সম্প্রতি প্রকাশিত “বাস্তুহারার পাহাড়তলি” কবিতা সংকলনে মার্টিন হাইডেগার (Martin Heidegger) — এর নামে একটা কবিতাতে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিংশ শতাব্দীর এই অস্তিত্ববাদী জার্মান চিন্তকের সঙ্গে তাঁর একটা নিবিড় যোগাযোগ-সূত্র স্থাপন করেছিলেন।
কবিদের সর্বাগ্রণী দার্শনিক তুমি, তুমিই তো শিখিয়েছ, ‘মানুষের অস্তিত্বের আবাসন ভাষা’।
ভাষাই যেন আমাদের বাড়ি — হাইডেগার-এর এই মন্ত্রটি অলোকরঞ্জন-এর খুব প্রিয় একটি উদ্ধৃতি, এবং এমন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক : ভাষাকে নিয়ে ভাষার মধ্যে থাকা, প্রতি মুহূর্তেই সেই ভাষাকে ভালোবাসা, বিদ্রূপ, আরও কত রকমের খেলা করার প্রবণতা অলোকরঞ্জন-এর কবি আর ব্যক্তিচরিত্রের এক অবিছেদ্য লক্ষণ।
সেই মার্টিন হাইডেগার একথাও বলেছিলেন যে, গ্রীক আর জার্মান ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় দর্শনশাস্ত্র নেই; আর এটাও জানা কথা যে হাইডেগার হিটলার এর আমলের প্রথম পর্যায়ে হিটলারপন্থী ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে ছিলেন; ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কর্মরত থাকাকালীন ইহুদি অধ্যাপকদের পদচ্যুত করার ব্যাপারে ক্ষেত্র-বিশেষে তাঁর ভূমিকা ছিল যাকে বলা যায় সক্রিয়। ভাষার সীমানা যিনি অতটা অনির্বচনীয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, সেই দার্শনিক যে সঙ্কীর্ণ জাত্যাভিমানে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটা ঘটনা – সঙ্কীর্ণতা যেন ব্যাপ্তিকে নিজের সীমানায় আটকে রেখেছিল।
হাইডেগার-এর ভাষা-প্রেমে প্রভাবিত হয়েও অলোকরঞ্জন হাইডেগার-এর একদেশদর্শিতা (বা দ্বিদেশদর্শিতা)-র ঠিক উলটো দিকে অবস্থান করেন। তাঁর কবিতায় তিনিও বাংলা ভাষার সীমান্তরেখাগুলো নিয়ে অনেক রকম নিরীক্ষা করতেই থাকেন। কিন্তু অলোকরঞ্জন-এর মতো একজন তুলনামূলক সাহিত্যতাত্বিক – সহজলভ্য ব্যাপ্তি যাঁর ক্ষেত্রে সর্বদা কার্যকর — কথায় আর তাত্বিক লেখায় যেমন, কবিতায়ও তেমনই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জিগ্যেস করতে পারি যে ভাষা যদি মানুষের একটা আবাসন হয়, তাহলে অলোকরঞ্জন-এর কবিতা কিরকম বাসস্থান? ব্যাতিক্রমী নিশ্চয়ই — এই গৃহে দশটি দরজা, সাতটি তলা, ত্রিবেণী আর মালকোঠা সুনির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করে না; বসার ঘর বা শয়নকক্ষের মধ্যেকার দেওয়ালগুলো নেই। আমি মনে করি এটা একটা কল্পগৃহ, যেখানে দেওয়ালগুলো সুবিধামতো তৈরি করা যায়। সার্বজনীন আর ব্যাক্তিগত স্তরগুলো আলাদা না থেকে অনেক সময় মিশে যায়। সেই বাড়ির খোলা ছাদের ওপর ভাষার সঙ্গে, ভাষার মাধ্যমে এক খেলা চলতে থাকে।
কিন্তু কবিতার ওস্তাদের কবিতার বর্ণনা কবিতার ভাষায় করাটা আসলে হাস্যকর একটা চেষ্টা। কবিতা নিয়ে ভাষা, ভাষা নিয়ে অলোকরঞ্জন, আর মাঝে মাঝে তাঁর কবিতা আমারও মুখের ভাষা। যেমন বৃষ্টির সময় ছাদের নিচে আমার পড়ার ঘরে বসে থাকলে জলের ফোঁটা যখন টপটপ করে ছাদের ওপর পড়তে থাকে, তখন অলোকরঞ্জন-এর ‘প্লাবনের রাজগৃহে’ মনে পরে। তাঁর পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কবিতায় প্লাবন যতই প্রলয়ধর্মী হোক না কেন, সেই রাজগৃহ যেন হয়ে যায় আমার আপন বাসস্থান, মিশে যায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের সঙ্গে। পৃথিবী টলমল করছে করুক, আমি আপন গৃহে সুরক্ষিত। এভাবে একটা বাংলা কবিতা জার্মান এক চিলেকোঠাকে রাজগৃহে পরিণত করতে থাকে।
গ্রীক-জার্মান বা বাংলা সংস্কৃতির সীমানাগুলো না মেনে তাঁর আরও অনেক কবিতা চারদিকে ভেসে যাক আর আমাদের পরিণতি ঘটাক, এটাই তাঁর অষ্টআশিতম জন্মদিনে আমার কামনা।
হানস হার্ডার : জন্ম ১৯৬৬। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এর অধ্যক্ষ। একাধিক বই-এর লেখক এবং বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় পারদর্শী।