মাচানতলায় বিমানকে খানিকটা জোর করেই টেনে নিয়ে গেছিল অরুণ।
— আরে চলই না! তুই জানিস তো আমার বৌ বাচ্ছা হবার জন্যে কত মাদুলি, তাবিজ, কবচ, জলপড়া করিয়েছিল। কিছুতেই কিছু হয় নি। এখন দ্যাখ, বিরূপাক্ষ বাবার নিদানে আমাদের কোল আলো করে মিঠু এসেছে। তোরও একটা উপায় হবেই!
— দূর, আমার কিছু হবে না,
— আগে থেকেই এত অবিশ্বাস! মনে ভরসা রাখ।
মাচানতলায় তান্ত্রিক বিরূপাক্ষ বাবার আশ্রম শ্মশানের একদম গায়েই। বিমান চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। রাতের বেলায় কেমন লাগবে জানি না তবে দিনমানে তন্ত্রসাধকের ডেরা তেমন ভয়ঙ্কর কিছু নয়। বাবার আসনেও নরমুন্ড, হাড়গোড় কিছুই নেই। গুটি কয়েক শিষ্য এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। একটা বড় মনসা গাছ পুব দিকে। আরো চারপাশে বড় বড় গাছপালা রয়েছে। ফাগুন মাসের ফুরফুরে হাওয়ায় জায়গাটা মনোরম। ভক্তের দল নেহাত সামান্য। বাবা জটাজুটধারী হলেও বেশ নাদুস নুদুস। আশ্রমে ঢুকতেই ইশারায় বিমান আর অরুণকে বসতে বললেন।
— এক এক করে সমস্যা জর্জরিত মানুষ বাবার আসনের পাশে গিয়ে বসছে। তিনি উপায় বলে দিচ্ছেন মৃদুস্বরে। অন্যরা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। আশ্রয়প্রার্থীরা যে যেমন পারছে, সামনে রাখা থালায় দক্ষিণা দিয়ে চলে যাচ্ছে।
— এবার বিমানের পালা। তার হয়ে যা বলার অরুণই বলে দিল। বিরূপাক্ষ নিদান দিলেন,
— প্রতি পূর্ণিমারাতে নিজ হাতে গড়া দুটো আটার রুটি একটা কালো কুকুরকে খাওয়াবি। ছ’মাসের মধ্যে তোর উন্নতি কেউ আটকাতে পারবে না
— কুকুর! আবার কালো কুকুর, তাকে রুটি খাওয়াতে হবে! ওসব আমি কি করে পারব!
— অতশত আমি বলে দিতে পারব না। আমি উপায় বলে দিলাম। এরপর পারা না পারা তোমার ব্যাপার।
কোনোরকমে দক্ষিণা দিইয়ে অরুণ প্রায় টেনেই বিমানকে আশ্রম থেকে বে’র করে নিয়ে এলো। যাতে আরো কথার চাপানউতোর না হয়। সাইকেলে ঘরে ফিরতে ফিরতে অরুণ বন্ধুর ব্রেন ওয়াশ করে,
— সবেতেই অত বিরক্ত কেন হোস! জানি বাবার নিদান একটু অন্যরকম। তুই চেষ্টা করেই দ্যাখ না।
— তা বলে কুকুরকে খাওয়ানো! তুই জানিসই শালা কুকুর নিয়ে আদিখ্যেতা আমার মোটেই পছন্দ নয়।
এবার অরুণের হেসে ফেলার পালা। সত্যি সত্যি রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানো বিমান দু-চোখে দেখতে পারেনা। এই নিয়ে বহুবার ঝামেলা করেছে বিমান। অরুণকে বলেছে,
— পাবলিকের এতই যদি কুত্তাপ্রেম, তো বাড়ি নিয়ে গিয়ে পোষ ওদের। শালারা রাস্তায় হাগবে, মুতবে। এঁটোকাঁটা ছড়িয়ে রাখবে। পিলপিল করে বাচ্চা দেবে। মোটরসাইকেলের সামনে এসে পড়বে। নয় নিজেরা মরবে, না হয় অ্যাকসিডেন্ট করবে। মানুষের বাচ্ছার বিস্কুট জোটে না! শূয়োরের বাচ্চাদের লোক বিস্কুট কিনে খাওয়ায়! যত্ত সব।
— শূয়োরের বাচ্চা না কুত্তার বাচ্চা! — ঐ হোলো। সবই এক গোত্রের।
কুকুরবিদ্বেষী বিমান নিজের দোকানের বাইরের দেওয়ালে সাদা কাগজ সেঁটে বড় বড় করে লিখেছে, “আমার দোকান হইতে কুকুরের বিস্কুট কিনিবেন না”।
অরুণ জানে বিমান শুধু কুকুর না, আরো অনেক ব্যাপারে খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তার এই খ্যাঁচড়া মেজাজের চোটে একে একে সব বন্ধুরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। অরুণ যেতে পারেনি। অরুণ বোঝে তার শিশুশ্রেণীর বন্ধু বিমান নানা সমস্যায় জর্জরিত। মায়ের অসুখ। হাতে পুঁজি নেই। তাই বাপের আমলের বিস্কুট-লজেন্সের দোকান ঢেলে সাজানোর উপায় নেই। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়স অথচ বিয়েথা, সংসার এখনো কিছুই হল না।
অরুণ নিজের কাজকর্ম, সংসার সামলে মাঝে মাঝে বিমানের দোকানে এসে বসে। দুজনে খানিক সুখদুঃখের কথা বলে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে অরুণ যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। সম্বিত ফিরল বিমানের ঘ্যানঘ্যানানিতে।
— আমাকে ছেড়ে দে অরুণ। ঐ কুত্তা গেলানো আমার দ্বারা হবে না। কোনো শালা আমার ভাগ্য বদলাতে পারবে না। কালো কুকুর! পূর্ণিমা রাতে রুটি! যত ঢপের চপ বকওয়াশ।
— আবার তুই সেই এক কথা বলে যাচ্ছিস!
— বলব না তো কি! পূর্ণিমা রাতে কালো কুত্তা আমার হাতে খেতে আসবেই বা কেন?
অরুণ মনে মনে বলল, পথে এসো বাবা! যাক কুকুর ভাগানো, খ্যাচখেচে বিমান একটু হলেও যেন নিমরাজি হয়েছে। বিরূপাক্ষ বাবার নিদান মেনে বন্ধুর ভাগ্যকে সে ফেরাবেই!
— শোন, দোকান থেকে ফিরে রাতের রান্না তো তুইই করিস। মাসিমাকে করতে দিস না আজকাল।
— তাতে কি?
— আজ থেকে দুটো রুটি বেশি করবি। বাবা তো এমন বলেনি, যে শুধু পূর্ণিমা রাতেই কুকুরকে রুটি খাওয়াবি অন্যদিন খাওয়াবি না। রোজ একই সময় খেতে দিলে পূর্ণিমার দিন ও নিশ্চিত আসবে।
— কালো কুকুর কোথায় পাব আমি?
— আরে বিমান দেখিস নি। বিশ্বাস’রা যখন এ তল্লাট ছেড়ে কোলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেল, তখন ওদের কুচকুচে কালো বুড়ো কুকুরটাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। ভালো জাতের কুকুর-রে ওটা। এখন কেমন রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। তুই কাল থেকেই লেগে পড়। আ তু তু করে ডাকবি। রোজ খাওয়াবি। পূর্ণিমার আর বেশি দেরি নেই। তোর কার্যসিদ্ধি হবেই। দেখিস।
সেদিন চৈত্র পূর্ণিমা। গভীর রাত। বিমানের ঘরের জানলা দিয়ে তার মলিন বিছানায় চাঁদ যেন সোজা ঢুকে পড়েছে।
জ্যোৎস্নার মায়া বিমানকে ঘরের দাওয়ায় টেনে আনল। চারিদিক শুনশান। টবে লাগানো মায়ের গাছের বেল ফুলেরা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। কেমন যেন গা ছমছম করছে বিমানের। কোথাও কি একটা কুকুর ডাকছে! কেমন যেন কষ্ট পাওয়া ডাক!
বিমানও চাঁদের দিকে মুখ তুলে উঁ উঁ করে কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল না ডেকে উঠল!
একি, আমি এমন কুকুরের মত ডাকছি কেন! আমার গায়ের রঙটাও কেমন যেন বদলে যাচ্ছে! মা যে বলে, আমি নাকি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কালো রঙ এমন পাটকিলে রঙের কি করে হল? ঠিক যেন ঐ যেন রাস্তার কুকুরটার মত। আজ কালো কুকুরটার সঙ্গে জোট বেঁধে বেটা রুটি খেতে এসেছিল। আমি তাকে এক ঢিলে খোঁড়া করে দিয়েছি। রুটি খেতে দিইনি। শালাটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে, কেঁউ কেঁউ করে ভেগে গেল। আর আসে নি এদিক পানে!
কিন্তু আমি কেন এমন পাল্টে গেলাম? গায়ে বড় বড় পাটকিলে রঙের লোম! কান দুটো হঠাৎ বেড়ে গেল! আমি চার পায়ে হাঁটছি। সামনের দাঁত দুটো কেমন বেরিয়ে আসছে। আমার যে চাঁদের দিকে মুখ তুলে ডাক ছেড়ে খুব, খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে! উঁ উঁ উঁ উঁ….