সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ‘কুড়কুড়ে ছাতুতে’ ক্যানসার নিকেশ হবার পথ্য লুকিয়ে আছে। বাঙালি উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর গবেষণায় এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। সম্প্রতি ‘নেচার পত্রিকায়’ এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই নিয়ে জনমানসে খুশির হাওয়া।
প্রসঙ্গত, কুড়কুড়ে ছাতু বা পুটকা ছাতু কিম্বা উই ছাতু যে নামেই আঞ্চলিক ভেদে ডাকা হোক না কেন জঙ্গলমহল অথবা পল্লী অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় এই সুস্বাদু ছাতু আজও রান্নাঘরে দেখা যায়। মাছ বা মাংসের স্বাদের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। বাজারের চাষকরা মাশরুমের চেয়ে এই কুড়কুড়ে মাশরুম গ্ৰামের মানুষের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাই এখনও জঙ্গলে কিম্বা বর্জ্যস্তূপের আড়ালে এই কুড়কুড়ে ছাতু খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন পল্লির মানুষেরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ক্যান্সারের প্রতিকার ‘কুড়কুড়ে ছাতু’- তে লুকিয়ে আছে। উদ্ভিদবিদ্ ও গবেষক ড. স্বপনকুমার ঘোষ প্রমাণ করলেন গ্রাম্য খাবার ‘কুড়কুড়ে ছাতু’-তে ক্যানসার নিকেশ হয়। এই খাদ্যের জন্যই আদিবাসীরা বেশ সবল সুস্থ জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি ‘নেচার’-এ বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জানান, এই গুপ্তধনের দৌলতেই সাঁওতালদের কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না মারণরোগ।
হদিশ অনেকেই জানত। কিন্তু, তা যে দুর্মূল্য তা জানা ছিল না। এবার সেই গুপ্তধনের ক্ষমতা মান্যতা পেল আন্তর্জাতিক মঞ্চে। সেই সঙ্গে উন্মোচিত হল একটি রহস্যও। এই কুড়কুড়ে ছাতুর।
প্রসঙ্গত, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার রাঙামাটি ছাড়াও হুগলির আরামবাগ, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্ৰামের বেশ কিছু এলাকায় বর্ষার সময় দেখা যায় এই ছত্রাক। মূলত শাল-পিয়াল-হরীতকী, বহেড়ার নিচে মাটিতে আলুর মতো দেখতে এই ছত্রাক জন্মায়। স্থানীয় সাঁওতালরা এই ছত্রাক নিজেরা খায়, বাজারে বিক্রিও করে। ফাইবারে উৎকৃষ্ট এই মাশরুম অত্যন্ত সুস্বাদু। পুষ্টিগুণেও ভরপুর। সহজে রান্না করা যায়। বাঁকুড়ার রানিবাঁধ এবং খাতড়ার জঙ্গলে প্রচুর হয়। এবার এই ছত্রাকের ক্যানসাররোধী ক্ষমতাকে প্রকাশ্যে আনলেন রহড়ার রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গবেষক ড. স্বপনকুমার ঘোষ। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববন্দিত নেচার পত্রিকার সায়েন্টিফিক রিপোর্টস বিভাগে।
এই ছত্রাকের থেকে সংগৃহীত ‘এফ-১২ প্রোডাক্ট’-এর ক্যানসার নিধনের ক্ষমতা আছে। নিয়মিত এই মাশরুম খেলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাও কমে। সেটাও প্রমাণিত হয়েছে আমাদের গবেষণায়।’’ গবেষণায় স্বপনবাবুকে সহযোগিতা করেছেন কৌশিক পাণ্ডে, মধুপর্ণা ঘোষ ও প্রদীপকুমার শূর। উল্লেখ্য, স্বপনবাবু বীরভূমের খয়রাশোলের বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকেই সাঁওতালদের এই মাশরুম খেতে দেখেছেন। নিজেও খেয়েছেন। উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করার সুবাদে সম্প্রতি এই মাশরুমের ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। তাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্বপনবাবু জানান, ৬০টির বেশি কম্পাউন্ড পাওয়া গিয়েছে এই মাশরুমে। সেগুলির শুদ্ধিকরণ করে ‘এফ-১২ প্রোডাক্ট’ বের করা হয়। এতে ক্যানসাররোধী পাঁচটি ‘ফ্যাটি অ্যাসিড’ আছে। যা ‘পি-৫৩ জিন’-কে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, ক্যানসার কোষের বিভাজন আটকে যায়। স্বপনবাবুর পর্যবেক্ষণ, পি-৫৩ জিনকে ‘গার্জেন অফ জিনোম’ বলা হয়। এই অভিভাবক নড়বড়ে হয়ে গেলেই শরীরে ক্যানসারের মতো রোগের প্রকোপ শুরু হয়। এই মাশরুমে মজুত ‘এফ-১২ প্রোডাক্ট’ পি-৫৩কে সক্রিয় করে। ‘অ্যাপোকটিসিস’ বা ক্যানসার কোষের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।
স্বপনবাবুর দাবি, সপ্তাহে একদিন ৫০ গ্রাম ‘কুড়কুড়ে ছাতু’ খেতে হবে। তা হলে একদিকে ক্যানসার আক্রান্তরা যেমন রোগের সঙ্গে লড়াই করতে পারবেন, অন্যদিকে, বাকিরা ক্যানসারকে দূরে রাখতে পারবেন। বিখ্যাত ভাইরোলজস্টি ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার জানিয়েছেন, ‘‘বাংলার মাশরুম যে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদানেরও উৎস হতে পারে এই গবেষণা সেটাই দেখাল। গবেষণার ফলাফল যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক ও তাৎপর্যপূর্ণ। সেল-লাইনের উপর করা সাফল্য মানুষের শরীরেও (ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে) পাওয়া যাবে, এই আশাই করব। সেক্ষেত্রে এই গবেষণা ক্যানসার চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।’’
প্রসঙ্গত, জঙ্গলমহল এলাকায় গেলেই লক্ষ্য করা যাবে রাস্তার দু’ধারে সার দিয়ে বসেছেন ছাতু বিক্রেতারা। চুপড়ি থেকে বেছে বেছে সাধের কুড়কুড়ে ছাতু কিনতে ভিড় জমিয়েছেন ক্রেতারাও। প্রত্যেক বর্ষাতেই কুড়কুড়ে ছাতু যেমন জঙ্গলমহলবাসীর রসনা তৃপ্ত করে তেমনই বিক্রেতাদের ঘরে লক্ষ্মী আনে। ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে জঙ্গলমহল এলাকায়। এখন এটা এখানকার অর্থকরী সম্পদ। মণিমালা লোহার, সুমিত্রা লোহার, রিতা বাউরি, বুলু মহাদণ্ডের মত বিক্রেতারা জানান, “ভোর ভোর সারা জঙ্গল ঘুরে কেজি কেজি ছাতু সংগ্ৰহ করি। আমাদের জমিজমা নেই, লোকের জমিতেও কাজ নেই। আর একশো দিনের কাজ তো কবেই চলে গিয়েছে। ছাতু বিক্রি করে প্রতিদিন ৫০০ থেকে হাজার টাকা রোজগার হয়।” ক্রেতাদের নজর কাড়ে এই কুড়কুড়ে ছাতু। রবীন সেন, উদয় চক্রবর্তী, কার্তিক দত্ত, রঞ্জিত দে-রা জানান, “কয়েক দিন আগে ৭০ টাকায় একশো ছাতু কিনেছি। এখন সাধ্যের মধ্যেই আছে। তবে একটু বেলা করে ছাতু সাড়ে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। আনাজের যা দাম তার চেয়ে এই ছাতুই ভাল।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ধরনের ছাতুতে খনিজ, ভিটামিন থাকে। তাই, ছাতু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ছাতু ওজন কমায়, মেটাবলিজম বাড়ায়। ত্বক ও চুল ভালো রাখে। ছাতুতে থাকা ভিটামিন ও খনিজ ত্বক ও চুলের জন্য ভালো। এছাড়া রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি হজমে সাহায্য, শরীর ঠাণ্ডা, শরীরের ঘাম, শরীরের দাহ (জ্বালা) কফ ও পিত্ত নাশ করে। হৃদপিণ্ড সম্বন্ধীয় এবং সাধারণ বিপাকীয় ব্যবস্থা ভালো রাখে। তবে ছাতু খাওয়ার সময়ের কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ছাতুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। তাই, প্রতিদিন এটি খেলে হজমের সমস্যা হতে পারে। যাদের আগে থেকেই গ্যাস বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে তাদের প্রতিদিন ছাতু খাওয়া ঠিক নয়। শরীরের স্বাস্থ্য অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এই ধরনের ছাতু খান এবং ক্যান্সার নিকেশ করুন।