মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে যেতে আর শুয়ে থাকতে পারল না মহাশ্বেতা মাহেশ্বরী। ঘরে এসি চলছে, তবু কপালে, ঘাড়ে বুকের ভাঁজে বিনবিনে ঘাম অস্বস্তি এনে দেয়। একটু ঘন শ্বাস পড়ছে। মধ্য জীবনে পৌঁছে কি পেয়েছেন আর কি পাননি, তার হিসেব করতে মন সায় দেয় না। তবু মস্তিষ্কের কোথাও যেন হিসেবটা চলে। চলতেই থাকে। বসন্ত কাল। সমুদ্রের ধারের দিকের বারান্দা দিয়ে নোনা বাতাস উড়ে আসছে নিশ্চয়ই। ঘর বন্ধ থাকায় তিনি টের পাচ্ছেন না। যখন তখন বারান্দায় বসে থাকাও তাঁর শোভা পায় না। সাধারণ মানুষের চোখে যদি পড়ে যায়, বা যদি কোন সাংবাদিক ওঁৎ পেতে থাকে… পরের দিন কোনো ফিল্ম ম্যাগাজিনের হেডলাইন হয়ে যাবেন তিনি।
“মধ্যরাতে মধুরাতে মগ্ন মহাশ্বেতা”
না তিনি সেটা হতে দিতে পারেন না। তবু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত আড়াইটে। মধ্যরাত। বন্দরনগরী মধ্যরাতে জেগে থাকে, ঘুম এই শহরের চোখে নেই, অনেকটা তাঁর মতই। হাসি এল ঠোঁটের কোণে। হীরের নাকফুল ঝিলিক দিয়ে সঙ্গত করল তাঁর হাসির। তিনি নরম পা ডুবে যাওয়া কার্পেটে রাখলেন। শ্বেতবর্ণা পায়ে সোনার নুপুর নিক্কণ তোলে খুব মৃদু, যেন এ পৃথিবী শুনতে না পায়, মহাশ্বেতা রাতে তাঁর নিজস্ব ঘরের ঘেরাটোপ ছেড়ে বারান্দায় যাবেন। নিজের বাড়িতে নিজের কক্ষ তিনি ত্যাগ করলেন পা টিপে টিপে। দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই রাস্তার আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল একটুক্ষণের জন্য। তিনি চোখে হাত আড়াল করে বারান্দার যেদিকে রাস্তার আলো পড়ছে না, সেদিকে গিয়ে ঝুলায় বসলেন। বিশাল বারান্দা, সমুদ্রের ধারে। না, তিনি এটুকু জায়গা কাচে ঢাকেননি। ঢাকতে দেন নি। তাঁর ভাই বোনেরা সকলেই তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বারান্দা এভাবে অরক্ষিত রাখা ঠিক নয় বুঝিয়েছেন, তবু তিনি এইটুকু জায়গা ঘিরতে দেন নি। এইটুকুই তাঁর স্বাধীনতা।
তিনি মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে এই খোলা বারান্দায় অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন, খোঁজেন, ভাবেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন অনন্তের দিকে… চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রু এসে ভাসিয়ে দিয়ে যায় বুকের বিভাজিকা। ঘরে থাকতে যেখানে বিনবিনে ঘাম জমেছিল… যা তাঁর অপছন্দের। ঘাম হয় সাধারণ মানুষের, তাঁর তো হওয়ার কথা নয়! ঝুলায় দুলতে দুলতে অনন্তের সঙ্গে বাদানুবাদ করতে করতে এক সময় আবার চোখের পাতায় নেমে আসে ঘুম। ভোরের আলো ফোটার আগেই পাখির গানের সুরে সে ঘুম ভেঙ্গে যায় তাঁর। ক্লান্তি আসে, কিন্তু ক্লান্তি তাঁকে মানায় না। মাঝেমাঝে মনে হয় তাঁর, ডাকুক পাখি, আজ তিনি উঠবেন না, আজ রেওয়াজ করবেন না তিনি। কি এমন হবে একটা দিন যদি তিনি সব নিয়মের বাইরে থাকেন! তারপরেই মনে হয়, তিনি অন্য কেউ নন, তিনি মহাশ্বেতা, তিনি সাধারণ নারী নন। তাঁর জীবনধারা অন্যকে অনুপ্রাণিত করে… তিনি সেখানে কিভাবে নিয়ম ভাঙতে পারেন! অতএব সকলের ওঠার আগেই উনি স্নান সেরে সরস্বতী বন্দনায় রত হন। গানের ঘর ভেতর থেকে ভেজিয়ে উনি রেওয়াজ করেন ছটা অবধি। সেসময় এই ঘরে কারোর প্রবেশাধিকার নেই। গোটা ঘরটি দূর্মূল্য কার্পেটে মোড়া। পূর্বদিকে একটি শ্বেতপাথরের বেদীর ওপর পদ্মের ওপর আসীন দেবী সরস্বতী। ব্যস, ঘরে আর একটাও আসবাব নেই। শুধু একটি তানপুরা। মুখোমুখি বসেন ঘন্টা দুয়েক বাকদেবী ও মহাশ্বেতা।
গাড়ির কাচ তুলে মসৃণ ভঙ্গিতে নিঃশব্দে গাড়ি এগোতে এগোতে সিগন্যালে আটকে গেল। এই সিগন্যাল খেলে বেশ কিছু ক্ষণ আটকে থাকো। গাড়ির ভেতর মনোরম ঠান্ডা… সোজা হয়ে বসে আছেন মহাশ্বেতা। উনি কখনোই গাড়িতে গা এলিয়ে বসেন না, সোজা বসে বাইরের দিকে দেখেন। রেকর্ডিং সেরে খুব ক্লান্ত হয়ে ফিরলেও সোজা হয়েই বসেন, একটু কাত হয়ে, যেমন সরস্বতী বীণা বাজানোর সময় বসেন, ঠিক ওই রকম। এটা গিরিধারীর মনে হয়। অনেক দিনের পুরোনো ড্রাইভার কাম বন্ধুও। অনেক সময় মুড ভাল থাকলে শ্বেতা গিরিধারীর সঙ্গে অনেক গল্প করেন সুখ-দুঃখের। গিরিধারীর অবশ্য মনে পড়ে না কখনো শ্বেতা ম্যাডামকে রাগতে দেখেছে বলে। উনি সবসময় এরকম শান্ত, সমাহিত। ঠিক যেন দেবী সরস্বতী।
এখন বাইরের দিকে তাকিয়ে শ্বেতা দেখছেন, নগরীর মানুষ কেমন পিলপিল করে ছুটছে অবিশ্রান্তভাবে। এই শহরে মানুষ শুধু নিতে আসে। রুজি রোজগারের সন্ধানে সারাদিন এই শহরটাকে নিংড়ে ছিবড়ে করে নিজের নিজের বাসায় ফিরে যায়, রসটুকুই সবার কাম্য। তারপর এই বয়সের ভারে ধুঁকতে থাকা নগরীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। রোদে তাততে শুরু করেছে শহর। সিগন্যাল পেরিয়ে আর একটু গেলেই রাস্তার ধারে একটা বুড়ো বসে, সেই কবে থেকে, মহাশ্বেতা মনে করার চেষ্টা করেন। বোধহয় তিনি যখন এই নগরীতে স্ট্রাগল করছেন পায়ের তলায় মাটি পাবার জন্য। তখনও ওই বুড়োকে এমনই লাগত। স্টুডিও চত্বরে ঘুরে ঘুরে শ্বেতার যখন খুব তেষ্টা পেত, তখন ওই বুড়োর কাছে এক গ্লাস আখের রসে গলা ভিজিয়ে কি ভীষণ আরাম বোধ করত শ্বেতা। মনে হত আর এক গ্লাস খেলে পুরো তেষ্টা মেটে। কিন্তু গুনে গুনে খরচ করা পয়সা এভাবে নষ্ট করতে মন চাইত না। বাড়িতে বাবা-মা, দুই বোন, দুই ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে যেত। আজও তাকে দেখতে পেলেন, সেই একই ভাবে আখের কল ঘুরিয়ে রস বের করে নিয়ে