এক সময়ে বলিউডের গ্লামারস, ইনটেলিজেন্ট আবেদনময়ী সুপারহিট নায়িকা ছিলেন তিনি।নাম জড়িয়েছিল একাধিক তারকার সঙ্গে। কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকার সময় আচমকাই হারিয়ে যায় সেই নক্ষত্র। মানসিক অসুস্থতা, ডায়াবেটিস, ড্রাগের প্রতি আসক্তি একসঙ্গে মিলেমিশে নিঃস্ব করে দেয় গোটা জীবনটাকে।
২০০৫-এর ২০ শে জানুয়ারি, মৃত্যুর তিনদিন পরে জুহুর সাততলা ফ্ল্যাটের ঘর থেকে উদ্ধার হয় তার পচাগলা দেহ। সিনেমার পর্দায় যতটা ভিড়, ততটাই একাকিত্বে ভুগছিলেন নায়িকা। এটাই বোধহয় বিনোদন জগতের খেলা। পরভিন ববির কাহিনি ভুলতে পারেনি সিনে দুনিয়া। জীবন এবং মৃত্যু— যে কাহিনি ঘিরে এখনও কৌতূহলের অন্ত নেই। রহস্যে মোড়া সেই গল্পই আজকের লেখায়।
সত্তরের দশকের শুরু, পর্দা কাঁপাচ্ছেন হেমামালিনী, জিনাত আমনরা। ঠিক সেই সময়েই চমকপ্রদ রূপকথার মত উত্থান হয় মোহময়ী নায়িকা পরভিন ববির। পরভিন সুলতানা ওয়ালি খানজী বাবি। ১৯৪৯ সালের ৪ জুন গুজরাতের জুনাগাড়ে এক গোঁড়া মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন। পরভিনের পিতার নাম ছিলো বালি মহাম্মাদ খান ববি, মা জেমা বখতে বিবি। আহমেদাবাদের মাউন্ট ক্যারমেল হাই স্কুল থেকে পাশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ পাশ করেন ববি। এই কলেজে তিনি বন্ধু হিসেবে পান নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই থেকে মিস ইন্ডিয়া কবিতা সিংকে। তিনি ইংরেজি এবং মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকেই পরভিনের সমস্যা ছিল একাকীত্ব। মাত্র ১০ বছর বয়সেই বাবাকে হারান ববি। ৫৪ কক্ষের বিশাল প্রাসাদে বাস করতেন ববি। বাবা মরে যাওয়ার পর পরিচালিকাদের হাতেই মানুষ হয়েছে পরভিন। কোথাও যেন কোন ভালোবাসা নেই, মায়ের সঙ্গও ঠিক মতো পাওয়া যেত না, সবটাই যেন কৃত্রিমতা। পরভিনের মধ্যে জন্ম নেয় প্রেমের আকুলতা। সামান্য ভালোবাসাটুকু পেলেই তাকে সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইতো।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালে করাচির আত্মীয় জামিল খানকে প্রথম হৃদয় দিল পরভিন। জামিল এক ঝকঝকে যুবক, যিনি সদ্য চাকরি পেয়েছেন পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে। প্রাসাদের মত বাড়িতে জামিল যখন পরভিনের সঙ্গে দেখা করতে আসতো, ঝলমলে হয়ে উঠতো পরভিন। বেশ কিছুটা আনন্দে সময় কাটছিলো পরভিনের কিন্তু ভালোবাসার আকাশে দেখা গেল কালো মেঘ।
শুরু হলো পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। গড়ে উঠল গোরিলা বাহিনী যাদের নামে ইতিহাসে লেখা আছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। তাঁরা চায় পাকিস্তান থেকে মুক্তি। তাদের স্বপ্ন ছিল নিজের দেশ গড়ার যার নাম হবে বাংলাদেশ। এরপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
এই যুদ্ধের ফলে পারভিন ববির আম্মি তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেন করাচির জামিলদের পরিবারের সঙ্গে। তিনি মেয়েকে স্পষ্ট জানালেন, কোনদিন যেন আর জামিলের সঙ্গে পরভিন দেখা না করে বা চিঠি লেখার চেষ্টা না করে কারণ সে সময় শত্রু পক্ষ হয়ে গেছিল পাকিস্তান। আর পাকিস্তানের ছেলের সঙ্গে ইন্ডিয়ান মেয়ের নিকাহ হতে পারে না। শেষ হয়ে গেল পরভিন ববির ভালোবাসা সম্পর্ক। দুই দেশের চরম শত্রুতার মূল্য দিতে হল পরভিনকে। কারণ দুই দেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসাকে সেই সময় সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছিল।
এরপর ১৯৭২ সালে পরভিন কেরিয়ার শুরু করেন মডেলিং দিয়ে। সঙ্গে চালায় নাটক করাও। মডেলিং এর জন্য যেতেন অ্যামেচার ফ্যাশন প্যারেডে। সেখানে আলাপ হয় এক বন্ধুর সাথে, যার বাবা বম্বে ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। এত সুন্দর চেহারা দেখে সেই মেয়ে বন্ধুটি পরভিনকে সিনেমায় নামার কথা বলেন। পরভিন বুঝেছিলেন কাজটা এতটা সহজ নয়। তবুও অদম্য ইচ্ছা নিয়ে পরভিন পারি দিলেন বম্বে।
পরভিন সর্বদা নিজেকে যাচাই করতেন। যাচাই করতে গিয়ে দেখলেন, ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথাবার্তা, নিজেকে সবদিক থেকে আপডেট করতে না পারলে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। শুরু হলো নিজেকে পরিবর্তন এক নতুন অধ্যায়। এতদিনে চেনা ভারতের সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করা সিনেমা নায়িকাদের বৈশিষ্ট্য, পোশাক,স্ক্রিন প্রেজেন্সকে টেক্কা দিয়ে আপাদ মস্তক ওয়েস্টার্ন কালচারের উপস্থিতি নিয়ে ডাকসাইটে সুন্দরী প্রবেশ করলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। ‘স্টিরিওটাইপ’ নায়িকাদের প্রোটোকল ভেঙে পারভিন এলেন স্বতন্ত্র স্বাধীন এক কনসেপ্ট নিয়ে।
১৯৭৩ সালে ‘চরিত্র’ সিনেমার মধ্যে দিয়ে বলিউডে হাতেখড়ি হয় ববির। যদিও ছবিটি ফ্লপ হয়। তবে এতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি ববির। ববির উপস্থিতি নজর কাড়ে গোটা সিনেমা মহলের।
এরপর অভিনেত্রী ১৯৭৪ সালে “মজবুর” ছবিতে তার কাজের জন্য স্পটলাইট অর্জন করেছিলেন। এই ছবিতেও বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। তবে বলিউডের নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এর ঠিক পরের বছর।
১৯৭৫ সালের অমিতাভ বচ্চনের সাথে “দিওয়ার” চলচ্চিত্র যা তাকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল। এই ছবিতে তিনি ‘অনিতা’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মূলত এই ছবির হাত ধরেই প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন পরভিন। ভারতীয় বক্স অফিসে, ছবিটি ₹ ৭৫ মিলিয়ন আয় করেছে। এই সিনেমার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ববিকে। ১৯৭৬ সালে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ তারকা হয়ে ওঠেন পরভিন ববি।
অমিতাভের সঙ্গে পরভিনের জুটি সে সময় নজর কেড়েছিল সকলের। তারা একসঙ্গে মোট আটটি ছবি করেছিলেন এবং সবগুলি ছিল বক্স অফিসে সুপারহিট। পরভিনের মোহময়ী উপস্থিতি আলাদা আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছিল সিনে মহলের।
অমর আকবর অ্যান্টনি, সুহাগ, কালা পাথর, শান, কালিয়া এবং নমক হালালের মতো সুপার হিট ছবিতে অমিতাভ বচ্চন ও পরভিন ববি জুটি বেঁধে কাজ করেন।
একসময় অমিতাভের সঙ্গে পরভিন ববির কানাঘুষো এক সম্পর্কে কথাও শোনা যায়। রাত্রিবেলা অমিতাভ বচ্চনের জন্য তিনি নাকি কাঁদতেন সেই দৃশ্য দেখেছিলেন এক পরিচালক। ঘটনাটি ঘটে ১৯৮০ সালে ‘দোস্তানা’ ছবির শুটিং এর সময়। তখন পরভিন প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত, চিকিৎসা চলছিল বেঙ্গালুরুতে। এই ছবির শুটিং এর সময় পরভিন বেশ কিছু মেডিকেল ইস্যুতে ভুগছিলেন ফলে অমিতাভের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। সেই রাতেই পরিচালক মহেশ ভাট শুটিং সেটে গিয়ে সরাসরি অমিতাভের সঙ্গে কথা বলেন। মহেশ অমিতাভকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তিনি সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরভিনের সঙ্গে কথা বলেন। অমিতাভ পরে পরভিনের সঙ্গে যথেষ্ট সংবিধানশীল হয়েই কথা বলেছিলেন।
মানসিক রোগ ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছিল পরভিনের জীবনকে। পরভিনের ম্যানেজার ছিলেন বেদ শর্মা, দায়িত্ববান অভিজ্ঞ এবং একজন ভালো নাগরিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে ম্যানেজার শর্মা বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম অমিতাভ বচ্চনের প্রতি দুর্বল ছিল, কোনদিনই তিনি তা প্রকাশ্যে বলেননি। অমিতজি সেটি জানতেনই না। তিনি প্রফেশনাল। তাই হয়তো ম্যাডামের সঙ্গে কোন সম্পর্কই টেকেনি।’
পরভিন প্রায় সময় অমিতাভ বচ্চনের উপর নানা রকম দোষারোপ করতেন। তিনি বলতেন, ‘অমিতাভ আমাকে খুন করতে চায় আর তাই তোমাদের সকলকে ও টাকা দিয়ে হাত করেছে। অথচ আমি লোকটিকে প্রথম থেকে….. অমিত আমার সঙ্গে এরকম করতে পারলো!’
ফিল্মিবিট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, একটি ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পরভিন বাবি বলেছেন, “অমিতাভ বচ্চন একজন সুপার ইন্টারন্যাশনাল গ্যাংস্টার। তার গুন্ডারা আমাকে অপহরণ করেছিল এবং আমাকে একটি দ্বীপে রাখা হয়েছিল যেখানে তারা আমার উপর অস্ত্রোপচার করেছিল এবং আমার কানের নীচে একটি ট্রান্সমিটার/চিপ/ইলেক্ট্রনিক বাগ লাগিয়েছিল।”
তিনি বিগ বি-এর বিরুদ্ধে পুলিশেও অভিযোগ দায়ের করেছিলেন এবং তাকে আদালতে টেনে এনেছিলেন কিন্তু পরে অভিনেত্রী সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিলেন বলে তাকে ক্লিন চিট দেওয়া হয়েছিল।
এতকিছুর পরও মেগাস্টার তার অভিযোগ সম্পর্কে বলেছিলেন, “তার অসুস্থতার প্রকৃতি এমন ছিল যে তিনি লোকেদের ভয় পেয়েছিলেন এবং সমস্ত ধরণের অত্যধিক বিভ্রম এবং হ্যালুসিনেশন প্রবণ হয়ে পড়েছেন।
১৯৮৩ সালে, আমি পরভিনকে তার প্রথম লাইভ শো-এর জন্য বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম অথচ তারপর হঠাৎ করেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়!”
১৯৮১ সালের সিনেমা ‘সিলসিলা’-তে রেখা এবং অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অভিনয় করার জন্য পরভিন ববিকেই প্রথমে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে জয়া বচ্চন আসেন সেই জায়গায়। এএনআই-এর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, সিলসিলা থেকে বাদ পড়া মনে গভীর আঘাত এনেছিল পরভিনের। (চলবে)