ভারতব্যাপী রামকৃষ্ণের উপদেশ ও বাণী ছড়িয়ে দিতে ১৮৯০ সালে সেদিনকার এক তরুণ সন্নাসী বরাহনগর মঠ থেকে বেরিয়েছিলেন মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে। কথায় বলে,সবটাই আগে থেকে লেখা থাকে। মাদ্রাজ থেকেই যে তাঁর শিকাগো যাত্রা শুরু হবে, তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না। নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে বিবেকানন্দ শিকাগোতে পৌঁছান বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করতে। ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো ধর্ম-মহাসভায় তাঁর ঐতিহাসিক বক্তব্য বিশ্ববাসীর মন জয় করে। এরপর চার বছর বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণ করে দেশের উদ্দেশে রওনা দেন।
প্রায় সাত বছর পর ভারতের আত্মা আবার দেশে ফিরলেন বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ হয়ে ১৮৯৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি। প্রথমে তিনি অধুনা শ্রীলংকার কলম্বোতে এসে পৌঁছান, এরপর দক্ষিণ ভারতের রামনাদে আসেন।এইখানে তাঁর আগমন উপলক্ষে একটি চল্লিশ ফুট লম্বা স্মারক নির্মিত হয়।
এরপর তিনি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অগ্রসর হয়েছিলেন বিজয় বীরের সম্বর্ধনা পেতে পেতে।
ওই বছরেই কলকাতা প্রত্যাবর্তনের জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি চেন্নাই (পূর্বতন মাদ্রাজ) থেকে তিনি এসএস মোম্বাসা জাহাজে করে রওনা হন। ১৮ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে তিনি বজবজ বন্দরে এসে উপস্থিত হন। পরের দিন অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারির ভোরে রেল কর্তৃপক্ষের বিশেষ ব্যবস্থায় বজবজ স্টেশন থেকে তিনি শিয়ালদার উদ্দেশে রওনা হন। সেদিন ভোরে শিয়ালদহে প্রায় ২০ হাজার মানুষ স্বামীজিকে দেখতে ছুটে আসেন।
তাঁদের সমবেত হর্ষধ্বনির মধ্যে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ স্বামীজির ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছয়। স্বামীজি ট্রেন থেকে নামলে যাঁরা কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে থাকেন। আর যাঁরা দূরে ছিলেন তাঁরা সমবেত কন্ঠে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠেন, ‘জয় পরমহংস রামকৃষ্ণদেব কি জয়।’ ‘জয় স্বামী বিবেকানন্দ কি জয়।’
এরপর ভিড়ের মধ্যে থেকে কোনরকমে স্বামীজিকে বের করে একটি ঘোড়ার গাড়িতে ওঠানো হয়। কিন্তু গাড়ি ছাড়ার আগেই একদল ছাত্র এসে গাড়ির ঘোড়া খুলে দিয়ে নিজেরাই স্বামীজিকে টেনে নিয়ে চলে রিপন কলেজের (বর্তমানের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের) দিকে। তাঁর গাড়িকে অনুসরণ করে চলে এক বিরাট শোভাযাত্রা৷ অংশ নিয়েছিলেন বহু মানুষ, বেশ কয়েকটি গানের দল এবং সাড়ি দিয়ে চলা বহু ঘোড়ার গাড়ি। রিপন কলেজে স্বামীজিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই অভূতপূর্ণ শোভাযাত্রা ও সংবর্ধনা দেখে স্বামীজি নিজেও অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। সংর্ধনার উত্তরে তিনি দুই একটি ধন্যবাদ সূচক কথা বললেন মাত্র।
এরপর বিশাল শোভাযাত্রা করে আলমবাজার মঠে স্বামীজিকে নিয়ে আসা হয়। আজো এই ঐতিহাসিক দিনটি স্বামীজির ঘরে ফেরার দিন হিসেবে পালিত হয়।
