চব্বিশের লোকসভা ভোটের পর থেকেই বিজেপি বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যতের গায়ে প্রশ্ন চিহ্ণ ঝুলে গিয়েছিল। জোটে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে বহু জল্পনার মধ্যেই আরজে়ডি সুপ্রিমো লালুপ্রসাদ যাদব ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব কংগ্রেসের বদলে অন্য কারও হাতে তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। ইন্ডিয়া জোটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে মনে করলে তা তুলে দেওয়া উচিত বলেছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা। কিছুদিন আগে এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ারও প্রায় একই মত প্রকাশ করেছেন। কয়েকদিন আগে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস দলের নামোল্লেখ না করে বলেন, দিল্লিতে সর্বশক্তি দিয়ে বিজেপি বিরোধী লড়াই চালাচ্ছে আম আদমি পার্টি। বিজেপি বিরোধী জোটের নেতৃত্বে থাকা দেশের প্রাচীনতম দলটির নাম উচ্চারণ না করে জোটের তৃতীয় বৃহত্তম দলের অন্যতম কমান্ড স্পষ্টই বুঝিয়ে দিলেন কংগ্রেসকে ঘাসফুল কাছ ঘেঁষতেই নিষেধ করছে। কেবল তাই নয়, বাংলার বিধানসভা ভোটে যেভাবে আপ, আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি তৃণমূলের দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল একইভাবে যে রাজ্যে যে বিজেপি বিরোধী দল শক্তিশালী তৃণমূল তাদের পক্ষেই থাকবে।
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল একা ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন সবকটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল তখন থেকেই বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোট যেমন প্রাসঙ্গিকতা হারায় একই সঙ্গে না গুরুত্বও হারিয়ে ফেলে। আর সেই কারণেই দিল্লি বিধানসভা দখলের লড়াইতে নেমে আপ ও কংগ্রেস একে অন্যের বিরুদ্ধে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করে চলেছে, এই দুটি দলই আবার খাতায় কলমে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদল। এই অবস্থায় তৃণমূলের পক্ষ থেকে কংগ্রেসের নামোচ্চারণ না করার ইঙ্গিতে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠছে যে, রাজধানীতে আপকে তারা সরাসরি সমর্থন করছে, বিরোধীতা না করলেও তারা কংগ্রেসের পক্ষে নেই। অন্যদিকে বিজেপি বিরোধী মঞ্চ ইন্ডিয়া তৈরি করতে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছিল সিপিএমও, অবশ্য তাতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সীতারাম ইয়েচুরির। কিন্তু ইয়েচুরি প্রয়াত, বর্তমানে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির কো অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত। সিপিএমের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কংগ্রেস সম্পর্কে বরাবরই কড়া অবস্থানে ছিলেন। তাঁর লাইন ছিল বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের থেকে সমদূরত্ব রাখা। সীতারাম ইয়েচুরির জমানায় কংগ্রেস সম্পর্কে সিপিএম নরম মনোভাব নিলেও সম্প্রতি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর কংগ্রেস প্রসঙ্গে সুর বদলের কথা শোনা যাচ্ছে কারণ, বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের লড়াই মতাদর্শগতভাবে জোরদার নয়। অর্থাৎ কংগ্রেস নিয়ে সিপিএম একটু কড়া মনোভাবই নিতে চলেছে।
একদিকে জোটের শরিক দলগুলি কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে একাধিকবার আপত্তি তুলেছে। অন্যদিকে এটাও বুঝতে হবে অন্যান্য দলগুলির বিজেপি বিরোধী জোটে সামিল হওয়ার পিছনে আসল উদ্দেশ্য কী? প্রতিটি দলেরই কি কেন্দ্রে সরকার প্রতিষ্ঠা করাটাই লক্ষ্য নাকি সর্বভারতীয় এবং নিজস্ব রাজ্যের রাজনীতিতে নিজেদের দলের জন্য আরও বেশি গুরুত্ব অর্জন করার লক্ষ্যেই তারা জোটে এসেছে। দেশের প্রবীণতম দল কংগ্রেস এখন আর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দল নয়। আগেকার ইতিহাস ঐতিহ্যের সুবর্ণ অধ্যায়গুলিকে বাদ দেওয়াও যেমন যাবে না তেমনি এখন যে কংগ্রেসের সেই সম্পদের অবশিষ্টটুকু নেই সেটাও মানতে হবে। কারণ, দেশের অধিকাংশ রাজ্য থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস লেখা সাইনবোর্ড ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ রাজ্যে কংগ্রেসের নেতা কে তা কর্মীরাও ঠিকঠাক জানেন না। একই ভাবে কারা ঠিক কংগ্রেসের কর্মী সেটিও স্পষ্ট জানেন না কংগ্রেস নেতারা। কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধী জোট গঠন এবং সেই জোটের নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য কেন্দ্র থেকে হটিয়ে সরকার গঠন করাটা যেখানে লক্ষ্য যেখানে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আপ-এর কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল দিল্লি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমোর অবশ্য কংগ্রেস্র মতোই স্বপ্ন দেখেন কিন্তু তিনি ছেড়ে বেরিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গ তাঁর একেবারেই নাপসন্দ।
এদিকে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আপ কংগ্রেস কেউই কাউকে জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে হরিয়ানায় কংগ্রেসের জেতার প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আপ প্রার্থী দিয়েছিল। আর এবার দিল্লিতে দুই দল একে অপরের বিরুদ্ধে কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি করছে, অথচ এই দুটি দলই বিজেপি বিরোধী জোটের শরিক। অতএব প্রশ্ন, প্রতিশোধ বা প্রত্যক্ষ সংঘাত ছাড়া কংগ্রেসের কি আছে যার কারণে আপ নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ সরিয়ে রেখে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট শরিকের মতো আচরণ করতে পারে।আসলে কংগ্রেস যদি শুধুমাত্র নিজের যোগ্যতা ও ক্ষমতায় লোকসভায় অন্তত দেড়শো আসন জিততে পারতো তাহলে কেউই জোটে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারতো না। তার মানে কংগ্রেসের সামনে একটাই রাস্তা, তাকে সর্বার্থেই একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে হবে। উল্লেখ্য, রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় যে জনসমর্থন অর্জন করেছিলেন তাকে কংগ্রেস রাজনৈতিক পুঁজিতে পরিণত করতে পারলো না কেন। অনেক কারতণ থাকতে পারে, তবে কংগ্রেস আজ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ, দলের রাজনৈতিক পুঁজি তৈরি হলে তার লভ্যাংশ শেষ পর্যন্ত কার ঘরে উঠবে, সেই হিসাবে জড়িয়ে থাকা কংগ্রেস নেতারা স্পষ্ট বুঝতে পারেন না। তাই দিল্লি ভোটে গতবারের শূন্য মার্কশিটের ব্যাপক রদবদল ঘটলেও কংগ্রেস দল পুরনো শক্তি পুরোটাই ফিরে পাবে এমনটা আশা করা ভুল।