পদ্মাপাড়ের গাঁও গ্রাম থেকে উঠে আসা এক প্রতীত বাঙালি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। পদ্মাচর, ধান কাউনের ক্ষেত, জলীর বিলের জলকুমুদী, নক্সী করা ‘পাকান পিঠা’ হলদে পাখির ছা, বাঁশের বাঁশি, মাঠের রাখাল, কলমীলতার ফুল আরো কত না পল্লী প্রকৃতির অনুষঙ্গ, ঐতিহ্যময় বাংলার লোককাহিনী, লোকগাথা,বিয়ের গীত, কেচ্ছা কাহিনি ইত্যাদি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের লেখা কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস ও কাব্যের পাতায় পাতায় ছড়ানো।
নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজনবাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), সকিনা (১৯৫৭), রাখালী (১৯২৭), বালুচর (১৯৩০), ধানক্ষেত (১৯৩২), রঙ্গিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), হাসু (১৯৩৮), রূপবতী (১৯৪৬), এক পয়সার বাঁশি (১৯৪৯), পদ্মার পাড় (১৯৫০), মাটির কান্না (১৯৫১), গাঙের পাড় (১৯৫৪), হলুদবরণী (১৯৬৬), সূচয়নী, বেদের মেয়ে, ইত্যাদি কবিতা সংকলন, কাহিনি কাব্যের পাতায় পাতায় আবহমান বাংলার গাঁওগ্রাম, নদনদী, খালবিল, পাখপাখালি, মাঠঘাট, শিশু-কিশোর, মাঠের রাখাল, নায়ের মাঝি, মাঠের কৃষক, গৃহস্থ ঘরের কৃষাণী, গ্রামের যুবক যুবতী, যাযাবর সহ অন্তজশ্রেণির মানব মানবীর কত না অনুষঙ্গ, আবহ ও আঙ্গিকে কাব্যিক কথামালায় তিনি বিধৃত করেছেন। জসীমউদ্দীন বাংলার পল্লীপ্রকৃতির অবিকল প্রতিচ্ছবি কাব্যিক ছন্দমালায় আঁকার সঙ্গে সঙ্গে পল্লীজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সহজ সরল কিশোর -কিশোরী, কৃষাণ-কৃষাণী, যুবক-যুবতী ও বৃদ্ধ- বৃদ্ধার হাসি-আনন্দ, সুখ-দু:খ, ব্যথা-বেদনার ছবি তুলে ধরেছেন গাঁওগ্রামের সহজ সরল ভাষায়।
প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী অবন ঠাকুর জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাহিনি কাব্যের মুখবন্ধে জসীমউদ্দীকে নক্সী কাঁথার কবি বলে সম্বোধন করেন। জসীমউদ্দীনের জীবন ও সাহিত্য সাধনার যে পরিচয় আমরা পাই তা থেকে অবন ঠাকুরের মন্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে কারোই দ্বিমত নেই। জসীমউদ্দীনের বর্ণাঢ্য জীবনের প্রথম অংশ তাঁর বাল্যকাল। তাঁর বাল্যকালের ঘটনা প্রবাহ বর্ণিল অনুষঙ্গে সুষমামন্ডিত। নানা রঙের সুতোয় বোনা জসীমউদ্দীনের বাল্যজীবনের নানা দিক এ নিবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
জসীমউদ্দীনের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানা বাড়িতে। নানা বাড়ির নানা ঘটনা প্রবাহ তাঁর বাল্যজীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে। তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, আর কাব্য কাহিনিতে নানা বাড়ির বহু ঘটনার অনুরণন বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। জসীমউদ্দীনের নিজের ভাষায় নানা বাড়ির বর্ণনা : “আমার মা ছিলেন নানার আদরের মেয়ে। আর দুইটি মেয়ে আগেই মারা গিয়াছে। এই একমাত্র মেয়েটিকে নানা-নানী বড়ই আদর করিয়া পালিতেন। নানা বাড়ি ছিল তাম্বুলখানা গ্রামে। সেই গ্রামের চারিদিকে বিজাবন জঙ্গল।”
নানা বাড়ি থেকে আট মাইল দূরের গ্রাম গোবিন্দপুরে জসীমউদ্দীনের বাড়ি। পিতার নাম মৌলভী আনসারউদ্দীন মোল্লা,মায়ের নাম আমিনা খাতুন এবং পিতামহের নাম জমিরউদদীন মোল্লা।
