“আকাশ কাগজ হলুদ রঙে একটা ছবি আঁকা
***
রামধনুতে মনের তুলি চুপচুপে রং মাখা
ফুলের মধুমাসে
সবুজ রোদের ঝিরঝিরে দিন লাজুক চোখে হাসে।
***
মুখটি তুলে বলল আকাশ, আমার কাছে এসো
***
অনেক ভালোবেসো
গাছের পাতা আনল খবর বর্ষামেয়ের গান
উন্মনা-মন বনময়ূরীর শ্রাবণ-জলে স্নান।”
কাল সারা বিকেল বৃষ্টি হয়েছে খুব, আজ সকাল থেকেই আবার রোদ্দুরের ঝিলিক আমাদের বাগান জুড়ে। সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে উঠোন পাখিরা এসে বসেছে গাছে গেছে। আমার হাতের মুঠোয় ‘প্রিয় আকাশ’। এই আকাশ আজ মিষ্টি মধুর নীল। মেঘগুলো সব রৌদ্রে ভেজা চিলের মতোই। জানলা দিয়ে অনেক অনেক দূর কে দেখতে পাচ্ছি আমি। দেখতে পাচ্ছি সোনালী রোদ্দুর ঢেউ খেলছে কাচ চিকচিক ঘাসে। যার ছোটদের কবিতা নিয়ে আমার এই লেখা তিনি ছড়ার মতোই ছন্দমাধুর্যে ভরা, প্রকৃতির মতো স্নিগ্ধ-কোমল,আকাশের মতোই উদার। তিনিই তো পারেন সন্ধ্যা পরীর জোছনা পালক খানা কুড়িয়ে নিতে, কনক চাঁপা ফুল তুলে মায়ের কালো চুলে পরিয়ে দিতে। পাখির শিসে বাউল বিকেলবেলা মাকে নিয়ে তার খেলা চলে। ইছামতির ঢেউ দেখেছেন তিনি, তার মতো করে আমরা কেউ কি দেখেছি সেই ছবি।
‘রাত্রি যখন নূপুর পায়ে নাচে
স্বপ্ন ছড়ায় শালপিয়ালের গাছে
দু-চোখ জুড়ে ঘুমকে ডেকে আনে
মায়ের গানে গানে।’
আকাশ নিয়ে এত্তগুলো পদ্য পড়তে পড়তে আমিও কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। ভোরের বেলা যখন আনমনা মেঘ ওড়ে আকাশজুড়ে সুয্যিঠাকুরের সঙ্গে মেঘের ভেলায় চড়ে আমিও চলে যায় অচিনপুরে। শীতল হাওয়া মাতাল হয়ে দূর দেশে চলে যায় এবং শালপিয়াদের কানে কানে সে যেন কিছু বলে যায়।আমি তো সেই রাখাল ছেলে যে বসে দেখি আমার লাজুক লাজুক চোখে রুপোর কাঁকন বাজিয়ে নূপুর পায়ে কে যেন এসেছে আমার কাছে। কেমন করে এরকম ছবি তুমি আঁকতে পারো কবি?
‘পরান মাঝি নৌকাখানি নাচছে ঢেউয়ের তালে
পালকিবাহক উঠছে মাঠের ওই যে দূরের আলে
হাওয়ায় দোলায় বকুল ডালে দুলছে কনকলতা
ডাকছে সে তো আয় খুকু আয়, শোনাবো রূপকথা
বৃষ্টি নামুক গাছের পাতায় যাক না সব ভিজে
ফুলের বাহার পালিয়ে বেড়ায় ধরতে পারিনি যে।’
গহন গভীর মনের কোণের দুঃখ সব ঘুচিয়ে দাও তুমি। তুমি আমায় মেঘ-ময়ূরের পেখম-তোলা জলছবি তুলে দাও হাতে। শাপলা-শালুক পদ্মদিঘির বাঁকে খেলতে ডাকে আমায়, আমি একলা বসে রামধনু রং গুলে নিয়ে ছবি আঁকি। আর যখন ভাবি এই ছবি দেব কাকে? তখন তুমি বলে দাও, বৃষ্টি বেলায় যে আমাদের বন্ধু হবে তাকেই দেবে সেই ছবি। তোমার লেখা তারার কাছ থেকেই আমি ছন্দ কুড়িয়ে নিই, তোমার মত আমার কাব্যলতাও সেই ছন্দ কুড়িয়ে পাখনা মেলে দেয়। তারার কথার ছন্দ শুনতে পাও তুমি। সেই ছন্দেতে কত রূপ। সন্ধ্যাতারায় আলোর কণারা জাল বনে অপরূপ। দূর থেকে তোমার সঙ্গে আমিও দেখি নিঝুম আকাশ। সেই আকাশ হাসিমুখে জেগে ওঠে।উড়ে-যাওয়া মেঘ একপলকেই ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। রাত্রি যখন ঝুপ করে নামে জোনাকিরা তখন দীপ জ্বালায় আর চন্দ্রিমা নামে মেয়েটি সেই আলোর টিপ পরে। আমার চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে। স্বপ্নপরীরা ডাকে, পালকের রং দুচোখে পরিয়ে দেয় — সাজিয়ে দেয় তারায়। কবির সঙ্গে আমার আকাশ-বাগানে যেতে ইচ্ছে করে, জানি সেখানে গেলেই পাবো তারাফুল, তারাদের পাড়া ঘুরলেই দেখা পাব আশমানি বুলবুলের। সেখানে গেলেই একতারা হাতে আমি হয়ে যাব উদাসীন। শুনতে পাব মেঘমেয়েদের নূপুরের রিনঝিন। রামধনু থেকে সাত রং নিয়ে মনকে ভুলিয়ে রাখবো। ইচ্ছেনদীর স্বপ্ন বিছানো সাঁকো পেরিয়ে গিয়ে দেখতে পাবো কীভাবে রাত্রি জেগে ওঠে।
কবির সঙ্গে আমিও খুশির ডানা মেলে দিই। পালক-পরা আকাশটাকে নীল রঙে কেমন লাগে — দেখতে ছুটে যাই। চুপটি করে তেপান্তরের মাঠে দৌড়ে পালাই আমি, সূর্য যখন পাটে যায় খুশির ডানা মেলে স্বপ্ন মাখা গান শোনাতে ইচ্ছে করে আমার হারানো সুর নিয়ে।মেঘবালিকার ময়ূরপঙ্খী ভেলায় ভেসে ভেসে আমিও চলে যায় রূপকথার ওই দেশে। আকাশটাকে আঁকবো বলে আমিও হাতে তুলে নিয়ে তুলি আর তখন কী হয় বলতো —
“অমনি তো মেঘগুলি
উড়বে বলে খুশির ছোঁয়ায় মেলল দুটি ডানা
শুনবে না সে আমার কোন মানা
কোথায় যাবে যাগ না উড়ে উড়ে
ফিরবে ঠিকই, আসবে যখন স্বপ্ন দু-চোখ জুড়ে।”
আলোয়মাখা দূরের দেশে সেই তেপান্তরে বিকেলশেষে পাতায় বাজে বেহাগ সুরের বাঁশি। আকাশ কবির কাছে নীলাঞ্জনা পাখি। তুলির টানে তাই সে বারবার সেই আকাশের ছবি আঁকে — সে ছবি চমক লাগা। কনক ঠাকুর রঙের আলোছায়া শিশুমনে ছড়িয়ে দিতে , ছোটদের বলেন, দেখো —
“মুক্ত ঝরে সবুজ পাতার বুকে
বাঁশের পাতা পড়ছে পথে ঝুঁকে
আকাশ জুড়ে মেঘলা মেঘের খেলা রাতে
জলের রঙে জোছনা আঙিনাতে”
জোনাকপোকার আলোয়ভরা নদী ওদের যদি ডাকে তাহলে নৌকো চড়ে উদাস বাউল মনে পারিজাতের বনে ওরা পৌঁছে যেত, পৌঁছে যেত স্বপ্নপুরীর দেশে।
এই কবিতার বইয়ে মা আর আকাশ মিলেমিশে একাকার। আমারও মনে হয় মা মানে তো বিরাট একটা আকাশ। ছোটো থেকে বড়ো হয়ে উঠি আমরা, মা চিনিয়ে দেয় আকাশের রঙ, আকাশের তারা।
“চাঁদটা যখন নাইতে নামে
জোছনা-গোলা জলে
মুছিয়ে দিতে লুকিয়ে থাকি
মায়েরই আঁচলে…
***
আকাশ থেকে রং নিয়ে কে
বাগানবাড়ি আঁকে
স্বপ্নে আমি দেখতে যাব
সঙ্গে নিয়ে মাকে।”
মায়ের মুখে গল্প শোনে ফুটফুটে এক ছেলে। দূরের লাজুক লাজুক নদীকে খুঁজতে ছোটে সে। লাজুক লাজুক নদী যে আকাশমেয়ের বোন,শোলক দিদির শোলক কথা তার যে অনেক শোনা।তার চোখ দুটো স্বপ্ন দিয়ে বোনা, তাইতো সারাদিন পথভোলা এক নদীকে সে খোঁজে। রাত্রি হলেই আকাশমেয়ে তারায় তারায় ঝলমল করে ওঠে, নদী তখন হয়ে ওঠে তার পায়ের মল। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে যারা, তাদের জন্য আমারও যে কষ্ট হয় খুব, ইচ্ছে করে আকাশের নিচে খেলছে যারা তাদের সঙ্গে ওদেরও মিশিয়ে দিই। ওরা যে বলে —
“জানলা দিয়ে আকাশ দেখি বইয়ের মাঝে নদী
ওদের সাথে ভাব জমাতাম বাইরে যেতাম যদি। “
কিছু মনের গহন মনে পৌঁছানো কিন্তু মোটেই সহজ নয়।অনেকেই ছোটোদের জন্য লিখেছেন গদ্য,পদ্য নাটক কিন্তু কবিতায় ছোটোদের কল্প জগতকে মায়াময় করে তোলায় সিদ্ধহস্ত কিছুজন কবি। কনক ঠাকুরের শব্দচয়ন, ছন্দনির্মাণ, চিত্রকল্প সৃজন একেবারেই অন্যরকম। ‘খেলনাপাতির ওই যে হিমালয়ে/ তোমার আমার খেলার পরাজয়ে… ” কে এমন কথা লিখতে পারে? ‘বেলা শেষের ঝলমলে দিন কাঁদে’, তার সঙ্গে মিল রেখে লিখলেন ‘দুরন্ত বক বসলো দীঘির বাঁধে।’ এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল, তারপর যখন লিখলেন “ঝাপট মারা শুভ্র রঙের পাখা/আটকে গিয়ে খয়েরি কাদায় মাখা/ আনমনা মেঘ কখন থেকে উড়ে/ উড়ে উড়েই খেলছে পাহাড় ঘুরে… সবকিছু তখন অন্যরকম হয়ে গেল।
ছোটোদের জন্য লেখা কবিতায় গল্প থাকেই। ছন্দে ছন্দে গল্পকথা মন কাড়ে বড়োদেরও। কনক ঠাকুরও কবিতায় গল্প বলেন চমৎকার। গল্পথার ছন্দ নিয়েই নূপুর ধ্বনি কাঁপায়। ধন্যি মেয়ে মিষ্টি পায়ে আলতা পরা ছাপে তার কাছে আসে। তিনি যখন লেখেন তখন জরির সকাল গন্ধ ভরায়। হিজলতলার লুকিয়ে থাকা মেয়েটিই ফুটফুটে রাত বোনের কাছে শকুন্তলার হাসি হয়ে ধরা দেয়, শকুন্তলার হাসি হয়ে ওঠে রাশি রাশি পান্না।
‘প্রিয় আকাশ’ (প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১৬ প্রকাশক কথাকৃতি) গ্রন্থটির পরিচিতি অংশে লেখা হয়েছে — “তিন দশক ধরে বাংলা ছড়া-কবিতার আঙিনায় যথেষ্ট দক্ষতার ছাপ রেখে চলেছেন কবি কনক ঠাকুর। নিবাস নদিয়ার বেথুয়াডহরি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণির প্রায় প্রতিটি পত্র-পত্রিকাতে নিয়মিত প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। একই সাথে যেমন ছোটোদের জন্য ছড়া লেখেন, আবার আধুনিক বাংলা কবিতাও। একসময় সম্পাদনা করেছেন ছড়ার পত্রিকা ‘মিষ্টি মুখ’। ‘মৌসুমী সাহিত্য পুরস্কার’, ‘সৌপ্তিক সাহিত্য সম্মান’, ‘কথাশিল্পী সাহিত্যসম্মান’, ‘অণুসাহিত্য সম্মান’।”
কনক ঠাকুরের কবিতা আমাকে নিয়ে যায় স্বপ্ন নদীর তীরে। আমি দেখতে পাই পুকুর পাড়ের আম কাঁঠালের সারি, ছোট্টবেলার সেই ঘরবাড়ি।আমার মনের মাঠে শুরু হয় ছুঁ-কিৎ-কিৎ খেলা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়ানো,ঝিনুক দিয়ে সেই আম ছুলে নুন দিয়ে মেখে খাওয়ার দৃশ্য। গল্পগাছায় ভরা সেই দিনগুলো কত্ত ভালো ছিল। আজ সে সব খোঁজার জন্য পালিয়ে বেড়ায় কবি, সেসব ছবি নৌকো হয়ে ভেসে বেড়ায় স্বপ্ন নদীর তীরে।
তাঁর কবিতায় রূপকথার গল্প লেখে। আকাশের নীলে হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। দেখি রামধনু রোদ ভালোলাগার পালক ঝরিয়ে দিচ্ছে সবুজ ঘাসে,শান্ত বিকেল মাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে অচিন গ্রামে। শব্দ সাজানো তাঁর কবিতা ছবির অ্যালবাম যেন —
“মা রয়েছে জানলা খুলে দেখছে নদীর ঢেউ
শান বাঁধানো সিড়ির উপর কাচছে কাপড় কেউ
খড়ের ছায়া ঘরগুলো সব গায়ের ছবি আঁকে
সুয্যি ডোবার সময় আকাশ লজ্জাতে মুখ ঢাকে।
***
রাত্রি এসে জোছনা ছড়ায় চাঁদের মায়া ভরা
তারার মালা কোথায় যে যায়,যায় না তাকে ধরা
রূপকথারা চোখের পাতায় গল্প দিলো লিখে
ডাকছি তখন স্বপ্নপুরের মিষ্টি মেয়েটিকে।”
তাঁর ছড়া নিয়ে আমরা সবাই মেতে উঠি হোলির উৎসবে। পলাশ ফুলের একমুঠো লাল তুলে নিয়ে ইচ্ছে মতন খুলে নিই সেই রং। আবার তার সঙ্গে পেয়ে যাই রামধনুর রং। আবার তার কবিতা পড়তে পড়তে শীত মেয়ের জন্য মন খারাপ করে আমাদের।পলাশ ফুলে বসন্ত উঁকি দেয়। শীত মেয়ে কোথায় চলে যায়!
“কোথায় গেল হলুদ মাখা ভোর
সেইটা নাকি তোর
রোদের হাসি কই
যেই মেয়েটা পাতিয়েছিল সই।
***
এমন ফাগুন মাসে
মন ভোলা দিন খুশির ভেলায় আসে
তোর চিঠিটাই পড়লো আকাশ ভুলে
বসন্ত-খাম খুলে।”
কবিতায় শীত এঁকে দিতে পারেন কবি, আমি তাকে একটা আকাশ একটা পাহাড় কিংবা নদী সাগরের জল তুলে দিই হাতে। তাঁর হাত ধরে আমি চলে যাই আকাশ-বাগানে, যেখানে কত তারাফুল ফুটে রয়েছে। সেখানে যেতে চাইলে মনকে রাত্রি-বাউল করে নিতে হবে। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মিঠির মতো আমারও মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে লিখে ফেলি একটা চিঠি। আমারও বলতে ইচ্ছে করে —
“তুমি তো লিখেছো আমাদের ছোট নদী
সমব্যথী-সাধ-নাম তার মতিবিল,
কবিতা লেখাটা আমাকে শেখাতে যদি
গড়তাম এক স্বপ্নের মঞ্জিল।”
তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমার আঁকার খাতা আলতো তুলির টানে ভরে ওঠে। আঁকাবাঁকা নদী, বাবলা গাছের সারি, রুগ্ন চাষী, ঝুপড়িতে থাকা ছেলে, দূরের গ্রামের মাটির বাড়ি, পাখির নীড়, আমলকি ডালের পাখি — সবই আঁকি তুলির টানে কাগজের ক্যানভাসে। ঘুমপরীরা চোখের উপরে সে বসে, উতল হাওয়ায় ভেসে যাওয়া স্বপ্নকে ধরতে ইচ্ছে করে। নীলজোনাকি গাছের পাতায় মাখিয়ে রাখে আলো, কবির চোখে তা সোনার জরি।
“রুম ঝুমঝুম নাচছে পরী জোছনারাঙা ঘরে
ইচ্ছেখুশি বৃষ্টি হয়ে বাড়ির চারিদিকে
আকাশ থেকে ঝরে
আমি কিন্তু ঘুমাই নি আর দেখছি রাতের তারা
মা আমাকে যতই ভোলাক ঘুমপাড়ানি গানে
দিচ্ছি না তো সাড়া।”
তারপর আস্তে আস্তে চাঁদ সরে গেলে চাঁদকে ডেকে নেয় ছোট্ট কবি। মাথার উপর উমুক্ত আকাশ তখন তো এক অচিনপুর, তাকেই মনের মধ্যে রেখে দিতে ইচ্ছে হয়, চাঁদ তাকে একটা গল্প লিখে দেয় আর তার স্বপ্নছড়া তখন রং তুলিতে রামধনু রঙ মেখে নেয়।
ছন্দে ছন্দে কবি কনক ঠাকুর ফুল চেনান ছোটোদের। ফুলের মতোই সুন্দর তাঁর সেই ছড়ার রং, তার গন্ধ। বেলি, জবা, জুঁই, শালুক, কামিনী, রজনীগন্ধা, লিলি, সূর্যমুখী থেকে টগর, কলকে, অপরাজিতা, গন্ধরাজ — ২৮টি ফুলের সাথে ছোটোদের পরিচয় করানো তিনি।
ও বেলি ফুল অঙ্গে তোমার
গন্ধ কিসের মাখা?
পান্না, চুনি মুক্তো,মানিক
চোখ দুটোতে আঁকা।
***
ঝলমলে রোদ পড়লে মুখে
মুখখানা হয় ম্লান
তাই কি তুমি শুনবে না আর
মৌমাছিদের গান?
গাছে গাছে লাল রং ঢেলে দেয় কেউ — খুকু কাছে এলে জবা ফুল মুখ তুলে মুখ টু-কি দেয়। ছোটো ছোটো সাদা ফুলের নাম জুঁই রাখল কে? মৌমাছি উড়ে এসে তার মন ভরিয়ে দেয় গানে গানে। গন্ধের রাজা গাছ ভরে ফুটে থাকে। ফুটফুটে জোছনায় কবির কবিতায় সে মুখ তুলে হাসে। আকাশের যত নীল যেন অপরাজিতার গায়ে মাখানো — সে নীল আলো ছড়িয়ে দেয় শিশুর মনে। চাঁপা ফুলের রূপের সাজবাহারে ভোমরা যখন আসে তখন তাদের মন মধুর গন্ধে ভরে যায়। শরতের ভোরবেলা গাছ থেকে ঝরা শিউলি ফুল মিষ্টি হওয়ারকে গন্ধে ভরিয়ে তোলে। চাঁদের আলোয় সাজে শ্বেতবসনা চন্দ্রমল্লিকা — “অঙ্গে হাসি আঁকা/ গন্ধ দিয়ে মাখা/ মনকে ভরে তোলে/ দোদুল দোদুল দোলে।” ফাগুনের ফাগ লাগে কাঞ্চন ফুলে। কবির মতো আমিও সেই ফুল তুলে নিয়ে সাজি ভরিয়ে তুলি। রূপের আলোয় ভুবন ভরিয়ে তোলে ডালিয়া — “অঙ্গে সোহাগ মাখা/ মুখটি ভরা হাসি।” মনকে হরণ করে বলেই সেই ফুল ভালোবাসি আমরা। বকুলতলা ভরে ওঠে বকুল ফুলে উঠোনে তৈরি হয় নানা ছবি। মিষ্টি রোদের অঙ্গনে ঝরে পড়ে রঙ্গন তার ছন্দ আমাদের মনকে দুলিয়ে দেয়।
কনক ঠাকুরের ছোটদের জন্য লেখা কবিতা পড়তে পড়তে বিশিষ্ট কবি দেবদাস আচার্যের লেখা একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়ছে। আমার সম্পাদিত ‘জীবনকুচি’ পত্রিকায় ‘ছড়ার সাতকাহন কবিতায় অবগাহন’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে কবি দেবদাস লিখেছিলেন, “ছড়ার সাতকাহন থাকলেও ছড়ার প্রধান পাঠক শিশুরাই। সেক্ষেত্রে ছড়ারচয়িতা শিশুদের কথা মাথায় রেখেই ছড়া লেখেন। পাশাপাশি এ কথাও ভাবা যায় যে, কেবল ছড়াই নয়, শিশুদের মনের উপযোগী কবিতাও লেখা হতে পারে। ছড়ার উৎকল্পনা, উদ্ভটত্ব, অনাবিল মজা, কৌতূহল ছাড়াও, শিশুদের মনের উপযোগী ‘শান্ত’ স্বভাবের বা শান্তরসের কবিতাও লেখা হয়।… ছড়াই অধিক প্রচলিত এবং বিশেষ জনপ্রিয় হওয়ায় কবিতার ক্ষেত্রটি বেশ অচর্চিত থেকে যায়। ছড়ার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তাকে আকর্ষণীয় করে ও শিশু মনে দাগ কাটে। কিন্তু কবিতায় প্রত্যুৎপন্নমতিত্বই যথেষ্ট নয়, তার একটু প্রসাদগুণও থাকা দরকার।আর এখানেই বেশ সমস্যা তৈরি হতে পারে। শিশুদের কাছে প্রসাদগুণ পরিবেশন করা সহজ কথা নয়।” কনক ঠাকুর শিশুদের মনে প্রসাদগুণ পরিবেশন করতে পেরেছেন। তাঁর কবিতার শিশু বলতে পারে,
“এবার পুজোয় বেড়াতে যাব না কোথাও
চুরি করে আকাশের নীল
ছড়ায় ছড়িয়ে দেবো মিল…”
কিংবা,
“একটু করে বড়ো হচ্ছি যেই
আমার মতো চলতে আমি শিখি
মেঘের মতো কোনো বাঁধন নেই
রামধনুকে রঙিন চিঠি লিখি।”
চোখ মেলতেই দিনের আলো চোখের উপর পড়ে। ভোরবেলাকার আবেশটুকু এক স্বপ্নমাখা সাজ যেন। আলোর পথে বাজনা বাজে মত্ত যখন ফুল, বাউল গানে গাছের পাতা দুলছে তখন দোদুল দুল। পাল তুলে দিয়ে নৌকাখানি চলে যাচ্ছে দূরে।লাল মেঘগুলোকে আমি কেড়ে নিই, গভীর রাতে তাঁর কবিতার জোছনা আমি ঘরে নিয়ে আসি।
‘তিতলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত