রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করেন। তাঁর সংস্কৃতের পরীক্ষক ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত প্রাচ্যবিশারদ ফ্রিডরিখ ম্যাক্সমুলার সাহেব।বিলেতে পরীক্ষা দেওয়ার পরে তিনি ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করতে যান। তখন ম্যাক্সমুলার তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলেন তাঁর ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ঠাকুর আর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। কারণ ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথ যখন প্রথমবার বিলেত যান, তখন প্যারিসে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে তাঁদের মধ্যে গভীর আলোচনা হয় সে সময়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখা ‘আমার বাল্যকথা’ বইয়ে সেসব বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। ওই বই থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। দ্বারকানাথের প্যারিস-সাক্ষাৎকারের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ম্যাক্সমুলার সত্যেন্দ্রনাথকে বলেছেন,-
“যখন তিনি শুনলেন যে আমি সংস্কৃত ভাষা শিখবার জন্য কিরূপ আগ্রহান্বিত, তখন আমার প্রতি তাঁর একটা আকর্ষণ হল। তিনি প্রায়ই আমাকে নিমন্ত্রণ করতেন এবং আমিও গিয়ে সারা সকালটা তাঁর কাছে প্রায়ই কাটিয়ে আসতাম। ভারতের নীতি প্রভৃতি নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা হত। তিনি অত্যন্ত সঙ্গীত প্রিয় ছিলেন এবং ইটালীয় ও ফরাসী সঙ্গীত খুব পছন্দ করতেন।
তিনি গান করতেন আর আমি সেই গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাতাম — এই ভাবে আমাদের দিনগুলি বেশ আনন্দে কেটে যেত। তিনি বেশ সুকণ্ঠ ছিলেন। একদিন আমি তাঁকে বল্লাম একটি খাঁটি ভারত-সঙ্গীত গাইতে, তাতে তিনি যে গানটি প্রথমে গাইলেন, সেটা ঠিক ভারতীয় নয়, পারসিক গজল, এবং আমিও তাতে বিশেষ কোন মাধুর্য পেলাম না। খাঁটি ভারত-সঙ্গীত গাইবার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করায় তিনি মৃদু হেসে বল্লেন, ‘তুমি তা উপভোগ করতে পারবে না।’
তারপর আমার অনুরোধ রক্ষার জন্য একটি গান নিজে বাজিয়ে গাইলেন। সত্য বলিতে কি, আমি বাস্তবিকই কিছু উপভোগ করতে পারলাম না। আমার মনে হল যে, গানে না আছে সুর, না আছে ঝঙ্কার, না আছে সামঞ্জস্য। দ্বারকানাথকে এই কথা বলায় তিনি বল্লেন, ‘তোমরা সকলেই এক রকমের। যদি কোন জিনিস তোমাদের কাছে নতুন ঠেকে বা প্রথমেই তোমাদের মনোরঞ্জন করতে না পারে, তোমরা অমনি তার প্রতি বিমুখ। প্রথম যখন আমি ইটালীয় গীতবাদ্য শুনি, তখন আমিও তাতে কোন রস পাইনি, কিন্তু তবু আমি ক্ষান্ত হইনি; আমি ক্রমাগত চর্চা করতে লাগলাম যতক্ষণে না আমি তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারলাম। সকল বিষয়েই এইরূপ। তোমরা বল আমাদের ধর্ম ধর্মই নয়, আমাদের কাব্য কাব্যই নয়, আমাদের দর্শন দর্শনই নয়। ইয়োরোপ যাহা প্রকাশ করে আমরা চেষ্টা করি তাহা বুঝতে ও হৃদয়ঙ্গম করতে, কিন্তু তাই বলে ভারতবর্ষ যাহা প্রকাশ করে তাকে অবহেলা করি না। আমরা যেমন তোমাদের সঙ্গীতবিদ্যা, কাব্য, দর্শন আলোচনা করি, তোমরা যদি তাই করতে তাহলে তোমরাও আমাদের দেশের বিদ্যাগুলির মর্ম বুঝতে পারতে এবং আমাদের যে অজ্ঞ ও ভণ্ড মনে কর, বাস্তবিক আমরা তা নই, বরং অজ্ঞাত বিষয়ে তোমরা যা জান, আমরা হয়তো তারো অধিক জান্তে পেরেছি দেখতে।”
মহামহিম অতিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বইয়ে দ্বারকানাথের পতিতালয় ব্যাবসা সম্বন্ধে যত গালগুল্প লিখেছেন, তার এক শতাংশও লেখেননি তাঁর সংগীতানুরাগ নিয়ে। দ্বারকানাথের সংগীতমনস্কতা যে দেবেন্দ্রনাথের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল, তা জানানোর দায় কার? শুধু অন্ধকার দিকগুলোই তুলে ধরা যাদের কাজ, তারা তা করে যাক, তবে দ্বারকানাথ তাঁর নিজের জায়গাতেই অধিষ্ঠিত থাকবেন।
এইবার আমার কথায় আসি। দ্বারকানাথ ম্যাক্সমুলারকে প্রথম যে ভারতীয় সংগীতটি শুনিয়েছিলেন সেটি গজল বা কাওয়ালি ছিল বলেই মনে হয়। কিন্তু বাংলায় যে গানটি নিজে বাজনাসহযোগে গেয়েছিলেন, সেই গানটি একেবারে দেশি গান বলেই ম্যাক্সমুলার সেটি অনুধাবন করতে পারেননি। সেটি টপ্পা, ঠুংরি নয় বলেই আমার ধারণা। হাফ আখড়াই, কেলোয়াতি তো নয়ই। তাহলে কি সেটি কীর্তনাঙ্গের কোনও গান? গোঁড়া বৈষ্ণব (ব্রাহ্মণ) দ্বারকানাথ লক্ষ্মী-জনার্দনের পুজো করতেন বিলেতের হোটেলঘরের দেওয়ালে গঙ্গামাটির প্রলেপ লাগিয়ে। সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন গঙ্গামাটি। কীর্তনগান বা কবিগানের রাধাকৃষ্ণগীতি গাওয়া তাঁর পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল। তাই সঙ্গে খোল-করতাল, নিদেন পক্ষে তবলা বাজানোর কাজটি তাঁকে নিজেই করতে হয়েছিল।
ব্রহ্মসংগীতের চল তখন হয়নি ঠাকুরপরিবারে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর স্রষ্টা। প্যারিসে ম্যাক্সমুলারসকাশে নিজের বাংলা গানে সঙ্গত নিজেই করেছিলেন দ্বারকানাথ। তার মানে তিনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রেও পারদর্শী ছিলেন।
তিনি যে সুগায়ক ছিলেন তা তো ম্যাক্সমুলার সাহেব স্বীকার করেছেন। দ্বারকানাথের সংগীতপ্রেম বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত। তাঁর বাবা রামলোচন (পালকপিতা) ছিলেন সংগীতপ্রেমী।
কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুরের মৃত্যুর পর, ঠাকুরবাড়ির অভিভাবক হন রামলোচন। সে সময়ের গ্রাম-বাংলায় লোকগানের চর্চা ছিল ব্যাপকভাবে। আর ছিল কীর্তন ও শ্যামসঙ্গীতের মতো ভক্তিগীতি। কলকাতায় টপ্পার চর্চা করতেন নিধুবাবুর শিষ্যদের কেউ কেউ। তবে হাফ আখড়াই গানের জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক। এর সাথে ছিল কলকাতায় বসবাসরত স্থানীয় জমিদার এবং নব্য ধনী পরিবারগুলোর জলসাঘরের বাইজিসমভিব্যাহারে রাগসঙ্গীতের আসর। সেকালের খেয়াল, ধ্রুপদ বা যেকোনো ধরনের রাগাশ্রয়ী গানকে বলা হতো কালোয়াতী গান। অন্যদিকে নদীয়া কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে কবিগান, কীর্তন, রামপ্রসাদী এবং হাফ-আখড়াই গানের আসরও বসতো। সেকালের কলকাতার অন্যান্য শৌখিন ধনীদের মতই রামলোচন ঠাকুর ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন গুণী সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে আসর বসাতেন। এই আসরে অবশ্য ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়-স্বজন বা এই পরিবারের ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধবরা আমন্ত্রিত হতেন। রামলোচনের দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন পরিবারের অভিভাবক হলেন, তখন তিনিও এরকম আসরের আয়োজন করতেন। এই বিষয়টি দেবেন্দ্রনাথের ‘বাল্যস্মৃতি’ থেকে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন ‘সমস্ত রাত্রি কথা হইত এবং কীর্তন হইত, তাহার শব্দে আমরা রাত্রে ঘুমাইতে পারিতাম না।’
সে আমলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কীর্তন, হাফ আখড়াই, কেলোয়াতি, কবিগানের আসর বসত পূজাপার্বণে। তাঁরা ছিলেন কলকাতা তথা বাংলার লোকসঙ্গীত গায়কদের পৃষ্ঠপোষক। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বায়োলজিক্যাল পিতা রামমণিও সংগীতজ্ঞ ছিলেন। রামলোচন-রামমণির পিতা, তথা দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা নীলমণি ঠাকুর গোঁড়া বৈষ্ণব হওয়ায় কীর্তন ও কবিগানে পারদর্শী ছিলেন। বস্তুত নীলমণির পিতামহ পঞ্চানন কুশারীর আমল থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির গানের ধারাটি চলে আসছিল।