জসীমউদ্দীনের বাল্যজীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে পারিবারিক পরিমন্ডল, নানা বাড়ির নানা অনুষঙ্গ, শৈশব আর কৈশোরের একান্ত সঙ্গী সাথীদের কথা, নিজ গ্রাম গোবিন্দপুর আর গোবিন্দপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর মরা সোতা, আশপাশের বনবাদাড়, পাখ-পাখালি, তালগাছে বাবুই পাখিদের বাসা, ধান-কাউন-শরষের ক্ষেতের কত না বর্ণিল কথা। পরদাদা, দাদারা কৃষক পরিবারের মানুষ হলেও এককালে তাদের অবস্থা ভালই ছিল। কীর্তিনাশা পদ্মার ভাঙ্গনে পদ্মাপাড়ের বসতবাড়ি আর জমিজমা পদ্মা গর্ভে বিলীন হলে কবির দাদারা গোবিন্দপুরে বসতি স্থাপন করেন। গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় গাজীর গান, জারী গান, কেচ্ছাগানের আসর বসতো। প্রতেক বাড়িতে দুগ্ধ বৎসা গাভী প্রচুর দুধ দিত, স্বর্ণপ্রসবা মাটিতে সামান্য লাঙ্গলের আচঁড় দিয়ে বীজ ছড়ালেই ফলতো প্রচুর ফসল। চাষীরা তাদের উৎপন্ন ফসলের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতো। জসীমউদ্দীনের নিজের কথায়, “আমার অন্ধ দাদা দানু মোল্লার কোলে বসিয়া আমি বাল্যকালে এই পরিপূর্ণতার কথা শুনতাম।”
জসীমউদ্দীনের পিতা মৌলভী আনছারউদ্দীন কৃষক পরিবারের জন্মেও নিজের চেষ্টায় ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষা শিক্ষা লাভের জন্য স্কুলে ভর্তি হয়েও ওহাবী আন্দোলনের ফলে তাঁকে ইংরেজি পড়া ছাড়তে হয়। বাংলা ছাত্রবৃত্তি স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ছাত্রবৃত্তি পাশ করার পর তাঁরই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রাজমোহন পন্ডিত মহাশয়ের আহবানে ফরিদপুর হিতৈষী এম.ই.স্কুলে শিক্ষক হন। সেখানে প্রায় ৩৫ বছর শিক্ষকতা করার পর তাঁকে নানা অজুহাত দেখিয়ে অবসর দেওয়ায় তিনি দেশ হিতৈষী কাজে ব্রতী হলেন। জসীমউদ্দীনের পিতা মোল্লা বংশের সন্তান হওয়ায় গ্রামের মোল্লাকির ভার পান। পিতার ইচ্ছে ছিল জসীম লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হোক। কিন্তু বালক জসীমের ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে ঢাকায় গিয়ে মৌলভী হবেন। সমবয়সী চাচাতো ভাই নেহাজউদ্দিনের সঙ্গে জসীমের গলাগলায় ভাব। তাদের স্কুলের যাবার নাম গন্ধ নেই। দুরন্ত প্রকৃতির জসীম আর নেহাজউদ্দিনের পড়াশুনোয় আগ্রহ না থাকায় জসীমের পিতা বড় ভাবনায় পরেন। বাড়ির চারপাশের কৃষক পরিবারের ছেলেরা স্কুলের বাধা পড়তে নারাজ। ছোট্ট জসীম ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির। সারাদিন খেলা আর খেলা। নানা রকমের খেলাধুলোর প্রতি তার প্রবল ঝোঁক।
জসীম তার বাবাকে বাজান বলে ডাকতেন। ছোট্ট জসীমকে স্কুলে পাঠাতে তার বাবাকে বড় বেগ পেতে হল। জসীমউদ্দীনের নিজের কথায় এরং স্বীকৃতি মেলে। “ছোটবেলায় আমাকে স্কুলে পাঠাইতে আমার পিতাকে বড়ই বেগ পাইতে হইয়াছিল। গ্রামে কারো বাড়িতেই কেহই স্কুলে যাইত না। সমবয়সী সাথীদের নিকট শুনিতাম স্কুলে গেলে মাস্টারের নিকট নানা রকমের শাস্তি পাইতে হয়। তাই যে দিন বাজান বলিতেন, কাল তোমাকে আর নেহাজদ্দীনকে পাঠশালায় লইয়া যাইব, আমি আর আমার চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীন রাত্রে বসিয়া নানারূপ ফন্দী-ফিকির আঁটিতাম।” স্কুলে না যাওয়ার