স্বামীজি আলমবাজার মঠে পদার্পণ করার পরে স্বামী যোগানন্দ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁকে নিয়ে যান বাগবাজারে পশুপতিনাথ বোসের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। এখানে স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর কয়েকজন গুরু ভ্রাতার দেখা হয়। তাঁরা হলেন, স্বামী ব্রহ্মানন্দ এবং কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। সন্ধ্যাবেলায় স্বামীজি আলমবাজার মঠে চলে আসেন। এখানেই তখন সব সন্ন্যাসী গুরু ভাইয়েরা থাকতেন, এটাই তখন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ। স্বামীজি যখন শেষবার ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলেন সেই সময়েই রামকৃষ্ণ মঠ বরানগর থেকে আলমবাজারে উঠে এসেছিল। তাই, বিশ্ববিজয়ী স্বামী বিবেকানন্দের আলমবাজার মঠে প্রথম পদার্পণের তারিখটিও এই ১৮৯৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি।
আলমবাজার মঠে পদার্পণের দিন স্বামীজি কোনো বক্তৃতা দেননি। কলকাতায় স্বামীজি প্রথম বক্তৃতা দেন ২৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাড়িতে (রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে) এবং দ্বিতীয় বক্তৃতাটি দেন ৪ মার্চ। সে সময় ভারত বর্ষের রাজধানী ছিল কলকাতা। স্বামীজীর এই অসাধারণ বক্তৃতা দুটি কলকাতাবাসীদের মন অতিক্রম করে আপামর ভারতবাসীর হৃদয় জয় করে নেয়। এই ঘটনাকে স্মরণ রাখতে আজ একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।
আজ পূর্ব রেলওয়ে শিয়ালদা বিভাগ স্বামী বিবেকানন্দের কলকাতা প্রত্যাবর্তনের ১২৯তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে। সুসজ্জিত স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির সামনে বজবজ স্টেশনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। রেলপথ মন্ত্রণালয়, ভারত সরকার পূর্ব রেলের সদর দপ্তর অশ্বিনী বৈষ্ণব আরপিএফ ইত্যাদির সহযোগিতায় একটি বিশেষ ট্রেন স্বামীজি সুশিক্ষিত মূর্তিটি নিয়ে শিয়ালদার দেশের রওনা হয়। সঙ্গে ছিলেন বেশ কিছু সন্ন্যাসী, ভক্তরা। আগে থেকে শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে কলকাতা অদ্বৈত আশ্রমের পরিচালনায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এখানে বিভিন্ন সাধু সন্ন্যাসী ইস্টার্ন রেলওয়ে এবং কলকাতা পুলিশের প্রতিনিধিবৃন্দ গন স্বামীজিকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রাটি স্বামীজীর বাড়ি, বলরাম মন্দির, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ এবং উত্তর কলকাতা বরানগরে বিভিন্ন স্থানে পরিদর্শন করে। সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা এসে পৌঁছায় আলমবাজার মঠে।
এবার বলি আলমবাজার মঠের ইতিহাস —
১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রামকৃষ্ণ আন্দোলনের দ্বিতীয় মঠ আলমবাজার মঠ শুরু হয়। দক্ষিণেশ্বর মন্দির উদ্যানে শ্রীরামকৃষ্ণ যে আধ্যাত্মিক বন্যার সূত্রপাত করেছিলেন, তার ফলে নতুন রামকৃষ্ণ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, যা ১৮৮৬ সালের শেষের দিকে কলকাতার কাছে গঙ্গার পূর্ব তীরে অবস্থিত বরানগর মঠে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বামী প্রভানন্দের লেখা থেকে জানা যায় — বরাহনগরের পোড়ো বাড়িটির জীর্ণতরদশা, মঠবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি, মালিকদের বাড়ি ছাড়বার জন্য তাগাদা-সহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দর উদ্যোগে শুরু হয় নতুন ঠিকানার খোঁজ। শেষপর্যন্ত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে, আলমবাজারে মেলে এই বাড়ির সন্ধান।
প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বরানগর মঠটি ২ বিঘা ২২ বর্গফুট জমিতে আলমবাজারে স্থানান্তরিত হয়। রামকৃষ্ণ মঠ নামটি তখনও তৈরি হয়নি এবং তাই পবিত্র স্থানটির নামকরণ করা হয় আলমবাজার মঠ।
