পরদিন সকালেই রওনা দিতে হবে হ্যানয়ের উদ্দেশ্যে। সকালে তাই আবার রোয়িং। উপসাগরে চুনাপাথরের গুহার ভেতর দিয়ে যাওয়া। প্রাতরাশ সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। তারপর নৌকোবিহার, একটি নৌকোতে ছ-জন যেতে পারে।
তরতর করে বইছে তরী, বইছে খোলা বাতাস, মুক্ত আমি, মুক্ত তুমি, মুক্ত যে এই আকাশ। আপনমনে আপন কথা বলার এই অভ্যেস তো অনেক পুরনো।
চুনাপাথরের গুহামুখের ভেতরে ঢুকছে তরী ১
এবার গুহার ভেতর ঢোকা হলো। অতঃপর বেরিয়ে যাওয়া হলো। অন্ধকার থেকে আলোর মুখ যখন দেখা যায় তখন উচ্ছল অনুভবটি হয়। এটা প্রতিবার হয়েছে।
আলোর আহ্বান ২
অতঃপর ফেরা হলো ক্রুজে। এখনই নাকি লাঞ্চ এর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে সারাদিন এবং রাতের বেশ অনেকটা সময় ঘোরাঘুরি, আজ বেশ রাতের দিকে কলকাতা ফেরার উড়ান। কী জানি কীভাবে কী হবে! থাক, ভেবে কী হবে। শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সেই বাণী স্মরণ করাই ভালো — “যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন”। এতো সুন্দর এবং বাস্তবানুগ উপলব্ধির সত্যিই কোনও বিকল্প হয় না। সুতরাং চলো তো এখন, আপাতত লাঞ্চ তো সারি। এদের আতিথেয়তা চমৎকার, এককথায় অনবদ্য।
অতঃপর — ফেরি এগিয়ে চলেছে, ক্রুজের সামনে দাঁড়িয়ে সব কর্মীরা হাত নাড়ছে। কেমন একটা মন খারাপ করা ব্যাপার, মনে হলো এই মানুষদের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। এরাও হয়তো ক্রুজের কাজে থাকবে না সবসময়। অন্য কোথাও কাজ নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। ফেরিতে লটবহর তুলে ওয়েটিং লাউঞ্জ পর্যন্ত ম্যানেজার এসে পৌঁছে দিয়ে গেল।
আশ্চর্য! সেই ওয়েটিং লাউঞ্জে পা দিয়েই দেখি অস্ট্রেলিয়ার টিমটা আরেকটি ফেরিতে এসে পৌঁছেছে। একসাথেই মানে পাশাপাশি ফেরিতে আমরা রওনা হয়েছিলাম, আবার একইসাথে ফিরে এলাম। কী আশ্চর্য নিয়মানুবর্তিতা। একেবারে অবাক করার মতো। আমরা এটা ভাবতেই পারিনা।
যা লিখছি তার নাম দিয়েছি ভিয়েতনামের গল্প। তার একটা কারণ রয়েছে। ঘটনার অনুক্রম বজায় রাখতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। অর্থাৎ আজ যা যা ঘটলো বা যে যে জায়গায় গেলাম, সেটা হয়তো বা গতকাল ঘটেছে, তাই বলে সেটা ঘটেনি তা নয়, ঘটেছে। এটা লিখব এমন কোনও অগ্রিম প্ল্যান না থাকায় এমনটা হয়েছে। যাই হোক, আপাতত এগোই। আমাদের এবার নিয়ে যাওয়া হলো বাঁশের হস্তশিল্পের প্রদর্শনী শালায়। একই রকম সবকিছু, অর্থাৎ হো চি মিন সিটিতে যা যা দেখেছি, এখানেও তাই। তবে এবারে কিছু কেনাকাটা হলো।
হ্যানয়ে বাঁশের তৈরি হস্তশিল্পের প্রদর্শনী শালায় ছবি ৩
দুপুরে আবার লাঞ্চ হলো। একইদিনে দু’দুবার লাঞ্চ।
বেশ ভারি ভারিক্কি কিম্বা ভারাক্রান্ত হলাম সকলেই। এই করতে করতেই বিকেল তিনটে পেরিয়ে গেছে। গাইড বলল – এখন তোমরা আমাদের মিউজিয়াম ও পার্লামেন্ট হাউস দেখে আসবে। কিনতু মিউজিয়াম এখন বন্ধ হয়ে গেছে। চারটে বেজে গেছে। ওখানে আমাদের রাষ্ট্রনেতা শুয়ে আছেন।
— মানে?
