বাংলাভাষার কত শব্দ যে আরবি-ফারসি-উর্দু থেকে এসেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এতদিন যাকে নিখাদ সংস্কৃত শব্দ ভাবা হচ্ছিল, আজ তাকেই মনে হয়, আরবি-ফারসি থেকে এসেছে। যেমন ‘ময়ান’ শব্দটি। এখানে আমার আলোচ্য আর একটি শব্দ ‘শাহিস্নান’।
ময়দা মাখার সময় তাতে ময়ান না দিলে যে লুচি ‘ফুলকো’ হয় না, কচুরি, নিমকিও খাস্তা বা মুচমুচে হয় না, তা জানার জন্য পাকা গিন্নি হওয়ার দরকার নেই। রান্নাবান্নার পত্রপত্রিকার বিভিন্ন রেসিপিতেও শব্দটি ঘনঘন পাওয়া যাবে। তবে ‘ময়ান’ শব্দটির উৎস নিয়ে কিন্তু পাকা অভিধান-প্রণেতারাও বিভ্রান্ত।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ময়ান শব্দের ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [হিন্দি মোয়ন; তুলনীয় ‘সং √মুদ্– √মোদি (মিশ্রণ) –মোদন > প্রাকৃত* মোয়ণ]। অর্থ, ‘ঠাসিবার সময়ে ময়দায় মিশ্রিত ঘৃত’। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালাভাষার অভিধান’-এ ময়ানের ব্যুৎপত্তি আছে, ‘(এ আন্) [মর্দ্দন বা মলন>]। অর্থ, ‘লুচী, কচুরী, নিমকি ইত্যাদি প্রস্তুতের পূর্বে ময়দা মাখিবার সময় তাতে ঘৃত মিশ্রণ।’ সুবলচন্দ্র মিত্র প্রণীত ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’-এ ময়ান শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে, ‘ময়দা প্রভৃতি মাখিবার সময় নরম করিবার জন্য যে ঘৃতাদি সংযোগ করা হয়; কোমলতাসাধক বস্তু।’ শব্দটিকে ‘বাংলা ভাষায় প্রচলিত’ বলে দায় এড়ানো হয়েছে।
সংসদ বাংলা অভিধানে অর্থ দেওয়া হয়েছে, ‘ময়দা মাখার সময় তাতে যে ঘি মেশানো হয়, বা ময়দায় ঘিয়ের মিশেল।’ শব্দটিকে ‘দেশি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
ঢাকার বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান-এ ময়ান শব্দটিকে দেশি বলা হয়েছে। অর্থ আছে, ‘লুচি প্রভৃতি তৈরির সময় ময়দায় যে ঘি বা তেল মেশানো হয়; ময়দা মাখানোর ঘি’।
গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক অভিধান’-এ ময়ান শব্দটির এন্ট্রি নেই। কেন নেই, সেটাই বিস্ময়ের। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে বাঙালির হেঁশেলের শব্দ ময়ান নিয়ে নানামুনির নানা মত। সংস্কৃত বা তৎসম, হিন্দি, দেশি, বাংলা প্রচলিত, সবই বলা হয়েছে অভিধানগুলিতে।
আবার, আর একটি দিক চিন্তা করে দেখতেই হল। বাঙালির হেঁশেলে মুঘল অনুপ্রবেশ ঘটেছে তো সেই কবেই। মোগলাই খানার রন্ধনকারীকে ‘বাবুর্চি’ বলা হতো। শব্দটি তুর্কি ‘বাবরচী’ থেকে এসেছে। এখন ধনী গৃহে বা হোটেলে সব রাঁধুনিকেই বাবুর্চি বলে। ফরাসি থেকে আসা শব্দ শেফ (Chef) অবশ্য বাবুর্চিকে কিছুটা কোনঠাসা করেছে ইদানীং।
রাঁধুনি, বাবুর্চি, বা শেফ, যাই-ই বলুন না কেন, লুচি, কচুরি, নিমকি বানাতে গেলে ময়দায় ময়ান দিতেই হবে। ময়দা শব্দটি এসেছে ফারসি ‘ময়্দহ্’ থেকে। ময়ান শব্দটি কি তাহলে আরবি-ফারসি থেকে বাংলায় আসতে পারে? অনুসন্ধান চালিয়ে যেতেই হলো। অনেক খোঁজার পর দেখলাম, মোহাম্মদ হারুন রশিদ সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান’-এ মঈন বা ‘ময়িন’ বলে একটি শব্দ আছে। বাংলায় এর অর্থ সাহায্যকারী বা সহায়ক। আরবি ‘মুয়িন’ থেকে বাংলায় এসেছে।
ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমানের ‘আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান’-এ মঈন শব্দটির অতিরিক্ত একটি অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘রসদ জোগানদাতা’। যাই হোক, ময়ান শব্দটির অর্থ ‘সহায়ক’ ধরলে, একটি বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কেমিস্ট্রি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন ‘অনুঘটক’ বলে যে জিনিসটি আছে, তা রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এর ভূমিকা সহায়কের। লুচি ভাজার সময় ময়দার নেচির ঘি বা তেল কড়াইয়ের তরলে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়, তা লুচিকে বেশি ফুলতে সাহায্য করে। একই সূত্র প্রযোজ্য কচুরি ও নিমকির ক্ষেত্রেও। পরিমাণমতো ময়ান খাস্তা করে কচুরি ও নিমকিকে।
তাই আরবি মঈন বা ময়িন থেকে ময়ান এসেছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ময়দা যদি ফারসি থেকে আসতে পারে, ময়ান আরবি থেকে আসতে দোষ কোথায়?
বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ময়ানের সম্পর্ক কী? তিনি যেমন বিদ্যার সাগর ছিলেন, তেমনই ভোজনরসিকও ছিলেন। যদিও ১৮৬৬ সালে স্কুল পরিদর্শন করে ফেরার সময় ঘোড়ার গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে যকৃতে আঘাত পাওয়ার পর তিনি স্বল্পাহারী হয়ে পড়েন। একবার স্কুলপরিদর্শনে গেলে এক মধ্যবিত্ত ছাপোষা ভদ্রলোকের বাড়িতে ভোজনের ব্যবস্থা করা হয় তাঁর। তিনি খেতে খেতে ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন রান্নার। সাদামাটা রান্নাই গৃহস্বামীর আন্তরিকতায় অসাধারণ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে। তাই তিনি মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করছিলেন রান্নার। এই দৃশ্য দেখে এক ধনী ব্যক্তি কয়েকদিন পরে বিদ্যাসাগরমহাশয়কে তাঁর নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ভূরিভোজে আপ্যায়িত করলেন। বিদ্যাসাগর খেয়ে যাচ্ছিলেন সবই, কিন্তু কোনও প্রশংসা বা স্তুতি করছিলেন না রান্নার। এই দেখে গৃহকর্তা বড়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘স্যর, রান্না ঠিক আছে তো?’
বিদ্যাসাগর ছিলেন রসের সাগর। মুচকি হেসে বললেন, ‘ঠিকই আছে, তবে ময়ান নেই।’
গৃহকর্তা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চান, ‘কীসের ময়ান, কীসের?’
বিদ্যাসাগর গম্ভীরভাবে বললেন, ‘মনের ময়ান।’
তার মানে ময়ানের ক্যাটালিস্ট-ভাবমূর্তি বিদ্যাসাগরের সময়েও ছিল।
ময়ান নিয়ে সাতকাহন করার একটাই উদ্দেশ্য, পাকা রাঁধুনিদের এই শব্দের উৎস সম্বন্ধে সচেতন করা। গরম গরম ফুলকো লুচি তৈরি করা তো যে সে রাঁধুনির কম্মো নয়! ময়ান ঠিকঠাক না হলে রান্নাটাই পানসে হয়ে যাবে। আর কোন মহাপুরুষ যেন বলে গেছেন, ‘দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মতো ফুলবি!’
কুম্ভমেলা উপলক্ষে শাহিস্নান শব্দটি এখন বাঙালির ঘরে ঘরে। পুণ্যার্থীদের মুখু মুখে ঘুরছে শব্দটি। মৌনী অমাবস্যায় যখন পারেননি, পারেননি মাঘী পূর্ণিমাতেও শাহিস্নান করতে, মেলার সমাপ্তিতে শিবরাত্রির দিন শাহিস্নান তিনি করবেনই। তাঁকে আটকানোর সাধ্য ভূভারতে কারোরই নেই। তা, এই শাহিস্নান শব্দটি কতটা যুক্তিযুক্ত? কথাটি আদতে ‘সহিস্নান’ ছিল কিনা তা ভেবে দেখার মতো বিষয়। কারণ সঠিক সময়ে তিথি-নক্ষত্র মেনে ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নানটাই হলো ‘সহিস্নান’ ওরফে শাহিস্নান। ‘সহি’ কথাটি হিন্দিতে ঠিক-অর্থে বহুলব্যবহৃত শব্দ। এসেছে আরবি সহীহ্ থেকে। আর স্নান যে সংস্কৃতজাত বা তৎসম শব্দ তা সকলেই জানেন। সহি হাদিস, সহি তরিকা, সহি বাত, সহি আন্দাজ, সহি দিশা, — শব্দবন্ধগুলি আমাদের খুব চেনা। উল্লিখিত প্রথম চারটি শব্দবন্ধ যদি আরবি-ফারসি-উর্দুর মধ্যে মিলনোদ্ভূত শব্দবন্ধ হয়, তবে পঞ্চমটি আরবি ও সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের মিলনের ফসল। এই গোত্রের শব্দ বা শব্দবন্ধই হল সহিস্নান। উত্তর ভারতীয় সাধু-সন্ন্যাসীদের মুখের চালু লব্জ ‘সহিস্নান’ মুঘল আমলে বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতার যুগে লোকমুখে ‘শাহিস্নান’ বলে পরিচিত হল। পুরোটাই অপভ্রংশের পরিণতি। এখন কোনও কোনও মিডিয়ায় বা কাগজে শাহিস্নানের বাংলা রাজকীয় স্নান করা হচ্ছে। না, মশাই কাজটি মোটেই ‘সহি’ হচ্ছে না। সহিস্নানেই ফেরা দরকার ছিল।
শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মঞ্চে মঞ্চে ঘুরে বক্তৃতা দিলেই হবে না, আমাদের গণ্যমান্য ভাষাতাত্ত্বিকদের শব্দের ব্যুৎপত্তির দিকেও নজর দিতে হবে। তাতেই বাংলাভাষার আখেরে লাভ হবে। এখন আমাদের মধ্যে কোনও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নেই, তবে যাঁরা আছেন, তাঁরা যেন গানবাজনা ও বাচিক শিল্পের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেন, ভাষার শিকড়ের দিকেও নজর দেন।