জন্য দু’জনের আঁখক্ষেতে,শরষে ক্ষেত পালিয়ে থাকার গল্প কবির লেখা ‘জীবন কথা (১৯৬৫)’ থেকে পড়লে হাসি পায়। জসিমউদ্দীনের পিতা তাদের দু’ভাইকে একদিন সত্যি সত্যি পাকড়াও করে পাঠশালায় নিয়ে গেলেন। কবি নিজের লেখা থেকে দেখা যাক তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা:“ সেদিন শরষের ক্ষেত হইতে বাজান আমাদের দু’ ভাইকে ধরিয়া স্কুলে লইয়া চলিলেন। কোরবানীর খাসির মত আমরা দু’ভাই কাঁপিতে কাঁপিতে পাঠশালায় চলিলাল।” ছোট্ট জসীমের প্রথম পাঠশালায় যাবার ভীতি কত তাঁর মনের উপর রেখাপাত করেছিল তা আমরা তাঁর এ বর্ণনার ভেতর থেকে পাই।“ আমাদের বাড়ির শ্মশানঘাটের রাস্তা, সেখান দিয়া হানিফ মোল্লার বাড়ি পারাইয়া ছোট গাঁও। তার উপরে বাঁশের সাঁকো। আমরা যেন পোলছুরাত পার হইতেছি। সেই সাঁকো পার হইয়া সতীনাথ চৌধুরীর বাড়ি। তারই বৈঠকখানায় পাঠশালার ঘর। যাইয়া দেখিলাম মাস্টার মহাশয় বেত হাতে বসিয়া আছেন। বারান্দায় দু-দিনটি ছেলে নিল ডাউন ও হাফ নিলডাউন হইয়া আছে। আর একটি ছেলে সূর্যের দিকে চহিয়া আছে। মাস্টার মহাশয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া আমার পিতাকে সালাম করিলেন। আর আর ছাত্রেরাও উঠিয়া দাঁড়াইল। যাহারা নিল ডাউন, হাফ নিল ডাউন হইয়া শাস্তি পাইতেছিল তাহারাও শাস্তি হইতে রেহাই পাইল। ” ছোট্ট জসীম এ দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে ভাবলেন, তাঁর পিতার এত সম্মান! তার বুকটা এ দৃশ্য দেখে গর্বে বুক ভরে গেল। কবির পিতা মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে কথাবার্ত বলে তাদের রেখে চলে গেলেন। মাস্টার মশাই তাদেরকে স্নেহের চোখে কাছে ডেকে বলে দিলে কাল থেকে দোয়াত কলম ও কলাপাতা নিয়ে আসতে। সে সময় ছাত্রদেরকে কলাপাতায় লিখতে হত, যা আজকের দিনে ভাবলে অবাক হতে হয়।
দু’একদিনের মধ্যেই জসীম ও নেহাজের পাঠশালা ভীতি দূর হয়ে গেল। পাঠশালা সম্পর্কে ধারণা তাদের পুরোপুরি পাল্টে গেল। পাঠশালায় যাওয়ার অভ্যাস তাদের মাঝে দানাবেঁধে উঠল। অল্প কিছুদিনের মধ্যে জসীমের মনে পাঠশালার প্রতি আকর্ষণ দেখা গেল। পরিণত বয়সে তাঁর নিজের লেখা ‘জীবন কথা’র পাতায় পাতায় তাঁর পাঠশালা জীবনের বর্ণিল কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি পাঠশালার জীবনের স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে— “হিন্দুপাড়ায় এই পাঠশালা আমার কাছে বড়ই আকর্ষণের বস্তু হইয়া উঠিল। হিন্দুদের বাড়িতে বাড়িতে নানা রকমের ফুলের গাছ। শীতকালে রক্তগাঁদা আর বড় গাঁদার রঙে আর গন্ধে উঠোনের অর্দ্ধেকটা আলো হইয়া থাকে। গাঁদা ফুলের চাইতেও সুন্দর হিন্দু বউরা কপালেভরা সিঁদুর পরিয়া উঠানের উপর সুনিপুন করিয়া চালচিত্র আঁকিত।”
কবি জসীমউদ্দীনের বাল্যের পাঠশালার দিনগুলো বড়ই প্রাণবন্ত ও সুষমামন্ডিত ছিল। ছোটবেলা থেকেই পল্লীপ্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণের মধ্যে কবি মনের বীজ উপ্ত হয়েছিল। একদিন ছোট্ট জসীম হিন্দুপাড়া থেকে ফুলের চারা ও পাতাবাহারের ডাল এনে বাড়িতে লাগালেন। তাদের বাড়ির গাছপালায় ঘেরা আঙ্গিনায় ফুলের চারাগুলো বেড়ে না উঠলেও পাতাবাহরের ডালগুলো কিছুদিনের মধ্যেই রঙবেরঙের পাতা মেলে ঝলমল করে উঠল। রঙবেরঙের পাতাবাহার গাছগুলো নিয়ে একটা ঘটনায় কবির বালক মনের সহজ সরল রসবোধের