— হো চি মিন বিয়ে করেননি। খুব সিগারেট খেতেন। তবে দেশবাসীকে বলে গিয়েছিলেন, আমি বিয়ে করিনি, কিন্তু তোমরা করবে। আমার মতো সিগারেট খেয়ো না, আর আমার মৃত্যুর পর যেন দেহের অন্ত্যেষ্টি হয়। বাকি কথাগুলো দেশবাসী শুনেছে, কিন্তু শেষ কথাটি শোনেনি। হো চি মিনের মৃত্যুর পর সবাই স্থির করল আমরা আমাদের ভালবাসার নেতার দেহ সংরক্ষণ করব এমনভাবে যেন দেখলে মনে হয় তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা এলেন এবং ভিয়েতনামের বিজ্ঞানীরা তাঁদের সহযোগী হলেন। দেহ সংরক্ষণ করা হলো। খুব খারাপ লাগছে আপনাদের দেখা হলো না, দেখলে মনে হয় দেশনেতা এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছেন।
মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। হ্যানয় ঘুরে গেলাম, মিউজিয়ামের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু মহান রাষ্ট্রনেতা হো চি মিনের সংরক্ষিত দেহ দেখা হলো না।
হ্যানয় মিউজিয়াম যেখানে মহান রাষ্ট্রনেতা হো চি মিনের দেহ সংরক্ষিত আছে ৪
মিউজিয়ামের উল্টোদিকে পার্লানেন্ট হাউস। বেশ প্রশস্ত পার্লামেন্ট হাউস ও মিউজিয়ামের সামনের এলাকা। ল্যাম বলল, এখানেই সবার কিছু হাঁটা দরকার। আজ তো দু, দু-বার লাঞ্চ হয়েছে। বেশ খানিকটা হাঁটার পর আমরা ফের বাসে উঠলাম।
পার্লামেন্ট হাউস, হ্যানয়। ৫
আমরা চলেছি কোথায়? ল্যাম বলল — এখন শপিং এরিয়াতে যাবো। পুরো তিনঘণ্টা কাটিয়ে তারপর ডিনার তারপর এয়ারপোর্ট। প্রমাদ গুনলাম। তিন ঘন্টা? কি কিনব? এমনিতেই বেশ খানিকটা কেনাকাটা হয়ে গেছে। সেরেছে। কোথাও বসার জায়গা কি আছে। ল্যাম বলল — শপিং এরিয়ার একটা পয়েন্ট এ সে নামিয়ে দেবে এবং যাতে কেউ না হারিয়ে যায় সেজন্যে সেই পয়েন্টের ছবি তুলে রাখতে হবে।
এই সেই পয়েন্ট যেখানে ছবি তুলে রেখে শপিং এলাকার দিকে এগিয়ে গেলাম ৬
এগিয়ে গেলাম তো বটে, কিন্তু কি কিনব, কিছু কেনাকাটা হলো। ফুটপাতে দেদার খানা চলছে। একটা হৈ হৈ ব্যাপার। একটা ভিয়েতনামের যুবকের খাবার প্লেটে ধবধবে সাদা ভাত। আর কিছু নেই। যুবকটি মন দিয়ে খেয়ে চলেছে। এরমধ্যে একটি বুড়ো রিকশাওলা এসে বলল সে আমাদের একটু ঘুরিয়ে আনতে চায়। কেউ কারো ভাষা জানি না। তবু দিব্যি হাবিজাবি কথা চালিয়ে যাচ্ছি। লোকটা হেসে হেসে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। সে আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমরা হেসে হেসে বলছি আমরা বাইরের লোক, কিছুই চিনি না। লোকটা বলছে, আরে তোমাদের এই সামনে থেকে খানিকটা ঘুরিয়ে এনে ঠিক এখানেই ছেড়ে দেব। শেষ পর্যন্ত গেলাম না। লোকটার মন খারাপ করে চলে গেল। কিছু করার নেই, এই রাতে পথ হারিয়ে ফেললে ভারি বিপদ। আমরা সেই ল্যান্ডমার্ক পয়েন্ট এ ফিরে এলাম। ধীরে ধীরে হাঁটছি, আবছায়া আলোয় দেখতে পেলাম অদূরেই একটা পার্ক রয়েছে, আমরা এগিয়ে গেলাম। বাহ চমৎকার একটি পার্ক, বসার ব্যবস্থা আছে। তবে সবগুলো ভর্তি, আমি তখন বসতে পারলে বর্তে যাই। দুজন ভিয়েতনামী যুবক উঠে জায়গা ছেড়ে আমাদের বসতে বলল। একেবারে হৃদয় থেকে ধন্যবাদ দিলাম। সামনেই একটি বেশ বড় জলাশয় ঐ জলাশয় ঘিরে গড়ে উঠেছে পার্ক। জলাশয়ের এপার ওপার সংযোগ করেছে এক বাহারি সেতু।