মঠের ভবনটি ভূতের ঘর হিসেবে পরিচিত ছিল কারণ এখানে দুজন ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।আর সেই কারণে, মাত্র ১১টায় এই বাড়িটি ভাড়ায় পান মহারাজরা। এখানেই ঠাকুরের ব্যবহৃত জুতা, কাপড়, পূজার জন্য ব্যবহৃত বাসনপত্র এবং অন্যান্য সমস্ত জিনিসপত্র সম্বলিত পবিত্র কলসটি বরানগর মঠ থেকে নতুন মঠে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। নতুন মঠটি বরানগর মঠের মতো কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনা এবং দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনের ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছিল।
আলমবাজার মঠ ছিল মহান রামকৃষ্ণ আন্দোলনের একটি মূল ভিত্তিপ্রস্তর। এটি সেই স্থান যেখানে পূর্ববর্তী বরানগর মঠের রামকৃষ্ণ সন্ন্যাসীদের আশ্রম জীবনকে ব্যক্তি মুক্তি এবং মানব কল্যাণের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এটি সেই স্থান যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা কল্পনা করেছিলেন এবং তাঁর গুরুদেবের নামে ভবিষ্যতের মঠের জন্য নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছিলেন।
পরবর্তী এক বছর স্বামীজি দার্জিলিং, আলমোরা, শ্রীনগর লখ্নৌ ইত্যাদি স্থান পরিদর্শনে যান। সেইসময়ে কলকাতা আলমবাজার মঠে আনুমানিক ৫০ দিন ছিলেন। মঠে থাকাকালীন স্বামীজীর ছোট আকারে একটি নিয়মাবলী তৈরি করেন। শুরুতেই তিনি উল্লেখ করলেন, ‘শ্রীভগবান রামকৃষ্ণ প্রদর্শিত প্রণালী অবলম্বন করে নিজের মুক্তি সাধন করা ও জগতের সর্বপ্রকার কল্যাণ সাধনে শিক্ষিত হওয়ার জন্য এই মঠ প্রতিষ্ঠিত হলো।’
নতুন আলমবাজার মঠের মন্দিরটি প্রথম তলায় অবস্থিত ছিল। তৎকালীন সময়ে এটিকে “হল” বলা হত। পরিচিত নিচতলার পূর্ব দিকের বড় কক্ষে, ভাই শিষ্যরা একসাথে একটি পুরানো ছেঁড়া কম্বলে ঘুমাতেন। দিনের বেলা স্বামীজি হলটিতে ক্লাস নিতেন এবং নবসন্ন্যাসীদের অনুপ্রাণিত করতেন।
আলমবাজার মঠে প্রথম দু-তিন বছরের স্বামী বিবেকানন্দ ব্রহ্মানন্দ ও তুরিয়ানন্দ ছিলেন প্রধান। পরবর্তীকালে তুলসী, গুপ্ত, কালীকৃষ্ণ, বড় কানাই, দিনু প্রভৃতি স্বামীজির মঠে প্রত্যাবর্তনের পরেই আলমবাজার মাঠে যোগদান করেছিলেন। অভিজ্ঞ সন্ন্যাসীরাই প্রীতির বন্ধন দিয়ে নবাগতদের মঠের আদর্শ ও রীতিনীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে তাদের আত্মগোষ্ঠীভুক্ত করে নিয়েছিলেন। সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় একেই বলে সোসিওলাইজেশন। স্বামীজি বলতেন, রামকৃষ্ণ মানুষের চরিত্র গড়ে তোলার শিক্ষা দিতেন।
আলমবাজারে মঠের প্রথম দিকের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। এতটাই অভাব ছিল যে ঠাকুরকে মিছরি শরবত ভোগ দেবার জন্য দু-চার পয়সাও থাকতো না। কখনো কখনো ঠাকুরের কৃপায় হঠাৎ করেই স্বর্গীয় মুখোপাধ্যায়ের পত্নী এক কুদো মিছরি, মালসাভরা নবীনের রসগোল্লা এবং ঠাকুর সেবায় অনন্য দ্রব্যাদি ঠাকুরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আগে ছিল ১৮৯৫ সালে প্রথম ভাগের স্বামী অখন্ডানন্দের বিবরণের কিছু জানা যায় মঠে প্রায় সময়ের ডাল ভাত ও চচ্চড়ি খেত খাওয়া হত। কখনো কখনো ডালের সঙ্গে ফালাফালা করে কাটা নারকেল দিয়ে তরকারির স্বাদ মেটানো হতো। রাতে যদি কেউ ঠাকুরের সেবার জন্য দুধ পাঠাতেন, তখন ‘বিড়ালের ভাগ্যে শিক ছেঁড়া’র মত অবস্থা হতো।… [ক্রমশ]
তথ্যঋণ : স্বামীর সুবীরানন্দ মহারাজের বক্তব্য (ইটিভি ভারত), স্বামী ঋতানন্দ, অন্যান্য।
খুবই তথ্য বহুল লেখা।
ধন্যবাদ