‘খানাকুল বাঁচাও’ দাবিতে সরব হল এখানকার বাসিন্দারা। এঁদের দাবি খানাকুল প্রতি বছর সংবাদের শিরোনামে। অথচ এখনও পর্যন্ত কোনও সরকার খানাকুলকে দুর্গতির হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। এমনটাই দাবি এখানকার খানাকুল বাঁচাও সোসাইটির। সোসাইটির পক্ষে সমগ্ৰ খানাকুলবাসী পাশে দাঁড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, সোসাইটির দাবি ১৭৮ টি গ্রামের জননী আমাদের খানাকুল। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ সমস্ত ক্ষেত্রেই খানাকুলের অবদান অনস্বীকার্য। রত্নগর্ভা খানাকুল জন্ম দিয়েছে অনেক মহাপুরুষের। এঁরা গোটা বিশ্বকে পথ দেখিয়েছেন। অথচ তাঁদের জন্মভূমি আজ দুর্গতির শিকার। উল্লেখ করতেই হয় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়, ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী, পাটিগণিতের জনক প্রসন্ন কুমার সর্বাধিকারী, প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান, মুম্বাই খ্যাত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রদীপ কুমার, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে খানাকুলের মানুষ অবহেলিত এবং বঞ্চিত। এমনকি হতাশ। সোসাইটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খানাকুলের মানুষের অনেক সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, এই এলাকা বন্যা প্রবণ। বর্ষায় দারকেশ্বর, মুণ্ডেশ্বরী ও রূপনারায়ণের ত্রিফলা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় সমগ্র এলাকা। তবে সম্প্রতি রাজ্য বাজেটে ‘ ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান’ রূপায়ণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হওয়ায় আশঙ্কার কালো মেঘ আরও ঘনীভূত হয়েছে। কারণ বিভিন্ন সর্বভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্র, সেচ দপ্তরের আধিকারিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই প্রকল্পে অভাগা খানাকুলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি যে রূপনারায়ণ নদী শিলাবতী, দারকেশ্বর, মুণ্ডেশ্বরী-সহ সমস্ত নদীর প্রবাহিত জলরাশি আজীবন একাই বহন করে চলেছে তার ড্রেজিং বা পলি অপসারণের কথা ভাবাই হয়নি। খানাকুলকে সরিয়ে রেখে উক্ত প্ল্যান বাস্তবায়িত করা হলে খানাকুলের মানুষের দুর্ভোগ যে চরমে পৌঁছাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রধান শিক্ষক অমিত আঢ্যর মতে সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের বিধ্বংসী বন্যার থেকেও অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি সম্পন্ন বন্যার সম্মুখীন হতে হবে খানাকুলের সাধারণ মানুষকে। বিগত বন্যায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে হাওড়া জেলাকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে ডিভিসির ছাড়া বিপুল জলরাশি বেগোর মুখ থেকে অধিকাংশই (প্রায় শতকরা ৮০ভাগ) দামোদর দিয়ে না পাঠিয়ে মুণ্ডেশ্বরী নদী দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অমিতবাবু আরও জানান, আবার নিম্নচাপের কারণে দারকেশ্বর অববাহিকায় প্রবল বৃষ্টিপাত হলে এই নদীতে কোনো বাঁধ বা জলাধার না থাকায় তার অনিয়ন্ত্রিত জল বহন করার ক্ষমতা নদীর থাকে না। ফলস্বরূপ এই হিসেব বহির্ভূত জলে খানাকুল ও আরামবাগ এলাকায় হড়পা বানের সৃষ্টি হয়। বাস্তবে এই সমস্ত নদীগুলিরই নিকাশ নদী হল রূপনারায়ণ। সেজন্য রূপনারায়ণ নদীকে উক্ত প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা অবশ্যই প্রয়োজন। সেই কারণেই খানাকুলের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, খানাকুলের মানুষ ও রূপনারায়ণ নদীকে এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে অথবা খানাকুল তথা আরামবাগের মানুষের জন্য পৃথক একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে হবে।
এছাড়াও হুগলি, হাওড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর এই তিন জেলার মিলনস্থল নদীবিধৌত খানাকুলের সহিত পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। বছরের অধিকাংশ সময়ই যোগাযোগের অস্থায়ী সেতুগুলি ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। আবার বন্যার সময় খানাকুল সমগ্র রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ন্যায় অবস্থান করে। সেজন্য এই সমস্ত সেতুগুলি পাকাপোক্ত ও স্থায়ীভাবে নির্মাণের জোরালো দাবি উঠেছে। যা খানাকুল সহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির অর্থনৈতিক, সামাজিক সহ সর্বক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন ঘটাবে।
প্রসঙ্গত, সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ মানুষ অনেকে উপহাস করে বলেন, “খানাকুল দেশ বা রাজ্যের মানচিত্রেই নেই”! আবার বানভাসি খানাকুলের সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় — “খানাকুল জলের তলায়”, তবে সত্যিই কি বানভাসি খানাকুলের এটাই পরিচয়? সুতরাং আর বিলম্ব না করে আগাম সচেতন হয়ে, আগামী প্রজন্মের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ ও নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকার অর্জনের জন্য সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে খানাকুলের সমাজ বান্ধব মানুষের গর্জন রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলে আগামী দিনে খানাকুলের মানুষের সমূহ বিপদ। এমনটাই মনে করছে সোসাইটি। তবে একবার সমবেত সাধারণ মানুষের গর্জন রাজধানীকে আন্দোলিত করতে পারলে আরো অনেক বিবিধ সমস্যার সহজ সমাধান ফলপ্রসু হবে। সোসাইটির পক্ষে তাই জোরালো দাবি উঠেছে এখানকার মানুষের সমুচ্চারিত স্বরে আওয়াজ উঠুক — “খানাকুল বাঁচাও”