অভিব্যক্তি ফুটে উঠে, যা পাঠকের মনেও হাসির উদ্রেক করে। একবার এক গণকঠাকুরকে তার সাধের পাতাবাহারের বাগান দেখাতে নিয়ে গেলে গণকঠাকুর ছোট্ট জসীমকে কানে কানে বললেন, “এই গাছগুলোর কাছে আসিয়া মনে মনে বলিবে যে এই পাতাবাহরের মত সুন্দর বউ যেন আমার হয়।” ছোট্ট জসীম সহজ সরল মনে গণকঠাকুরের কথা বিশ্বাস করেছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁর নিজের লেখা থেকে— “এরপর এই পাতাবাহরের গাছে পানি দিতে আসিয়া কেমন যেন লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিতাম। হয়তো মনে দু-একবার বলিতামও, গাছ, তোমার মত সুন্দর বউ যেন আমার হয়। বিবাহের বাসর রাতে নতুন বউকে এই গল্প বলিয়া তার মুখ থেকে কিঞ্চিত লজ্জামিশ্রিত হাসি উপহার পইয়াছিলাম।” বালক জসীমের ওষধী গাছের প্রতি অনুরাগের কথা বলতে হলে তার পাঠশালা জীবনের বন্ধু বিনোদ ও তাদের বাড়ির তুলসী গাছ প্রসঙ্গে কথা না বললেই নয়। বিনোদদের বাড়িতে একটা কালো তুলসী গাছ ছিল। বিনোদ সেই কালো তুলসী পাতায় অনেকগুণপনার কথা বালক জসীমকে বলেছিল। জসীম বিনোদের বাড়ি থেকে একটি কালো তুলসী চারা এনে লাগালেন। মুসলমান বাড়িতে লাগানোর জন্য জসীম অনেক সমালোচনায় পড়লেন। গাছটি বড় হলে ওষধি হিসাবে পাড়ার লোকেরা তুলসী পাতা নিতে এলে বালক জসীমের মনটা গর্বে ভরে উঠল।
জসীমউদ্দীনের বালক মনে বিশেষ ভাবে জোয়াইড়া গ্রামের মনসুর মৌলভীর প্রভাব পড়েছিল। মৌলভী সাহেব জসীমের পিতার বন্ধু ছিলেন। তাদের গ্রামে তিনি এসে উঠতেন তাদের বাড়িতে। তাদের বাড়ি থেকে তিনি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে মিলাদ পড়তে যাওয়ার সময় ছোট্ট জসীমকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তিনি মৌলভী সাহেবের সঙ্গে মিলাদে যেতেন এবং মিলাদের সময় মৌলভী সাহেবের কন্ঠে কন্ঠ মিলাইয়া দরূদশরীফ পড়তেন।
জসীমউদ্দীনের কবি জীবনের প্রথম উন্মেষ তাঁর অন্ধ দাদার গল্প, গান ও কেচ্ছা কাহিনির ভেতর দিয়ে। তাঁর পিতার এক চাচা, নাম দানু মোল্লা। লোকে তাঁকে বলত ধানু মোল্লা। তিনি অল্প বয়সেরই চোখের অসুখের চিকিৎসা বিভ্রাটের কারণে অন্ধ হয়ে যান। তিনি রুব্বান কন্যা, মধুমালা,আব্দুল বাদশা, জিতুধরের গল্প, কহকুন্ড পাখির কেচ্ছা ইত্যাদির কাহিনি শুনাতেন পল্লী গানের সুরে সুরে। কেচ্ছা বলার সময় তার দাদা আঙুলে তুড়ি দিয়ে, দুই হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে,কন্ঠস্বর কখনো বিলম্বিতলয়ে টানিয়ে, কখনো দ্রুতলয়ে হ্রষ্য করে, কখনো ধমকের সুরে, কখনো আবেগ মিশ্রিত সুরে, কখনো জোরে জোরে দাপটের সঙ্গে, কখনো ফিসফিস করে মনে মনে কথা বলার মত করে, কাহিনির বিষযবস্তুকে তিনি শ্রোতাদের মধ্যে জীবন্ত করে তুলতেন। মদন কুমার ও মধুমালার কেচ্ছায় তার দাদা গান ধরিতেন : “কাঞ্চন নগরে ঘর,/ নামে রাজা দন্ডধর,—।” দাদা বলে চলতেন : “মদনকুমার হরিণ শিকারে গিয়ে মধুমালাকে স্বপ্নে দেখে মদন কুমার আঁচল ধরে কেঁদে কেঁদে গাইছে : “ও আমি যাব মা ধন/ মধুমালার দেশে হে।” দাদা গান থামিয়ে বলতে শুরু করলেন : “মদনকুমার ষোল ডিঙ্গা মধুকোষ সাজাইয়া মধুমালার দেশে রওয়ানা হইতেছে। তাকে বিদায় দিতে মদনকুমারের দুখিনী মায়ের জবানীতে দাদা গান ধরিতেন : “ও আমার যায়রে মদন মধুমালার দেশে হে।”
