টাকা মাটি, মাটি টাকা। বলিয়াছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেব। কিছু চ্যাংড়া মানুষ ইহার কদর্থ করিতে ছাড়ে নাই। তাহারা বলিয়াছিল, মাটি অর্থাৎ জমি যে অর্থের আধার তাহা রামকৃষ্ণ বিলক্ষণ জানিতেন; তাই তিনি শিষ্য ও অনুরাগীবর্গকে জমি কিনিয়া রাখিতে বলিয়াছিলেন। কলিকাতা মহানগরী বা সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে যাহাদের জমি ছিল, তাহারা প্রমোটারকে দিয়া কিরূপ সুখে কালাতিপাত করিতেছে, তাহা আমরা সকলেই জানি। না, সে অর্থে রামকৃষ্ণদেব কথাটা বলেন নাই। তিনি বলিতে চাহিয়াছিলেন যে অর্থ সমূহ অনর্থের কারণ। আমাদের শাস্ত্রে আছে, ‘অর্থমনর্থং ভাবয় নিতং/নাস্তি ততঃ সুখ লেশং সত্যম’। অর্থাৎ প্রতি মুহুর্তে ভাবিয়ো যে অর্থ অনর্থের কারণ, ইহাতে লেশমাত্র সুখ নাই। ইদার্নীং কালে সোমনাথ সেনগুপ্ত মহাশয়ের ‘অর্থম অনর্থম’ নামক একটি পুস্তকও আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে।
আমাদিগের মনে হয় আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তারবাবুরাও এক্ষণে এই সত্য অনুধাবন করিতেছেন। বুঝিতেছেন যে টাকাই মাটি করিয়া দিল সব। যাহারা আবেগে ভাসিয়াছিল, তাহারা প্রশ্ন করিতে শুরু করিয়াছে। কোথা হইতে আসিল এত টাকা? কিসের প্রয়োজন এত টাকার? ‘নিউজ দ্য ট্রুথ’ ইউটিউব চ্যানেলের তমাল সাহা মহাশয়, ‘বাংলা বাজার ইউটিউবে’র অনিকেত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় প্রভৃতিরা জুনিয়ার ডাক্তারবাবুদের তহবিল লইয়া পড়িয়াছেন।
তাঁহাদিগের বক্তব্য হইতে জানিতে পারিলাম ৯ আগস্ট আর জি কর হাসপাতালে ভয়ানক ঘটনা ঘটিবার ১২ দিন পরে ২১ আগস্ট ডা. রিয়া বেরা, ডা. প্রিয়া লাখড়া ও আরও একজন ডাক্তারবাবুর নামে স্টেট ব্যাঙ্কে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। ২১ আগস্ট হইতে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সে অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে মোট ৪৪ লক্ষ ৫২ হাজার ১৭০ টাকা। আবার ২৯ আগস্ট ডা. শুভজিৎ সরকারের নামে স্টেট ব্যাঙ্কে আর একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সে অ্যাকাউন্টে ৩০ আগস্ট হইতে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা পড়ে ৬২ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা। আবার ২৬ সেপ্টেম্বর জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের নামে হাইকোর্ট পাড়ায় আবার একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। তাহাতেও কয়েক কোটি জমা পড়ে। একই শহরে কেন তিনটি অ্যাকাউন্ট, কেন পূর্বোক্ত দুটি অ্যাকাউন্টের টাকা শেষোক্ত অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টে জমা পড়িল না, কেন টাকার যথাযথ হিসাব দেওয়া হয় নাই — এসব প্রশ্ন উঠিতেছে।
আমি কিন্তু জুনিয়ারবাবুদের পক্ষ লইব। দৃঢ়কণ্ঠে বলিব যে আন্দোলন চালাইতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। তমালবাবুরা বলিতেছেন আন্দোলনকে ব্যাপ্তি দিবার জন্য জুনিয়রবাবুরা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার আশ্রয় লইয়াছিলেন। সে ম্যানেজারের নাম সম্ভবত অর্ণব পাল। দুর্গাপুরে তাঁহার নিবাস হইলেও কাজকর্ম কলিকাতায়। এই ইভেন ম্যনেজমেন্টের হস্তকৌশলের ফলে আন্দোলন ব্যাপক প্রচার লাভ করিয়াছে। ১৫০ গ্রাম বীর্য, আমি সোমা বলছি, পেলভিক ও কলার বোন ভাঙা, পুলিশ কমিশনারকে শিরদাঁড়া উপহার দেওয়া, দ্রোহের আগুন প্রভৃতি ভাইরাল হইয়াছে। বারবার মিথ্যা বলার ফলে জনমানসে মিথ্যা সত্য বলিয়া প্রতীত হইয়াছে। মিথ্যা এইসব গুজব দ্রুত ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বিখ্যাত রুশ লেখক ইয়াকভ পেরেলম্যান তাঁহার ‘অঙ্কের খেলা’ বইতে দেখায়াইছেন গুজব কিভাবে দ্রুত ছড়ায়।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পক্ষে বলিবার আছে বৈকি। যুগ বদলাইয়াছে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাইয়াছে, তাই প্রচারের ঢঙ তো বদলাইবে। নির্বাচনে জয়লাভ করিবার জন্য পি কে প্রমুখ প্রকৌশলীর সাহায্য গ্রহণ যেরূপ সঙ্গত, তদ্রূপ প্রচারের জন্য ইভেন ম্যনেজমেন্টের সাহায্য গ্রহণও সঙ্গত। বেশ করিয়াছেন জুনিয়রবাবুরা অর্ণব পালের সাহায্য লইয়া।
কিন্তু কথা হইতেছে আখেরে হইলটা কি? ইভেন ম্যানেজমেন্টের সাহায্য শেষমেষ ইঁদুরের মূষিক প্রসব হইল না তো! শাক দিয়া মাছ ঢাকিবার চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল না কি? আর এসবের মূলে সেই অর্থ। কেন সে অর্থকে জুনিয়রবাবুরা দৃশ্যমান করিয়া দিলেন? ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট না খুলিয়া হাতে হাতে দানের টাকা লইলে এত সব কথা উঠিত না।