ছিবড়েগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। ওই ছিবড়েগুলো দেখলে তাঁর কখনো নিজেকে, কখনো এই নগরীর আর কখনো… না সে কথা থাক। সব কথা মুখে আনতে নেই। পাপ হয়। নিজেই নিজের কপালে হাত ঠেকান। গভীর রাতের গোপন কথা দিনের আলোর মুখ দেখে না। গাড়ি নিঃশব্দে রাজহংসের মতো স্টুডিওতে ঢুকে পড়ে, চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। সামনে শুধু গান আর গান, কাজ আর ব্যস্ততা।
“আমি ক্ল্যাসিক্যাল, ঠুংরি, গান শিখেছি। নাচও জানি। আমাকে নেবেন আপনার ছবিতে?” রিনরিন গলার আওয়াজ অনেক সময় স্টুডিওর কারো কাছেই পৌঁছয় না। আবার কেউ কেউ হঠাৎ দয়া পরবশ হয়ে একটা পাউরুটি, একটা কলা, একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেট বন্ধ করে দেয়। মেয়েটির মনে হয় বলে, “ওগো! আমায় ভিক্ষে দিও না, কাজ দাও।” মনে হয়, এই ভিক্ষা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু পারে না। খিদের কাছে হার মানতে হয়। কিছুটা খেয়ে, বাকিটা ব্যাগে ভরে নেয়, বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দেবে বলে। পয়সা না নিয়ে গেলে বাবা মেজাজ গরম করবে, গায়ে হাত তুলবে। কিন্তু ওই বাড়িতেই তাকে ফিরতে হবে। এছাড়া যে আর যাবার জায়গা নেই। এরকম করতে করতেই এক একদিন কাজ জুটে যায়। কোথাও একটু নাচের দৃশ্য, কোথাও কোরাসে গলা মেলানো। সারাদিনের ক্লান্তি মেখে অর্ধভুক্ত শরীরে বাড়ি ফিরেই আবার রেওয়াজে বসিয়ে দেবেন বাবা। গান করতে তার খারাপ লাগে না, কিন্তু সেটা যখন অত্যাচারের জায়গায় পৌঁছে যায়, তখন সব অস্বীকার করতে ইচ্ছে করে। এই সমাজ, এই সংসার, এই পরিচয়, সব। এই বিদ্রোহের ভাবনা খুব ছোট থেকেই মাথায় আসত মহাশ্বেতার। কিন্তু তাকে ছোট থেকে শেখানো হয়েছে, সে অসামান্যা, দেবীর অংশ, তার এমন কিছু করা সাজে না, যা কিনা মানুষ করে। অবিশ্বাস্য হলেও শ্বেতা ছোট থেকেই এই দেবীত্ব মেনে নিয়েছে, মনে মনে খুশি হয়েছে, এই ভেবে… সে অসামান্যা! সে দেবী! তাঁকে জাগতিক কিছু করা মানায় না।
স্বপ্ন দেখার শুরু এগারো বছর বয়স থেকে। আচমকা। প্রথম স্বপ্ন ছিল নানান রঙের জল বয়ে যাচ্ছে, প্রত্যেকটা রঙ আলাদা আলাদা ভাবে বোঝা যাচ্ছে, একটা ঘাটের সিঁড়ি অনেকদূর পর্যন্ত নেমে এসেছে জলের কিনারে, সেই সিঁড়িতে বসে আছে ছোট্ট শ্বেতা, তার পা দুটি ডোবানো ওই রঙিন জলের ধারায়। বারে বারে এই একই স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসত ছোটবেলায়। ছোট্ট পাহাড়ি নদী আর সমুদ্রে ঘেরা গ্রামের নামকরা পুরোহিত শ্যামসুন্দর স্বপ্ন বৃত্তান্ত শ্বেতার মায়ের মুখে শুনে বললেন, “এ মেয়ে কোন সাধারণ কন্যা নয়, ইনি স্বয়ং দেবী সরস্বতীর অংশ।” ছোট্ট গ্রামে কথা চাপা থাকে না। সবাই জানল শ্বেতা দেবীর অংশ। সেই শুরু অন্য সব স্বপ্নের এই দেবীর মাহাত্মের কাছে হার মানা। অন্য সব স্বপ্নের জলাঞ্জলি দেবীর পায়ে সমর্পণ করে আর এক দেবী হয়ে ওঠা। রোজ রাত থাকতে উঠে রেওয়াজে বসা, একদিনও অন্যথা না হওয়া, মুখে সবসময় প্রসন্ন ভাব ধরে রাখতে শেখা। পরিবারের সকলের জন্য দায়িত্ব পালন করা। এসব করতে করতে কখন যেন নিজের নাম আকাশ ছুঁয়ে গেল তার হিসেব রাখা হয় নি মহাশ্বেতার।
যে নগরী একদিন তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, সেই নগরী এখন তাঁর পুজো করে। এটা বেশ ভালই লাগে তাঁর। বসন্তের পর বসন্ত কেটে গেছে জীবনে, হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনেকেই এসে ঘা দিয়েছে, কিন্তু শ্বেতাকে কে যেন নিভৃতে কানে কানে বলে গেছে, “তুমি দেবী, এসব পার্থিব জীবনের ছোঁয়া তোমার জীবনে লাগতে দিও না, হংসের মতো জলে থাকো, কিন্তু জল গায়ে মেখো না।” শ্বেতা শুনেছেন তাঁর কথা। শুধু একবার ভুল করে একজনের কাছে নিজের মন বন্ধক রেখেছিলেন, তখনও এত নাম হয়নি তাঁর। অষ্টেপৃষ্ঠে প্রেমের বন্ধনে ধরা পড়েছিলেন, ওই একবারই। ভেবেছিলেন বিয়ে করে সংসারী হবেন, ছোটো ছোটো ক্ষুদে সদস্য নিয়ে টলমল করবে সংসার। বাবা মায়ের আপত্তি, ভাই বোনদের আপত্তি কিছুই কানে নেন নি তখন। মনে হয়েছিল, দেবীর আবরণ এবার খসে পড়েছে, এবার তাঁর পুরোপুরি মুক্তি। কিন্তু আঘাতটা এল সেই প্রেমের দিক থেকেই। আরও বড় ডিল পাবার স্বপ্ন দেখিয়ে শ্বেতাকে তুলে দেওয়া হলো একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের হাতে। সে রাতটা শুরু হয়েছিল খুব মোহময় পরিবেশে। হাল্কা ড্রিঙ্ক, হাল্কা মিউজিক, নরম আলো, কিছু মহান ব্যক্তিত্বের ভিড়। মহাশ্বেতার মন ভীষণই আনন্দে ছিল, এত বড় একটা প্রোডাকশন হাউসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে। রাত বাড়তে মানুষ কমতে কমতে শেষে আর পাশে কেউ রইল না যখন, শ্বেতা বুঝলেন এটাই ডিল। প্রথমে অনুনয় বিনয়, তারপর পালিয়ে যাবার চেষ্টা, সবই ব্যর্থ হল যখন, আবার কেউ কানে কানে শোনাল কাহিনী।
“তুমি তো অনেক সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থানে রয়েছ ভাই, আমি… আমার কথা একবার ভাবো তো… জন্ম দিলেন পিতা… তারপর কিশোরী বেলায় আমার রূপে মুগ্ধ হয়ে আমি যেদিকে যাই কামপীড়িত হয়ে সেদিকেই নিজের মুখ সৃষ্টি করলেন! তবু তাঁর কোন লজ্জা নেই! লজ্জা, ঘৃণা, ভয় সব আমার, কারণ আমি নারী। তিনি আমায় জন্ম দিয়েছেন, অতএব আমি তাঁর সম্পত্তি। আমি পিতার ভয়ে পালিয়ে গেলাম, তিনি ধরে এনে আমাকে ধর্ষণ করলেন। এমনকি আমি তাঁর ভয়ে জলে ডুবে বাঁচতে চেয়েছিলাম, তিনি সেখানেও আমাকে ছাড়েন নি। কিন্তু আমি দেবী! তাই কুমারীত্ব আমার থেকেই যায়, কি করে থাকে সে প্রশ্ন তুলতে নেই।” ধরা দিলেন মহাশ্বেতা। কারণ তিনি বুঝলেন, এই প্রোডাকশন হাউস তাঁকে রানী করে রাখবে।
শেষরাতে বাড়ি ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শ্বেতা। সেই রাতে স্বপ্নে এলেন দেবী, তাঁর অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে। “কেন কান্নাকাটি করছ সখি! আমার কথা ভাবো তো… স্বয়ং বিষ্ণুকে মন প্রাণ সব দিলাম… কিন্তু উনি জাহ্নবীকে দান করে দিলেন মহেশ্বরের হাতে, আর আমাকে দান করে দিলেন ব্রহ্মার হাতে। কিন্তু ধনসম্পদের দেবীকে ত্যাগ করতে পারলেন না, তাঁকে নিজের কাছে রাখলেন। এত প্রেম, এত বিশ্বাসের কি মূল্য পেলাম বলো তো?” রাত গভীর। মহাশ্বেতা বিস্ময়ে হতবাক। উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু এটা কি করে হয় দেবী? আপনি তো ব্রহ্মার কন্যা, তাই তো বলেছিলেন।” রিনরিন করে হাসলেন শুভ্রা।
“এটাই তো সবাই ভুল করে, সরস্বতী কি একজন হতে পারে? যুগে যুগে, কত সরস্বতী জন্ম নিয়েছেন, ত্যাগ করেছেন, নিজের জীবন, যৌবন, বিদ্যা, সঙ্গীত সব বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, কেউ জানে কি? মানুষ ভাবে একটাই সরস্বতী। আসলে দেবীর মহিমা একবার লেগে গেলে মানুষ এরকমই মনে করে। এবার শ্বেতা প্রশ্ন রাখলেন, “আপনাকে যে দান করে দিলেন বিষ্ণু, আপনি কেন মেনে নিলেন দেবী? আপনি বিদ্যা, সঙ্গীত, কলাবিদ্যায় অনন্যা। তবু আপনি বিষ্ণুবক্ষে স্থান পেলেন না কেন? ছিনিয়ে নিতে পারেন নি অধিকার?” আবার হাসলেন বাকদেবী। বললেন, “তুমি পেরেছো? তুমি তো আধুনিক যুগের নারী। পেরেছো কি সংসারের কথা না ভেবে শুধু নিজের কথা ভাবতে? সেই ছোট্ট থেকে ইক্ষুর মতো শুধু নিষ্পেষিত হচ্ছো, সেটা বুঝতেও পারছ। কিন্তু এই দেবী মাহাত্ম্য ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারছ কি? একবার দেবীর স্বাদ পেয়ে গেলে আর মানুষ হওয়া যায় না সখী।”
ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল মহাশ্বেতার। আর এক মহাশ্বেতা বিদায় নিলেন সেদিনের মত।
আজও সিগন্যাল খেয়ে দাঁড়িয়ে রাজহংসের মতো দুধ সাদা গাড়ি। হঠাৎ কি ভেবে গাড়ির কাচ নামিয়ে আখ পেষাই করা বুড়োকে ইশারায় ডাকলেন মহাশ্বেতা। লোকটার গাড়ির দিকে তাকিয়ে চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। ছুটে এল গাড়ির কাছে। তোতলে বলল, “আপনি! সাক্ষাৎ দেবী সরস্বতী!” বলেই হাত বারে বারে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করতে লাগল। “আচ্ছা, অনেক বছর আগে ঠিক তোমার মতোই একজন এখানে আখের রস বেচতো। সে কে হয় তোমার?”
“আব্বা। কেন?” অবাক হয়ে বুড়ো জিজ্ঞেস করে।
“না, এমনি। তুমি আমাকে এক গ্লাস রস খাওয়াতে পারো?”
কাচের গ্লাস আখের রসের ঢেউ তুলে এগিয়ে আসে সরস্বতীর দিকে।