এক সময় হুগলির সিঙ্গুর থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় প্রি-মেডিকেল পড়তে যেতাম। তখন জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ডাক্তারিতে চান্স পেলে ডাক্তারি পড়ার শর্ত হিসেবে এক বছর প্রিমেডিকেল পড়তে হত। বাবার লাইন বলে পরিচিত হাওড়া-তারকেশ্বর ব্র্যাঞ্চ লাইনের সিঙ্গুর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে হাওড়া যেতাম। সিঙ্গল লাইন। হাওড়া থেকে ক্রসিং-কন্টকিত সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে সিঙ্গুর যেতে লাগত দেড় ঘণ্টার কাছাকাছি। হাওড়া স্টেশন থেকে ৪৪ বা ৪৪এ বাসে গিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ার। সেখান থেকে রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে মৌলানা আজাদ কলেজ। এখন সেটা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সত্যি বলতে কী, সেই রাস্তায় খালাসিটোলা বলে কোনও মদের ঠেক আমার (নিষ্পাপ) চোখে পড়েনি। পরে কবি রাহুল পুরকায়স্থ আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদিন সেখানে গিয়েছিলাম, মানে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম, এই শতকের শূন্য দশকে। ব-দ্বীপ প্রকাশনার মালিক কল্যাণ সরকারের টালিগঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কল্যাণবাবুর গাড়িতে সন্দীপনবাবু ও আমি কবি রাহুল পুরকায়স্থের সঙ্গে দেখা করতে ইটিভি অফিসে যাই। তিনি তখন ইটিভিতে চাকরি করেন। সেখান থেকে তাঁরা আমাকে বগলদাবা করে খালাসিটোলায় নিয়ে যান। সেখানে খানাপিনা চলছে দেখে গাড়িতেই বসে থাকি। পরে রাহুলদা বলেছিলেন, ‘মাল না খেলে কবি হতে পারবে না’। কবি হতে হয়তো পারিনি সত্যিই, গদ্যেই এখন আমার বিচরণ। তা এই খালাসিটোলাতেই রবীন্দ্রোত্তরযুগের সেরা কবি জীবনানন্দের জন্মদিন পালিত হয়েছিল হাংরিযুগে। সেটা কোনও সভাগৃহে নয়। নয় কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কবিতা পড়ার আসর।
সময়টা ১৯৬৮। হাংরি জেনারেশনের কিছু যুবক হাজির হয়েছিলেন সেইখানে। যেমনটা তাঁরা হাজির হতেন প্রায়ই। জীবনানন্দের জন্মদিন। তাই হাংরি ছোটোগল্পকার অবনী ধর উঠে পড়েছিলেন টেবিলে। যে গানটা গাইতে শুরু করেছিলেন তা নাকি জাহাজের খালাসিদের গান। জাহাজে কাজ করার সময় তাঁর শেখা। (পরবর্তী কালে কবি বেলাল চৌধুরিও জাহাজের খালাসির কাজ করেছিলেন।) উপস্থিত কেউই বিশ্বাস করতে পারেনি যে এটা আদৌ কোনও গান। কারণ এই গানের কথা আমাদের পরিচিত শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে মেলে না। সুরটা নাকি অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে জন্ম নেওয়া সুরকার মোৎজার্টের কোনও সৃষ্টির অনুকরণ। অন্তত এমনটা জানিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরী। তাঁর The Cultural Outsider নামের লেখায়।
আমার এই ধরতাই বা গৌরচন্দ্রিকা আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারীর খালাসিগিরির খোঁজ নিতে। সপ্তদশ শতকের শেষে খুলনার পিঠাভোগের উত্তরপাড়া থেকে কলকাতার গোবিন্দপুরে এসে বাসা বাঁধেন পঞ্চানন ও তাঁর কাকা শুকদেব কুশারী। তাঁরা নাকি জাহাজে পণ্যসরবরাহ করতেন। ইংরেজিতে এদের বলত Stevedore। কেউ কেউ বলেন, তার আগে তাঁরা জাহাজে খালাসির কাজ করতেন। Stevedore -এর কাজ জাহাজে পণ্য জোগানো। তার মধ্যে জল, খাদ্যসামগ্রী, পালের কাপড়, দড়ি যেমন থাকত, জাহাজ নোঙর করা অবস্থায় জাহাজের ডেকে আমোদপ্রমোদের আয়োজনও করতে হত।
খালাসি হন বা স্টিভডোরই হন, পঞ্চানন কুশারীর রক্তে ছিল সংগীতের বীজ। তিনি ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া সুরে ভেসে যাওয়া বঙ্গের ভাঁটির দিকের মানুষ। গান তো তাঁর রক্তে থাকবেই। তবে তাঁর বেড়ে ওঠার সময় তরজা, কীর্তন, গাজন, বোলান গান থাকলেও কবিগান ছিল না।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৫৪ সালে সংবাদ প্রভাকর কাগজে কবিয়ালদের নামধাম ও তাদের গাওয়া গানের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মতে গোঁজলা গুঁই ছিলেন তাঁর খুঁজে পাওয়া প্রথম কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত গোঁজলা গুঁইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম খুঁজে পাননি। হরু ঠাকুর ছিলেন সে যুগের আর এক নামী কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭৩৮-এ। তিনি রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সভাকবি ছিলেন। অরুণ নাগ সম্পাদিত ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইয়ে কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নীলু ঠাকুর নিয়ে সম্পাদনা বিভাগে অনেক তথ্য আছে। হরু ঠাকুরের আসল পদবি ‘দীর্ঘাঙ্গী’। ব্রাহ্মণ কবিয়াল হওয়ায় তাঁর পদবি পাল্টে ‘ঠাকুর’ হয়ে যায়। নীলু ঠাকুরের আসল নাম নীলমণি চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ হওয়ায় তাঁরও পদবি পাল্টে গিয়ে নীল ঠাকুর হয়ে যায়। এরকমভাবে কবিয়াল রামপ্রসাদ ঠাকুর, সৃষ্টিধর ঠাকুর (ছিরু ঠাকুর), রমাপতি ঠাকুর, নবাই ঠাকুর, রামকানাই ঠাকুর, মনোরঞ্জন ঠাকুর, নিমচাঁদ ঠাকুরের নাম আমরা পাই। এঁদের মধ্যে ছিরু ঠাকুর শুধু বদ্যিবামুন ছিলেন (পূর্বপদবি জানা নেই), বাকি সকলে নিখাদ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ কবিয়ালদের পদবি বদলে পাকাপাকিভাবে ঠাকুর হয়ে যেত। উপরোক্ত সকল ঠাকুর পদবিধারী ব্রাহ্মণ কবিয়াল ছিলেন চক্রবর্তী পূর্বপদবির অধিকারী। কেবলমাত্র রমাপতি ঠাকুরের পূর্বাশ্রমের পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
পঞ্চানন কুশারী আসলে ছিলেন খালাসি-কবিয়াল।
তা কবির লড়াইয়ের বীজটা পঞ্চানন কুশারীর রক্তে ঢুকল কীভাবে? তিনি তো তাঁর পূর্বপুরুষের কারও কাছ থেকে এটি শেখেননি। তাঁর বংশে অতীতে কেউ সংগীতপ্রেমী ছিলেন কিনা জানা যায়নি।
তাহলে কি জাহাজের কাজ করতে গিয়েই তিনি কবির লড়াইয়ের আইডিয়াটি পেয়েছিলেন?
আমাদের রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। কারণ এখানে অর্থ উপার্জন নেই, এসব করলে নাম করা যায় না, বিদেশ ঘোরা যায় না।
জাহাজের খালাসি বা স্টিভডোর হলেও তিনি কি এমন কোনও সুযোগ পেয়েছিলেন, যা কাজে লাগিয়ে কীর্তন বা তরজার অন্য একটি রূপ দেওয়া যায়, আঙ্গিকে পরিবর্তন আনা যায়? সেটার সম্ভাবনা কিন্তু ষোলআনা।
এ নিয়েই আমার তত্ত্ব-তালাস। কিছু খোঁজ নেওয়া, কিছু গবেষণা, কিছু কল্পনার মিশেল দেওয়া।
সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকেই জাহাজের ইউরোপীয় খালাসি (Crew) দের মধ্যে Sea-Shanty গানের চল ছিল। অনেকে এটিকে Sea Chanty -ও বলেন। এগুলো এক বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক গীতি, যা গেয়ে নাবিক তথা খালাসিরা তাদের কাজের একঘেযেমি দূর করত। নিজেদের মধ্যে মজামস্করা, আনন্দের পরিবেশ তৈরি করত।
এগুলি কোরাসে গাওয়া হত। একজন মূল গায়ক ধরতাই দিত। বাকিরা ধুয়ো ধরত। কখনও কখনও নিজেদের মধ্যে দল করে একদল অন্যদলের সঙ্গে গানের প্রতিযোগিতায় নামত। বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলিতেও Sea Shanties এর প্রতিযোগিতা হত। এক জাহাজের খালাসি বা নাবিকরা অন্য জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে গানের লড়াইয়ে মাতত কখনও কখনও। একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার লড়াই চলত। তাতে কখনও কখনও কুকথা ও গালমন্দও থাকত। বিশেষত লুকিয়ে থাকা পাইরেটসদের মধ্যে।
পঞ্চানন কুশারী হয়ত নিজে জাহাজে পণ্যসরবরাহ করতে গিয়ে কিংবা Crew-এর কাজ করতে গিয়ে এসব দেখার সুযোগ পেতেন।
এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি কীর্তন, তরজা বা যাত্রাগানের ভোল পাল্টে দিলেন। তার মধ্যে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার ব্যাপারটি আমদানি করলেন। এইভাবে সদ্য গজিয়ে ওঠন কবিগানের একটি নিরীহ ও নিরামিষ ধারাকে লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়ে দিলেন। শুরু করলেন কবির লড়াই। গোঁজলা গুঁই, রঘুনাথ দাস, লালু-নন্দলাল, রাসু-নৃসিংহরা যা পারেননি, পঞ্চানন কুশারী তাই করে দেখিয়েছিলেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চানন কুশারীই গোঁজলা গুঁইয়ের খোঁজ না মেলা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন। তাঁর কথা কাব্যে উপেক্ষিত থেকে গেল কেন, সেটাই এক রহস্য।