অন্ধ দাদার কাছ থেকে যে সব কেচ্ছা তিনি শুনতেন তা কবির বালক মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করেছিল। মদন কুমার ও মধুমালার কেচ্ছা কতটা কবির বালক মনে রেখাপাত করেছিল তা তাঁর নিজের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিলে উপলব্ধি করা যায়। তিনি তাঁর ‘জীবন কথা’য় লেখেন, “মদনকুমার যখন নানা পাহাড় পর্বত ডিঙ্গাইয়া, সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়া, কত দুঃখ-বিপদ উত্তীর্ণ হইয়া কাঞ্চননগরে যাইয়া মধুমালাকে সঙ্গে লইয়া মায়ের কোলে ফিরিয়া আসিত, আমিও গানের আসর হইতে ঘরে যাইয়া মায়ের কোলটিতে ঘেসিয়া ঘুমাইয়া পড়িতাম। মনে হইত আমিই যেন সেই মদনকুমার। তারই মত কত দেশ বিদেশ পারাইয়া স্বপ্নের মধুমালাকে সঙ্গে লইয়া মায়ের কোলে ফিরিয়া আসিতেছি। কত রাত্রে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া মধুমালাতে স্বপ্নে দেখিয়াছি।” এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় অন্ধ দাদার কাছ থেকে তিনি যে সব কেচ্ছা কাহিনি শুনেছিলেন তা কবির পরবর্তী জীবনে কাহিনি কাব্য লিখতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে কবির নিজের কথা থেকে এর প্রমাণ মেলে বিশেষভাবে, “আমার অন্ধ-দাদা দানু মোল্লার কোলে বসিয়া আমি বালককালে এই সব পরিপূর্ণতার কাহিনী শুনিতাম। আমার নক্সসী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট পুস্তকে আমি এই গ্রাম বাঙলার পরিবেশেরই চিন্তা করিয়াছি।”
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মায়ের কথা এ নিবন্ধে না বললেই নয়। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘জীবন কথা’র ‘আমার মা’ পরিচ্ছদে অত্যন্ত দরদ দিয়ে নিজের মায়ের মাতৃরূপের অনবদ্য বর্ণনা দিয়েছেন, যা মায়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা -ভক্তির স্বাক্ষরবাহী। তাঁর মায়ের নাম আমিনা খাতুন, আরা ডাক নাম রাঙাছুটু। জসীমের মায়ের সংসারে শ্বাশুড়ি,ভাজ ছিল না। সংসারের সব কাজ নিজেকেই করতে হত। ঢেঁকিতে ধান ভানা, পিঠা তৈরির জন্য চালের গুড়া কোটা, সিমাই কাটা, ভাপা পিঠা তৈরি,রান্না বান্না সহ সংসারের সব ধরনের কাজ নিজ হাতে করতেন।
তাঁর মা অজপাড়া গ্রামের সহজ সরল মানুষ। মায়ের বাবার বাড়ি তাম্বুলখানা গ্রামে। রাস্তা ঘাট বিহীন বনজঙ্গল ঘেরা গোবিন্দপুর থেকে আট মাইল দূরের অজপাড়া গ্রামের তাম্বুলখানায় যাতায়াত করা কন্ঠসাধ্য ব্যাপার ছিল সেকালে। শৈশবের দিনগুলোতে ছোট্ট জসীমের মনে একটাই প্রশ্ন জাগতো বন জঙ্গল ঘেরা দূর গ্রামের মেয়ে তার মা কী করে তাদের বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। কবির নিজের কথায়, “মাকে কতবার জিজ্ঞাসা করিয়াছি; তুমি তো সেই বুনো দেশের মেয়ে, তুমি কি করিয়া আমাদের বাড়িতে আসিলে? কি সেই বিয়ের ঘটনা ছিল? সে দিন কে কে সঙ্গে গিয়েছিল, কে কলমা পড়াইয়াছিল? মা এর কোন উত্তর করিতেন না। কখনো কখনো রাগ দেখাইতেন।”
