সোমবার | ৩রা মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৩৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
পেজফোর-এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২৫ এত গুণী একজন মানুষ কত আটপৌরে : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সরস্বতীর উৎস সন্ধানে : অসিত দাস ‘সব মরণ নয় সমান’ সৃজনশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে যথোচিত মর্যাদায় স্মরণ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সিপিএম-এর রাজ্য সম্মেলন, তরুণ প্রজন্মের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে খামতি রয়েছে দলে : তপন মল্লিক চৌধুরী প্রথম পাঠ — মার্কসবাদের বিশ্বভ্রমণ : সন্দীপন চক্রবর্তী বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র স্মারকগ্রন্থ : ড. দীপাঞ্জন দে ‘খানাকুল বাঁচাও’ দাবিতে সরব খানাকুল-সহ গোটা আরামবাগের মানুষ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হরি হরের কথা এবং বীরভূমের রায়পুরে বুড়োনাথের বিয়ে : রিঙ্কি সামন্ত ত্র্যম্বকেশ্বর দর্শনে মোক্ষলাভ : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কুম্ভমেলায় ধর্মীয় অভিজ্ঞতার থেকে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশি : তপন মল্লিক চৌধুরী রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন ৭ লক্ষ টন ছাড়াবে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ‘হিড়িক’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি অধরা, আমার আলোকপাত : অসিত দাস বিজয়া একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-র ছোটগল্প ‘শিকড়ের টান’ বাংলাভাষার নেচিতে ‘ময়ান’ ও ‘শাহিস্নান’-এর হিড়িক : অসিত দাস একটু একটু করে মারা যাচ্ছে বাংলা ভাষা : দিলীপ মজুমদার রাজ্যে এই প্রথম হিমঘরগুলিতে প্রান্তিক চাষিরা ৩০ শতাংশ আলু রাখতে পারবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সামরিক জান্তার চার বছর — মিয়ানমার পরিস্থিতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ১৯ ফেব্রুয়ারি ও স্বামীজির স্মৃতিবিজড়িত আলমবাজার মঠ (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত চাষিদের বাঁচাতে রাজ্যের সরাসরি ফসল কেনার দাওয়াই গ্রামীণ অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার মোদীর মিডিয়া ব্যস্ত কুম্ভের মৃত্যুমিছিল ঢাকতে : তপন মল্লিক চৌধুরী রেডিওকে আরো শ্রুতিমধুর করে তুলেছিলো আমিন সায়ানী : রিঙ্কি সামন্ত গোপাল ভাঁড়ের আসল বাড়ি চুঁচুড়ার সুগন্ধ্যায় : অসিত দাস প্রতুলদার মৃত্যু বাংলা গানের জগতে অপূরণীয় ক্ষতি — মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় : সুমিত ভট্টাচার্য মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়, মিথ এবং ডিকনস্ট্রাকশন : অসিত দাস মহাকুম্ভ ও কয়েকটি প্রশ্ন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন : ড. দীপাঞ্জন দে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বসন্ত পঞ্চমী ও সরস্বতী পুজোর  আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

‘সব মরণ নয় সমান’ সৃজনশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে যথোচিত মর্যাদায় স্মরণ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়

মোহন গঙ্গোপাধ্যায় / ৬১ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১ মার্চ, ২০২৫

শনিবার কলকাতার শিশির মঞ্চে ‘সব মরণ নয় সমান’ সৃজনশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের যথোচিত মর্যাদায় স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হল। সভার সূচনা পর্বে দোলা সেন  শিল্পীর গাওয়া ‘ জন্মিলে মরিতে হবে ‘ গানটি গেয়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।এরপর শিল্পীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শিল্পীর স্ত্রী সর্বাণী মুখোপাধ্যায় শিল্পীর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ফুল ও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, নিকট আত্মীয় স্বজন ও বিশিষ্টজনেরা।

