জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রামলোচন ঠাকুর তাঁর দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরের জন্যে যে উইল করেছিলেন, তার শেষাংশে তাঁর সম্পত্তির একটি তালিকা দেওয়া আছে। সেটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। সেখানে সম্পত্তির পরিমাণ না দেখে, উল্লিখিত দেনদার বা বিক্রেতাদের নামগুলির প্রতি নজর দিলে সেই যুগটিকে ভালোভাবে অনুধাবন করা যাবে। রামলোচন ঠাকুর যে বঙ্গসংস্কৃতি ও বিবিধ সংগীতানুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তা উইলের নামগুলির মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে।
“জায় জায়গা সোপার্জ্জিত জমিদারি পরগণে বিরাহিমপুর মোতালকে , জেলা জসোহর — ১
সহর কলিকাতার মধ্যে ডোম পিদুরু সাহেবের দরুন জায়গা — ১
বামদেব বাইতির দঃ জায়গা — ১
কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবিরাজের দঃ জায়গা-
তিলক বসাকের দঃ জায়গা — ১
শঙ্কর মুখোপাধ্যায় দঃ বাটী — ১
রামকিশোর মিস্ত্রীর দঃ জায়গা — ১
রামনিধি সাহার দঃ বাটী — ১
রতনরাড়ের দঃবাটী- এবাটী তোমার মাতাকে দিয়াছি — ১
পৈত্রিক — নিজবাটী — ১, ধর্ম্মতলার বাটী — ১,
বড়বাজারের বটতলার বাট — ১
জানবাজারের হাড়িটোলার জায়গা — ১
ডোমটোলার জায়গা — ১ , মাহুতের দঃ জায়গা — ১
কলিঙ্গা ব্রহ্মচারীর দঃ জায়গা — ১
পরগণে মাগুরা মৌজে ফতেপুর ব্রহ্মত্তর জমি — ১
মৌজে কপিলেশ্বর ব্রহ্মত্তর জমি — ১”
এবার এখানে সম্পত্তি তালিকার দেনদার বা বিক্রেতাদের নামগুলি নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করব।
ডোম পিদরু সাহেব —
ডোম পিদরু সাহেব যে জাতে ফিরিঙ্গি ছিলেন তা বোঝাই যাচ্ছে। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহ বারোয়ারি পুজোর আলোচনায় বউবাজারের চুনোগলির ইদরুস, পিদরুস, গমিসডিস প্রমুখ মেটে ফিরিঙ্গির ভলান্টিয়ার হওয়ার লোভের কথা লিখেছেন। যাতে খানাপিনা করার সুযোগ থাকে ভলান্টিয়ার হওয়ার সুবাদে। পর্তুগিজ অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিয়াল হওয়ার কথা কেই বা না জানে। তিনি কবিয়াল ভোলা ময়রাকে কবির লড়াইয়ে হারিয়েছিলেন। তবে তাঁকে কম অত্যাচার সইতে হয়নি সমকালীন রক্ষণশীল হিন্দুদের কাছ থেকে। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় যাঁর কাছে বাঙালির সবিশেষ ঋণের কথা বলে গেছেন, সেই ভোলা ময়রাকে কবির লড়াইয়ে হারানো কম কৃতিত্বের কথা নয়! ডোম পিদরু সাহেব অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির জাতভাই হতেই পারেন।
বামদেব বাইতি —
বাইতি পদবি এখন আর দেখা যায় না। বাইতি মানে ঢোলবাদক, বাদ্যকর জাতি। কে না জানে কবির লড়াই, কীর্তন, হাফআখড়াই ইত্যাদি গানে ঢোল বাজানো আবশ্যিক কাজ ছিল। বাইতি তথা বাদ্যকরদের রমরমা ছিল সে সময়। রামলোচন ঠাকুরের আয়োজনেই যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কবিগান, হাফআখড়াই, কীর্তনের আসর বসত, উৎসবের মেজাজে ঢাকঢোলের আওয়াজে মুখরিত হত প্রাঙ্গণ, বামদেব বাইতির সঙ্গে তাঁর লেনদেনের তথ্য সেটাই প্রমাণ করে। গুপি গায়েন আর বাঘা বায়েনরা যুগযুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করে চলেছে। বস্তুত বাজনদার ছাড়া পুরনো কলকাতার গানের আসর, যাত্রাপালার কথা চিন্তাই করা যায় না।
কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবিরাজ —
সকলেই ভাববেন, ইনি আয়ুর্বেদ-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু কবিরাজ মানে কবিশ্রেষ্ঠও হয়। বস্তুত কবিগানের গায়করা প্রথমযুগে কবিওয়ালা, কবিওলা বলে চিহ্নিত হতেন। বিদ্যাসাগর তাঁর ছেলেবেলায় কবিগানের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে লিখে গেছেন তাঁর ভ্রাতা শম্বুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, তাঁর ‘বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস’ বইয়ে। লিখেছেন, ‘যেখানে কবি হত, সেখানেই জ্যেষ্ঠ যাইতেন’। শ্রেষ্ঠ কবিয়ালকে কবিরাজ বলা যেতেই পারে। কীর্তনগায়ক তথা কীর্তনীয়াদের একটি ধারা নিজেদের কবিরাজ বলে উল্লেখ করে। তাদের পদবিও হয় কবিরাজ। মনে হয় শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজের থেকেই এই ধারার উদ্ভব হয়েছে। সঠিক বলা সম্ভব নয়।
রতন রাড় —
রতন রাড় যে সে সময় কী করতেন, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধানে রাড় শব্দের অর্থ আছে, শূদ্র, ইতরজাতি, দুর্বৃত্ত। রাড় পদবিধারী লোক যে অন্ত্যজ শ্রেণির সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কবিয়ালরাও অনেকে নীচু জাত থেকে আসতো। যেমন, কেষ্টা মুচি। রতন রাড় কোনও ডাকসাইটে কবিয়াল ছিলেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিন-তিনবার তাঁর নাম লেখা আছে উইলে। মনে হয় রামলোচন এঁকে খুবই গুরুত্ব দিতেন।
আরও দুটি জায়গার নাম উল্লেখযোগ্য। বটতলা আর জানবাজার। এখানে যে ধ্রুপদী উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসত, বাইজিদের ধ্রুপদী নৃত্যানুষ্ঠান হত, তা আমাদের জানা। লক্ষ্ণৌঘরানা এখানকার বিশেষত্ব।
এসব পর্যালোচনা করে মনে হয়, রামলোচন ঠাকুরের চেনাশোনা পরিধির মধ্যে গানবাজনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনই বেশি ছিলেন। তিনি ছিলেন গানবাজনার পৃষ্ঠপোষক। সত্যিকারের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। দ্বারকানাথ ঠাকুরকেও তিনি তৈরি করেছিলেন নিজের মনের মত করে।