ঐ সেতুর ওপর টুরিস্টদের ভিড়, বাহারি সেতুর ওপর মায়াবী আলো। যেখানে বসেছি তার একেবারে পাশ ঘেঁষে একটি দোকান, এক যুবক ও এক মহিলা দোকান চালাচ্ছে। যুবকটি জলাশয়ে বঁড়শি ফেলেছে। একটু পর পর বঁড়শি তুলে দেখছে মাছ ধরা পড়ল কিনা, তারপর চার বদল করছে। দোকানটিতে বিক্রিবাটা তেমন নেই।যে সব পশরা তারা সাজিয়ে রেখেছে তার মধ্যে রয়েছে বড় সাইজের আম আর প্রক্রিয়াজাত শুকনো ফলের প্যাকেট। আম কাঁটাল ড্রাগন ফ্রুট, তরমুজ ইত্যাদির প্যাকেট। এই সময়ে বঁড়শিতে একটি মাছ ধরা পড়ল। ঝকঝকে মাঝারি সাইজের মাছ। আমি মুগ্ধ হয়ে মাছটির দেহের আকুলতা লক্ষ করছি। বাঁঁচবার জন্যে প্রবল আকূতি। যুবকটি কিছুক্ষণ মাছটাকে মন দিয়ে দেখল। তারপর বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে জলে ছেড়ে দিল। এমন দৃশ্য আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে প্রথম। চমৎকৃত হলাম। যুবকটির হয়তো মাছ ধরাটা নেশা। ধরার পর জলে ছেড়ে দেওয়ার মাঝেই হয়তো সে দারুণ আনন্দ পেয়ে থাকে।
এইসময়ে আমার কাছে এসে বসল এক মহিলা। টুরিস্ট। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। বয়েসে হয়তো আমারই মতো। জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে এলে গো বিদেশিনী? বলল — জার্মানি। তারপর পেছনে কোমরে হাত দিয়ে বলল — পেইন। সো পেইন।
আমারও তো তাই, লো ব্যাক পেইন আমার সাথে সবসময় জড়িয়ে আছে। বললাম — আমারও তাই।
সে বলল- আই দোন্ত নো ইংলিশ।
তারপর তার মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল- আমার একটা ছবি তুলে দাও।
দিলাম। এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে গান বাজনা আর নাচ। দেখলাম যে পয়েন্ট এ আমরা সবাই মিলব সেখানেই নাচ গান হুল্লোড় হচ্ছে।
জার্মান মহিলাটির সাথী এসে বিরক্তমুখে কিছু একটা বলল। মহিলাটি আমাকে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল — ঐ যে বাহারি সেতু, ওখানে যাবার রাস্তাটা চেনো? বললাম — না গো, আমিও তোমারই মতো বিদেশিনী।
মহিলাটি হাত মিলিয়ে হেসে চলে গেল।
পথে পথে এমনই কত মানুষ, বুদবুদের মতো জলের ওপর তৈরি হয়, আবার মিলিয়ে যায়।
ততক্ষণে সবাই একসাথে জড়ো হয়েছে মিটিং পয়েন্ট এ। বাস এসে গেছে, এসে গেছে ল্যাম। এবার ডিনার, অতঃপর এয়ারপোর্ট।
হা লং বে ৭
যাত্রাশেষে ল্যামকে বললাম – আর হয়তো দেখা হবে না। কিন্তু এই যে ছুঁয়ে গেলাম, তা যেন অনন্ত ছায়ারাগ, স্বপ্নের ঘোরে তুমি আর তোমরা বেঁচে থাকবে। সহযাত্রীদের সাথে এয়ারপোর্টে পা রাখলাম, ঘর টানছে এখন। ভারি ক্লান্ত। কিন্তু আবার কোনও একসময় মনে হবে – চলো আবার চলি। ” পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি…. “।
হে ভিয়েতনাম, স্বপ্নে বেঁচে থাকো।
সমাপ্ত