উল্লেখ্য, এদিন প্রয়াত শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণ করেন জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মজুমদার, নিকট আত্মীয় গীতবাণী চট্টোপাধ্যায় ও দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, ডা. সিদ্ধার্থ গুপ্ত, সান্টু গুপ্ত, নীতিশ রায়, রুদ্র দেব মুখোপাধ্যায়, সৈকত মিত্র, কল্যাণ রুদ্র, সমীর পূততুণ্ড, পূর্ণেন্দু বসু প্রমুখ। বিশিষ্টজনেরা সকলেই প্রয়াত শিল্পীর সৃষ্টি নিয়ে রেখাপাত করেন। সংগীতের মধ্য দিয়ে শিল্পীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সৈকত মিত্র।

প্রসঙ্গত, এদিন স্মরণ সভায় বক্তাদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে প্রতুল মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাঙালি গায়ক, সৃজনশীল শিল্পী এবং গীতিকার। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘আমি বাংলায় গান গাই’ এবং ‘ডিঙা ভাসাও সাগরে’ নামের দুটি বিখ্যাত গান।

তিনি গোঁসাইবাগানের ভূত চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠ দেন। তিনি মনে করতেন, সৃষ্টির মুহূর্তে লেখক-শিল্পীকে একা হতে হয়। তারপর সেই সৃষ্টিকে যদি মানুষের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়, কেবলমাত্র তাহলেই সেই একাকিত্বের সার্থকতা। সেই একক সাধনা তখন সকলের হয়ে ওঠে।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় ১৯৪২ সালের ২৫ জুন অবিভক্ত বাংলার অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক ও মা বাণী মুখোপাধ্যায় ছিলেন গৃহিণী। দেশবিভাগের সময় তিনি পরিবারের সাথে ভারত চলে আসেন। শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজের লেখা ও সুরে গান গাইতেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় প্রথম সুরারোপ করেন। নিজের লেখা গানের পাশাপাশি ছড়া, কবিতাতেও তিনি বিভিন্ন সময় সুরারোপ করেছেন।

দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পিজি তথা এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর মত্যু হয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ৮২ বছর বয়সে। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ জাতীয় সঙ্গীতের মতো জনপ্রিয়। তিনি বরাবরই প্রচারবিমুখ ছিলেন। গুণী শিল্পী এবং খুবই ব্যতিক্রমী শিল্পী ছিলেন। ওঁর গান গাওয়ার ধরন অথবা গান নিয়ে ভাবনাচিন্তা আর পাঁচজনের চেয়ে ভিন্ন ছিল। ওঁকে হারানো আমাদের কাছে বড় ক্ষতি। শুধু একটি গান নয়। ওঁর বহু ভাল অ্যালবাম ছিল। তিনি যে সময়ের মানুষ বা ওঁর যা ভাবনাচিন্তা, তা বর্তমানের শিল্পীদের মধ্যে নেই। এখন হয়তো অন্য রকমের কাজ তৈরি হবে। ওঁর সময়েও কিন্তু উনি ব্যতিক্রমী ছিলেন বলে বক্তাদের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে।

দৃপ্ত স্লোগান আর তৃপ্ত শেষ চুমুকে জেগে থাকবে বাংলা, অথৈ সাগরে তাঁর ডিঙ্গা ভাসালেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় । আবার বিপ্লব আর স্বপ্নভঙ্গের বঙ্গীয় রাজনীতির অনেক উথালপাথালের সাক্ষী হয়ে আছেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি ছিলেন সমাজতন্ত্রের শরিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বোধহয় মানুষ আর মানবতাকে তাঁর গানে সবার আগে রাখতেন। তাঁর গানের সঙ্গে ছিল সেই ‘আস্ত একটা গান’ মানুষটির অনুষ্ঠান। মঞ্চে উঠলে দেখা যেত এক কাঁচাপাকা চুলের প্রৌঢ়। নিবু নিবু আলো জোরালো হয়ে উঠতেই দেখা যেত অতি সাদামাঠা পোশাকে এক মানুষ যেন আপিস ফেরতা মিনিবাসের সিট থেকে উঠে হঠাৎই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই গেয়ে উঠলেন — ‘দারুণ গভীর থেকে ডাক দাও’। তদ্দিনে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন শ্রোতাবৃত্তে। বাংলা গানের নদীতে তখন নতুন জোয়ার।

বাঙালির স্মৃতিরেখায় টান পড়ছিল — আর কারা গেয়েছেন এমন ছকভাঙা গান? এই সময়ে উদয় হন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। বাংলা গানকে ঘিরে তখন অনেক মিথ। প্রতুল সেই কিংবদন্তির অন্যতম চরিত্র। জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। ১৯৪২ সালে। বাবা প্রভাতচন্দ্র ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা বীণাপাণি মুখোপাধ্যায় গৃহবধূ। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। স্কুলে পড়াকালীনই তাঁর এক আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পান নিকটজনেরা। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে বন্ধুদের চমকে দিয়েছিলেন।

চাকরি করেছেন আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত গেরস্তের মতোই। কিন্তু সেই গেরস্তালির মধ্যেই কোথাও যেন আগুন ছিল। ধিকিধিকি গানের আগুন।

বঙ্গীয় রাজনীতির অনেক উথালপাতালের সাক্ষী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। তিনি রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন সমাজতন্ত্রের শরিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বোধ হয় মানুষ আর মানবতাকে তাঁর গানে সবার আগে রাখতেন। কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই শুধুমাত্র ‘বডি পারকাশন’ ব্যবহার করে গানের রেওয়াজ গণনাট্যের গানেও ছিল না। বরং সেখানে গান ছিল যূথবদ্ধ মানুষের হারমনির উপরে দাঁড়িয়ে। ‘কয়্যার’ বা যৌথ গানের সঙ্গে মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াই বা দিনবদলের স্বপ্ন ইত্যাদির অঙ্গাঙ্গি যোগ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতুল সে রাস্তায় হাঁটলেন না। তাঁর গান সে অর্থে তাই ‘গণসঙ্গীত’ হয়েও যেন হল না। এমনকি, মঞ্চে গাওয়ার সময়েও (মঞ্চের বাইরেও হাটে-মাঠে-ঘাটে) কোনও যন্ত্রীকে সঙ্গে নিলেন না। কখনও নিজের গাল, কখনও বা বুক বাজিয়ে, তুড়ি দিয়ে, হাততালি দিয়ে গাইতে লাগলেন নিজের বাঁধা গান। গায়ক একা হয়েও যেন একা নন। তাঁর সঙ্গী তাঁরই দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। প্রতুলের গান গণনাট্যের গানেরই উত্তরাধিকার হলেও তার থেকে তার স্বাতন্ত্র্য প্রধানত ওই এক জায়গাতেই। গণনাট্যের গানের যৌথতা কি বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গে ছত্রখান হয়ে গিয়েছিল? তার পরে বাংলা মূলধারার গানে সে অর্থে যৌথতা আর দেখা যায়নি। সত্তরের দশকের আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া গানে (যদিও তার সংখ্যা তেমন বেশি নয়) যৌথতা এক ঝলক উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। ওই পর্যন্তই। বাংলা গানের মূলধারায় তাই ‘কয়্যার’ বা ব্যান্ডের ঐতিহ্য প্রান্তিকই ছিল বলা যায়।

উল্লেখ্য, প্রতুলের প্রথম অ্যালবাম ‘যেতে হবে’ (১৯৯৪) প্রকাশের পর একেবারে অন্য রকম এক শ্রুতির সামনে গিয়ে পড়েন শ্রোতারা। মঞ্চে প্রতুল যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জন করলেও এই অ্যালবামে করেননি। তাঁর গানের পিছনে বহু দূরের দিগন্তরেখার মতো থেকেছে যন্ত্র। গানই সেখানে মুখ্য। ইন্টারল্যুডে প্রতুলের নিজেরই গানই সেখানে মুখ্য। ইন্টারল্যুডে প্রতুলের নিজেরই কণ্ঠ বেজেছে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা! সর্বোপরি তাঁর কণ্ঠ, স্বরক্ষেপণ এবং উচ্চারণ। মধুমাখা বাংলা আধুনিকের জগতে সে যেন এক মূর্তিমান ভাঙচুর। ‘সুকণ্ঠ’ নিয়ে গরবে গুমরোনো বাংলা গানের জগতে প্রতুল তাঁর প্রবল রকমের ‘ম্যানারিজম’ নিয়ে যেন সত্তর দশকের কবি সুব্রত সরকারের উচ্চারণেই বলে উঠলেন, ‘সহ্য করো, বাংলাভাষা’। বাংলা তাঁকে সহ্যই শুধু করল না, আদরে-আশ্লেষে বুকেও টেনে নিল। ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’-র তরঙ্গপ্রতিম স্বরক্ষেপণ আর ‘ঙ্গ’-এ জোর দেওয়া উচ্চারণ বুঝিয়ে দিল, তিনি একেবারে আলাদা কিসিমের এক গানওয়ালা। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ তখন কলেজ – ক্যান্টিনে, ফেস্টে, ফেস্টুনে একাকার। ‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, তৃপ্ত শেষ চুমুক’ — এমন শব্দচয়ন যে বাংলা গানে উঠে আসতে পারে, তা নব্বই দশকের ফুটতে থাকা কবিকুলও ভাবতে পারেননি। বইমেলার মর্মাঁর্ত মঞ্চে অথবা না-মঞ্চের জটলাতেও প্রতুল গেয়ে উঠছেন।

চার্লি চ্যাপলিনের অমর সুরসৃজন ‘লাইমলাইট থিম’-এর বঙ্গান্তর। সেই উচাটন সুরে বসিয়ে দিয়েছেন ভবঘুরে চার্লিকেই উৎসর্গ করা ভালবাসার কথা। চার্লির সুর যদি ব্যক্তিমানুষের একান্ত ভালবাসার অভিজ্ঞান হয়ে থাকে, তবে তাতে প্রতুলের লিরিক ছিল সর্বজনীন ভালবাসার বালুচরি-নকশা। সে গানে যেন লেগে ছিল প্রেমের আবরণ-আভরণহীন উদ্দামতা। পিঠোপিঠি অ্যালবাম ‘ওঠো হে’। সময়ের ঝুঁটি ধরে উঠতে বললেন প্রতুল। কোথাও কি মিশে গেল নাটকের গানের নাটকীয়তা? প্রতুলের গান অ্যালবামে শোনা আর তাঁর মঞ্চের পারফরম্যান্স প্রত্যক্ষ করার মধ্যে ছিল আসমান-জমিনের ফারাক। শুধু বডি পারকাশনের প্রয়োগ নয়, প্রতুলের দুই চোখ, মুখাবয়ব, শরীরের অভিব্যক্তি যেন গেয়ে উঠত একসঙ্গে। ‘সাপের মাথায় পা দিয়ে সে নাচে’ অথবা ‘নকোসি সিকেলে আফ্রিকা’ যাঁরা মঞ্চে দেখেছেন, তাঁরা জানেন কী ছিল সেই উপস্থাপনে। শুধু নিজের লেখা গান নয়, অন্য ভারতীয় ভাষার কবিদের কবিতা অনুবাদ করে গানে নিয়ে গিয়েছেন তাদের। সুর দিয়েছেন কবি অরুণ মিত্রের ‘আমি এত বয়সে’-র মতো গদ্যকবিতাতেও। সেই গানের মধ্যে যেন মরুপ্রান্তরের হাওয়াঘেরা হাহাকার ঢেলে দিয়েছিলেন প্রতুল। ‘লাইমলাইট’-এর আর্দ্রতা সেখানে নেই, ‘ডিঙ্গা ভাসাও’-এর লবণস্নিগ্ধ সমদ্রঝাপট সে গানে অনুপস্থিত। সে গান গদ্যের কারখানাশব্দ আর প্রান্তবয়সের কবির হাহাকারের যুগলবন্দি। এরই সঙ্গে প্রতুল গেয়েছেন ছোটদের জন্য। ‘কুট্টুস কট্টাস’ নামের অ্যালবামে। প্রায় প্রতিটি গানে রয়েছে কেমন এক সস্নেহ প্রশ্রয়ের টান। সুমন-নচিকেতা-অঞ্জনের ‘ছোট বড় মিলে’ আর প্রতুলের এই অ্যালবামই কি বাংলার শেষ ‘ছোটদের গান’?

প্রসঙ্গত, একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রতুল মুখোপাধ্যায় বলেছেন, সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। তাঁর ভাষায়, “আমি শুনে শুনে, ঠেকে ঠেকে শিখেছি।” তাঁর শ্রোতাদেরও প্রথমে হোঁচট খেতে হয়েছিল তাঁর গান শুনতে বসে। একজন মানুষ কণ্ঠ, প্রশিক্ষণ, পরিমার্জন — সব কিছুকে পাশে সরিয়ে রেখে কী করে হয়ে উঠছেন ‘আস্ত একটা গান’, তা আগামী প্রজন্মকে ভেবে উঠতে গেলেও ভাবনার জিমন্যাশিয়ামে ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। কী করে সম্ভব হয়েছিল তা, এখন আর মনে পড়ে না নব্বই দশকে যুবক হয়ে উঠতে থাকা প্রজন্মের। মাথার উপর এক স্থবির রাজনীতি আর তার সুবাদে চারিপাশে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’-সুলভ একটা ‘ফিল গুড’ ভাবকে যে হাতেগোনা কয়েক জন দুমড়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রতুল অন্যতম। হয়তো সেটা ‘সময়ের দাবি’। কিন্তু সময় কি তার পরে আর দাবি জানাতে পারল না? ‘আমি বাংলায় গান গাই’ হয়তো সেটা ‘সময়ের দাবি’। কিন্তু সময় কি তার পরে আর দাবি জানাতে পারল না? ‘আমি বাংলায় গান গাই’ পরে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা মূলধারার সিনেমায়। সেখানে সে গানের ধার কেমন যেন ভোঁতা। ‘দৃপ্ত স্লোগান’ আর ‘তৃপ্ত শেষ চুমুক’-কে ধরতে পারেনি উত্তর-বিশ্বায়ন পর্বের বাংলা বা বাঙালি। বাংলা গানের নব্বইয়ের ‘নবজোয়ার’ স্তিমিত হয়ে এসেছিল মিলেনিয়াম পর্বেই। তবু কখনও বইমেলার মাঠে লাউডস্পিকারে বেজে উঠত ‘ডিঙ্গা ভাসাও’ বা ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’। এখনও বাজে বোধ হয় আগামী দিনেও বাজবে। কিন্তু সেই গানের আত্মাটি সম্ভবত থাকবে না। কারণ, সেই গান মানুষের সৃষ্টি অ্যালবামে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাকে তিনি নিজের সঙ্গে করেই নিয়ে গেলেন। তাঁর গান ছিল আক্ষরিক অর্থেই নগর কবিয়ালের গান। যে কোনও আসরে অথবা আসর ছাড়াও গেয়ে ফেলা যেত। বাস্তবে আজীবন রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত ছিলেন প্রতুল। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের কালেই তাঁরা গানের জাগরণ । এদিকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে তাঁকে দেখা গিয়েছে। সম্ভবত প্রতিবাদকেই গান আর জীবনের সঙ্গে একাত্ম করতে চেয়েছিলেন প্রতুল। তাঁর সৃষ্টি গান ভেসে থাকল বাংলার বুকে পলাশফুলের ঝরে পড়া পাপড়ির মতো। যা হাওয়ায় ভাসে না। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। তা সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে গেলে যেতে হয় পড়ে থাকা ফুলের কাছেই। হাতে তুলে নিলে তারা গান হয়ে যায়, কবিতা হয়ে যায়, স্বপ্ন হয়ে যায় দিনবদলের। কিন্তু তার জন্য ওই যে, “যেতে হবে!” দূরে, বহু দূরে, আরও, আরও দূরে…।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন