুইয়া, পীরামলরা বড়বাজারে গদীতে জমিয়ে বসল। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল মুম্বাই এবং গোটা ভারতে।
বিশাল প্রাসাদগুলো তার দেওয়াল ছবির মাধুর্য নিয়ে পড়ে রইলো অবহেলায়। শরিকি ঝামেলা কাটিয়ে কিছু হাভেলী অবশ্য দামী হোটেলের তকমা পেয়েছে। একটি প্রাসাদে বজরঙ্গী ভাইজানের পদধূলি পড়েছে। অন্য একটির খ্যাতি ‘পিকে’-র জন্যে। ভাঙাচোরা অট্টালিকা সামান্য মেরামত করে কোথাও শেঠ-শেঠানী হোমস্টে চালাচ্ছেন। বিবর্ণ ছবিতে ধরা আছে তাঁদের অতীত গৌরব।
দিনমানে সেখানে দরিদ্র গায়ক সোহনলাল তার রাবণভত্তায় সুর তুলে, মান্ড গেয়ে দুটি পয়সা রোজগার করে। গাইড রোশন শর্মা গুটিকয়েক ট্যুরিস্টদের জানা অজানা গল্প শোনায়। কোথাও বাসা বাঁধে ময়ূরের পরিবার। মানুষের পায়ের শব্দে সচকিত হয়।
রাতের অন্ধকারে শেখাওয়াটির অলিগলিতে এই জনহীন প্রাসাদগুলি যেন অলৌকিক এক মায়া! না জানে কত দীর্ঘশ্বাস, না বলা কাহিনী তালাবন্ধ হয়ে আছে বাদুড় ঝোলা অট্টালিকার ঘরে ঘরে! মুক্তির আশায় হয়তো তারা দিন গুনতেই থাকে!