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন পরিণত বয়সে তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণায় তাঁর মায়ের বাবার বাড়ি তাম্বুলখানা গ্রামে যাবার যে বর্ণনা করেছেন তা আজকের দিনে অবিশ্বাস্য হলেও তখনকার দিনে অবশ্যই প্রাণন্তকর ছিল। গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে আট মাইল দূরের তাম্বুলখানা গ্রামের পৌঁছাবার একমাত্র বাহন ছিল ডুলি। আর মায়ের বাবার বাড়ি কোন নিকট আত্মীয় ছিল না। ডুলিতে সোয়ার হয়ে মায়ের বাবা বাড়ি যাওয়ার যে বর্ণনা জসীমউদ্দীন দিয়েছেন তা থেকে উপলব্ধি করা যায়, তা তাঁর বালক মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি তাঁর জীবন কথায় পরিণত বয়সে লিখেছেন যে তার দূর সম্পর্কের মামা ওফাজদ্দী মামু সোয়ারী বেহারা নিয়ে তার মাকে নিতে আসতেন। তাঁর মায়ের ঝাঁপিতে একখানামাত্র বেগুনী রঙের বেনারসী শাড়ি ছিল। মা সেই কাপড়খানা পরে ডুলিতে বসতেন। ডুলির চারদিক কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হত। মায়ের আয়না, চিরুনী, তেলের শিশি প্রভৃত্রি টুকিটাকি জিনিসগুলো সুন্দর একটা বেতের সাজিতে ডুলির বাঁশের সঙ্গে ঝুলানো হত। ডুলিতে সোয়ারী হয়ে বেহারাদের কাঁধে চেপে মাকে যেতে হতো বাবার বাড়ি, আর ডুলির পেছনে পেছনে পায়ে হেঁটে চলতো ছোট্ট জসীম ও ওফাজদ্দীন। ছোট্টবেলায় মামা বাড়িতে যাবার পথের বর্ণনা দিয়েছেন জসীউদ্দীন অপূর্ব কাব্যিক গদ্যে। “গোবিন্দপুরের গ্রাম ছাড়াইয়া শোভারামপুরের গ্রাম। মধ্যে ছোট গাঙ। বাঁশের সাঁকোতে সেই গাঙ্ পার হইয়া নদী তীর দিয়া পথ। গাঙ্ ত নয়, পল্লীবাসীদের খেলাইবার একটি ঝুমঝুমি। এর কোথায়ও সরু জলধারা এক হাঁটুর উপরে গভীর নয়।” মামা বাড়ি যাবার পথের প্রসঙ্গে আরো লিখছেন যে নদীর ধার পেরোলেই গোয়ালচামটের রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি ঝাউগাছ। সোয়ারীকে ঝাউগাছের তলায় নামিয়ে বেহরারা খানিকটা জিড়িয়ে নেয়। তারপর ডোমরাকান্দির পথের দু’ধারে জঙ্গল। মাঝে মাঝে দু’চারখানা গৃহস্থেরবাড়ির বৌ ঝিয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে ডুলির সোয়ারীর দিকে চেয়ে থাকে। সেকালে এটাই ছিল আবমান বাংলার বাস্তব চিত্র। লোক বসতি খুবই কম। বাড়িগুলো পেরোলেই তেঁতুল গাছের সারি, তারপর বহেড়া গাছের জঙ্গল। গাছের ছায়ায় গ্রীষ্মের দিন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
আবারো জসীমউদ্দীনের নিজের কথায় সেই পথের বর্ণনা। “এ গাছ থেকে ওগাছে বেতের লতা আসিয়া একে অপরকে বাঁধিয়া সেই বনভূমিকে মানুষের অগম্য করিয়া রাখিয়াছে। তারই পাশ দিয়া পথ — গোয়ালচামট ছাড়িয়া ডোমরাকান্দি- সেখানে ত্রিমণির উপর সরকারী পাকা কুয়া। এমন নিটল পানি। পিপাসা না থাকিলেও লোকে এখান হইতে একঘটি পানি উঠাইয়া পান করে। এখানে জিড়ান দিয়া বাঁধা কুয়োর পানি খাইয়া বেহারারা রওয়ানা হয় বামে ঘুরিয়া তাম্বুলখানার রাস্তায়। ডাইনের দিকে সামনে দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া গিয়াছে পথ দিগনগরের হাটে, তারপর ধোপাঘাটা, মামুদপুর, যশোর, তার দিল্লীর লাহোর, বোধ হয় দুনিযার শেষ প্রান্তে।”
ছোট্টবেলায় ছোট্ট জসীমের পল্লীপ্রকৃতিকে অন্তর দিয়ে দেখার মাঝ দিয়ে তার মধ্যে কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মায়ের বাবার বাড়ি যাওয়ার পথের যে দৃশ্য বালক মনে গাঁথা ছিল তা পরে ব্যক্ত করেছেন এভাবে — “এক দৌড়ে চষামাঠ ছড়াইয়া পথ যাইয়া ঢোকে গভীর জঙ্গলে। সেখানে বেত গাছের শিষা আসিয়া পথিকের গায়ের চাদর আটকাইতে চায়। শ্যামালতা তার লতাগুলির ফাঁদ মেলিয়া পথিকের পায়ে জড়াইয়া পড়ে। তবুও এ পথ ভাল। গাছের ডালে ডালে কত মাকাল ফল পাকিয়া লাল হইয়া আছে। কুঁচের লতায় কত কুঁচ ফল ফল পাকিয়া লাল রাঙা হইয়া হাসিতেছে। এ যেন বনরাণীর সিঁদুরের ঝাঁপি। কোন্ গোপন চিত্রকর যেন এই বনের মধ্যে বসিয়া পাকা তেলাকুঁচের রঙে মাকাল ফলের রঙে আর হিজল ফুলের রঙে মিলাইয়া তার সবচাইতে সুন্দর ছবিখানি আঁকিয়া বসিয়া বসিয়া দেখিতেছে।” জসীউদ্দীনের বাল্যে দেখা গ্রাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্যাবলীই তাঁর কবিতা, গান ও কেচ্ছা কাহিনিতে উঠে এসেছে।
মায়ের ডুলির সাথে সাথে হিজলের বন পেরিয়ে আবার মাঠ, মাঠের পর আবার বন। সামনে মুরালদহ। আর মুরালদহ পেরোলেই জসীমের নানা বাড়ি। জসীমের মায়ের আসার অপেক্ষায় নানী ঘর আর পথ করছেন সেই সকাল থেকে। ডুলি নানা বাড়ির উঠানে পৌছাতেই নানী দৌড়ে আসেন। ছুটে আসল পাড়ার বৌঝিরা। নানী তাঁর মাকে ডুলি থেকে নামিয়ে আনলে ওদের মাঝ থেকে একজন জসীমের মাকে জিজ্ঞেস করলো, “রাঙা ছুটু কেমন আছিস? এই আসলি বুঝি? আমি ডুলি দেখেই বুঝতে পারিছি।” সবাই মায়ের খবর নেওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলে জসীম আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।
তাম্বুলখানার নানা বাড়ির নানা অনুষঙ্গ পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা, গল্প, কাব্যে বিশেষ ভাবে ধরা পড়ে একথা আগেই বলা হয়েছে। কবির পরবর্তী জীবনের লেখার বীজ তার শৈশব আর কৈশোরের বাস্তব অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত। জসীমের মা নানীর একমাত্র বেঁচে থাকা মেয়ে। মেয়ের উদ্দেশ্যে নানীর কত না আয়োজন। মেয়ের জন্যে কবে শীতকালে তৈরি করে মুড়ি কোলার মধ্যে রেখেছেন তিলের পাটালি। ড্যাপের মোয়া, নারকেলের লাড়, ঘরের গরুর গর আওটা দুধ। সেবার ছিল আমের মৌসুম; জ্যৈষ্ঠ মাস। সিন্দুরে রঙে পাকা আমের সমারোহ। মামা বাড়িতে গাছ পালার অভাব নেই। আমের মৌসুম তাই গাছে গাছে সিন্দুরে আম পেকে পেকে আছে। পরদিন সকালে জসীম তাহেরের ভাই গেদাকে সঙ্গে করে পাকা আম পাড়তে লেগে গেল। ধামা ভরে আম কুড়িয়ে বাড়ি ফিরলে নানী বললেন “আমার ভাই আসিয়াছে বলিয়াই ত এত আম পাইলাম।”
তিনি ও তাঁর চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীনের বাল্যে দেখা নিজ পল্লী প্রকৃতিই প্রতিচ্ছবিই বিধৃত করেছেন। তিনি তাঁর লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘নিমন্ত্রণ’ ও তাঁর লেখা ‘জীবন কথা ’র বক্তব্যের সাথে পাঠক অবশ্যই মিল খুঁজে পাবেন। তিনি ‘জীবন কথা’য় বলেন, — “মটরশুঁটির সাদা গোলাপী মেশার পরের উপরে সুন্দর লালের ফোঁটা। গ্রাম্য মেয়ের নোলকের মত। খেসারী গাছ। খেসারীর ফুলগুলি নীল। আমরা ফুল ছিড়িয়া ছিড়িয়া কানে গুঁজিতাম। তারপর চষা ক্ষেত হইতে শাকুক কুড়াইয়্ কুড়াইয়া তার ছিদ্র করিয়া মালা গাঁথিতাম। সেই মালা একটি গলায় পরিতাম আর একটি মাজায় জড়াইতাম। তারপর দুই ভাই চষাখেতের মধ্য দিয়া দিতাম দৌড়। — আমাদের গলায় শব্দে মালার শব্দে সমস্ত চর ঝম ঝম করিয়া বাজিয়া উঠিত। এই ভাবে ভর দুপুরে খেলিয়া বাড়ি ফিরিতাম। এত বেলায় বাড়ি ফিরিলে মা যদি বকে সেই জন্য রাশি রাশি মটরের শাক, সরষে শাক কুড়াইয়া লইয়া আসিতাম।” তিনি তাঁর ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় এই সব অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন তা আমরা নিমন্ত্রণ কবিতা থেকে এখানে উদ্ধৃতি দিলে উপলব্ধি করতে পারব।
‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়,
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়, —’
বাল্যকালে মাঠে মাঠে মটর শাক, মটর শুঁটি তুলিবার যে কথা কবি ব্যক্ত করেছেন তার অনুষঙ্গ ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় এভাবে উঠে এসেছে। এই সব অনুষঙ্গ দেখার জন্য আমরা আবারো ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় চোখ রাখব।
‘তেলাকুচা পাতা গলায় পরিয়া
মেঠোফুল নিও আঁচল ভরিয়া
হেথায় সেথায় ভাব কর তুমি বনের পাখিদের সাথে
— তুমি যদি যাও — দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম — হাত বাড়ালে মুঠি ভরে সেই খানে।—
তাঁর দেখা শ্বাশত বাংলার পল্লীর অভাব ক্লিষ্ট মানুষের প্রতিচ্ছবি প্রতিভাত হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে ‘আসমানী’ কবিতায়। তাঁর বাল্যকালের অভিজ্ঞতা ছাড়া ‘আসমানী’ মতো কবিতা অন্যের পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না। আমরা এখানে ‘আসমানী’ কবিতার দু’এক লাইন উদ্ধৃত করতে পারি কবির বাল্যকালের দেখা অভিজ্ঞতার জগত কতটা ঋদ্ধ ছিল তা দেখার জন্য।
“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়িও তো নয় পাখির বাসা-পাতার ছ্যানি
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি বৃষ্টি হলেই —”
ঐতিহ্যবাহী আবহমান বাংলার কত বিষয়ে জসীম তাঁর বাল্যে কাছ থেকে দেখে নিজের অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করেছিলেন তা বলে শেষ করার নয়। বাংলায় বার মাসে তের পার্বণ। জসীম বালক বয়সেই বাংলার বার মাসের তের পার্বণকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন নিজেকে সম্পৃক্ত করে। তার অজস্র প্রমাণ ছড়ানো আছে তাঁর লেখা স্মৃতি কথায়। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পুরনো একটা পার্বণ গাস্বী, যা এখন হারিয়ে গেছে প্রায়। গাস্বীর আবহমানকালের এই গানগুলো কবি বালক মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করেছিল।
‘আশ্বিনে রান্দে কার্তিকে খায়,
যে বর মাঙে সেই বর পায়।’
যা যা মশা মাছি উইড়া যা,
আমাগো বাড়িত্যা অমুকে বাড়ি যা!’
জসীউদ্দীনের বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’, এ কবিতার কথক পল্লীর এক বৃদ্ধ, সে তার একমাত্র জীবিত নাতির কাছে নিজের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পত্রবধূ ও নাতনীর কবরগুলো দেখিয়ে তাদের অকাল মুত্যুর করুণতম কাহিনি বর্ণনা করছেন। একমাত্র নাতি ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারানো পল্লীর বৃদ্ধ মানুষটির মুখ দিয়ে জসীউদ্দীন তাঁর বালক বয়সে এ ধরনের অকালকে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে সেইসব অভিজ্ঞতার আলোকে সহজ সরল ভাষায় করুণতম কাহিনির বিয়োগান্তক এই কবিতাটি লেখেন ছাত্রাবস্থায়। এছাড়া তাঁর ‘পল্লী জননী’ কতিাটিতেও পল্লীর এক দুখিনী মায়ের করুণ কাহিনি তিনি বিধৃত করেছেন বাল্যে দেখা দুখিনী ময়ের করুণ আর্তির আলোকে। পরিশেষে বলতে হয় জসীমউদদীনের সার্থক পল্লীকবি হওয়ার পেছনে নক্সী কাঁথায় বোনা তাঁর বর্ণাঢ্য বাল্যজীবনের দেখাশোনা, আর লব্ধ অভিজ্ঞতারই ফসল।
মনোজিৎকুমার দাস, কথাসাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা।