অদ্বৈত মল্লবর্মণের লোকসংগীতনির্ভর প্রবন্ধ
বর্মণের সংগীতনির্ভর ১৪টি প্রবন্ধ রয়েছে। ‘অপ্রকাশিত বাউল সঙ্গীত’সহ সংগীতভিত্তিক রচনা ১৫টি। কিন্তু বাউল সংগীত বিষয়ক রচনাটি শুধু ছয়টি গানের সংকলন; এতে গানগুলোর কোনো আলোচনা নেই। কিন্তু বাকি রচনাগুলোতে গানের বিষয়বস্ত্ত, গানের অন্তঃসার, সমাজবাস্তবতা, পারিবারিক দুঃখ-নির্যাতন ও প্রেম-ভালোবাসাজনিত ঘটনাসম্পর্কের বর্ণনাসহ বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও লেখকের অন্তর্জাত অনুধাবনও তাতে ভাষারূপ লাভ করেছে। এজন্যে এ-রচনাগুলোকে আমি লোকসংগীত সম্পর্কিত প্রবন্ধ হিসেবে অভিহিত করতে চাই। নিম্নে ১৪টি প্রবন্ধের নাম উল্লিখিত হলো : ‘অপ্রকাশিত পল্লীগীতি’, ‘ত্রিপুরার বারমাসী গান’, ‘দুইটি বারমাসী গান’, ‘পল্লীসঙ্গীতে পালাগান’, ‘শেওলার পালা’, ‘বরজের গান’, ‘জলসওয়ার গীত’, ‘নাইওরের গান’, ‘পাখীর গান’, ‘উপাখ্যানমূলক সঙ্গীত’, ‘ভাইফোঁটার গান’, ‘পরিহাস সঙ্গীত’, ‘মাঘমন্ডল’ এবং ‘অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া’।
‘অপ্রকাশিত পল্লীগীতি’ রচনাটিতে একটি সারিগান এবং দুটো গাথা সংগীত অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পল্লীসংগীত মনন, চিন্তা ও কল্পনা দিয়ে গড়া নয়; তা পল্লীবাসীর নির্ভেজাল মনের উৎস থেকে উৎসারিত বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। পল্লীগান মনের উৎসজাত হলেও এতে মননের, চিন্তার ও কল্পনাশক্তির খোরাক প্রাপ্তব্য বলে আমি মনে করি। বর্ষাকালে পূর্ববঙ্গের নৌকাদৌড় বা নৌকাবাইচ খেলার মধ্যে বৈঠা যেমন রংবেরঙের হয়ে থাকে; তেমনি যারা নৌকাবাইচের কুশীলব তাদের মনেরও রংবৈচিত্র্য একটি প্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়। সারিগানটিতে রাধা কৃষ্ণের উদ্দেশে যেতে চাচ্ছেন; কিন্তু সমাজ, প্রতিবেশ ও পরিবারের লোকজন কর্তৃক তিনি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কৃষ্ণের জন্য তিনি অশ্রুবিসর্জন করছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুটো গাথা-সংগীতের একটিতে চাষির ছেলে বিনন্দের কোড়া পাখি শিকার করতে গিয়ে সর্পদংশনে মৃত্যু এবং অপরটিতে বুরুজ নামক এক ব্রাহ্মণ ‘ভুঁইমালী’ কর্তৃক জলপান করে এবং অতঃপর তাকে বিয়ে করে কীভাবে তার জাত নষ্ট করেছে সেকথা বলা হয়েছে।
‘ত্রিপুরার একটি বারমাসী গান’ লেখাটির মধ্যে প্রাবন্ধিক লিখেছেন, বারোমাসি গানে মূলত একজন স্বামী-বিরহিণী নারীর বারোমাসের বিরহ-বেদনার কারুণিক দৃশ্যই উপস্থাপিত থাকে। এই গানটিতে শান্তি নামক এক কন্যার, যার ধনী সওদাগরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এবং বিয়ের পর বারো বছরের জন্য সওদাগর বাণিজ্য করতে গিয়েছিল, সে-কথা বলা হয়েছে। সওদাগর বুদ্ধি খাটিয়ে এগারো বছর বাণিজ্য করে এক বছর পূর্বেই চলে আসে। ছদ্মবেশে সেই সওদাগর শান্তিকে প্রবৃত্তির প্রলোভন এবং প্রেমের প্রস্তাব করে। কিন্তু সতীসাধ্বী ও প্রকৃত সৎ প্রেমিকা শান্তি এই অপরিচিত ছদ্মবেশীর প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও কামাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করে না। পরিচয় পাওয়ার পর তারা বৈধ সংসর্গে সম্পর্কিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেয়েদের সতীসাধ্বিতার প্রমাণই আমরা শান্তির সৎচরিত্র সংরক্ষণের মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। শান্তির ছদ্মবেশী স্বামী শান্তিকে দেখে বলেছিল : ‘তোর যৌবন দেখে আমার চিত্ত নহে স্থির।’ (পৃ-৬৭); কিন্তু শান্তি ব্যক্তিত্বসম্পন্না ও সত্যনিষ্ঠ, সেজন্যে কঠোর জবাব তাকে নিম্নোক্তভাবে দেয় :
তুমি যেরে পরের ছাইলা, আমি পরের নারী
আমার কি রে শকতি আছে, দেখা দিতে পারি। (ওই, পৃ-৬৭)
শান্তি যদিও বলে ‘অভাগিনী শান্তির যৈবন আঞ্চল বাইয়া পড়ে।’ (ওই, পৃ-৬৮) তবুও ‘কোটরা ভরি’ বিষ খেয়ে সে মরলেও তার সতীত্ব সে বিসর্জন দেবে না। তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা এতই প্রবল যে, তার স্বামীকে তালের পিঠা, গাভীর দুধ খাওয়ানোর কথা সে ভাবে।
‘দুইটি বারমাসী গান’ রচনাটির মধ্যে রাধার এবং সীতার বারোমাসি গান অভিব্যক্ত হয়েছে। রাধা হলো বাঙালির লোকপ্রেমের অবিস্মরণীয় নায়িকা; শ্যাম বা কৃষ্ণ হলো নায়ক। সীতা শুধু ভারতবর্ষের নয়, পৃথিবীর সতীত্বগর্বী যে-কোনো নারীর প্রতিনিধি। রাধা এবং সীতার বারোমাসের দুঃখবোধ গান দুটোতে অভিব্যক্ত হলেও মূলত এটি রূপক প্রকাশ।
বাংলার পল্লী অঞ্চলের যে-কোনো কুলবধূর অন্তরের বিরহতাপিত বেদনার প্রতীকী বেদনাবোধই গান দুটোর ভাবভাষ্যের মধ্যে ভাষারূপ লাভ করেছে।
প্রবন্ধটির মধ্যে ভাটিয়ালি গানকে দুভাগে লেখক বিভাজন করেছেন। একটি হলো রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহমূলক এবং অপরটি হলো মানবজীবনের শেষ পরিণতি তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক ও ভালোবাসাবিষয়ক। ভারতীয় ও বাঙালি সমাজের রাধা-কৃষ্ণের প্রেম শুধু পল্লীজীবনে কুলবধূদের বিরহ ও কষ্টময়তার প্রতীককেই প্রতীকায়িত করে না, অধিকন্তু ধর্মজীবনেও এর প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করি। মহাভারতে আমরা কৃষ্ণকে প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে পাই। মানবাত্মা যে পরমাত্মারূপ স্রষ্টার সঙ্গে সতত মিলনোন্মুখতা মহাভারতে বিশেষভাবে বিশ্লেষিত আছে। মানুষের আত্মা যে স্রষ্টারূপ পরমাত্মার প্রেমে সর্বদা ব্যাকুল এবং এটিই যে সৃষ্টির মর্মগত গভীরতর তাৎপর্য — তাও আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
রাধার বারোমাসিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি রাধার প্রচন্ড বিরহ-বেদনা; যেহেতু কৃষ্ণ রাধাকে পরিত্যাগ করে মথুরায় চলে গিয়েছেন। রাধা কলঙ্ককে সহ্য করে কৃষ্ণকে ভালোবাসলেও কৃষ্ণ তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। কলঙ্ককে সহ্য করে বাঙালি রমণীরা। বাঙালির শাশ্বত প্রেমের নায়িকা রাধাভাষ্য লক্ষযোগ্য : ‘কৃষ্ণ প্রেমে মইলাম আমি রাই।’ (ওই, পৃ-৭২) রাধা তাঁর নয়নের জল দিয়ে মৃত্তিকা লেপচে এবং ‘যেথায় গেছে প্রাণের কৃষ্ণ যাব সেই পথে।’ (ওই, পৃ-৭২) কৃষ্ণের বিরহে রাধা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রাধা ‘অফলা কদম্বপুষ্প’ সযতনে তোলেন, কারণ ‘তুই ফুলেরে দেখিলে আমার কৃষ্ণ পড়ে মনে।’ (ওই, পৃ-৭৩)
‘সীতার বারমাসী’ গানটিতে অশোক বনে অবস্থানকালে সীতার দুঃখ ও বেদনাবোধ কারুণিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সীতা তাঁর বনবাসের পূর্ব হতে চতুর্দশ বছরের শেষ পর্যন্ত তাঁর কষ্টের কথাগুলো এই গানটির মধ্যে অভিব্যক্ত করেছেন। দৈবের লেখনে রামচন্দ্র রাজা না হয়ে বনবাসে যান; রাজা হন তাঁর কনিষ্ঠ ভরত। শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ মৃগ শিকারে গেলে দুরাচার রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে এলো :
একেতে রাবণ রাজা দুষ্ট দুরাচার।
রথে তুইল্যা সীতা দেবী লঙ্কা করল পার। (ওই, পৃ-৭৪)
বাঙালি রমণীরা স্বামী অন্তপ্রাণ। ‘যে নারীর পতি নাইরে পুষ্পের কি তার সাধ’ (ওই, পৃ-৭৫) ভাষ্যমধ্য দিয়ে স্বামীহীন অবস্থায় পুষ্পের প্রয়োজনীয়তা যে নিষ্ফলতায় ম্লান হয়ে পড়ে, তাই স্পষ্টভাষিত হয়েছে। এই গানটির রচয়িতা শ্রীধর বণিক। যাঁর ছেলের নাম ছিল প্রজাপতি। গানটির শেষে পিতা-পুত্রের উল্লেখ রয়েছে। এই সতী সীতার গানটি যে শোনে অথবা যে গায় — তার পাপ খন্ডিত হয় বলে গানটির শেষ লাইনটিতে উল্লিখিত হয়েছে। রামচন্দ্র সচ্চরিত্রবান; তাঁর স্ত্রী সীতাকেও রাবণ কলঙ্কিত করতে পারেনি, তাঁর সতীত্বের স্পর্ধার কারণে। পুণ্যবানদেব কাহিনি শুনলে অবশ্যই পুণ্যলাভ হতে পারে। কারণ :
পুষ্পের মধ্যে কনক-চাম্পা ধানের মধ্যে খাম
নারীর মধ্যে সীতা সতী পুরুষের মধ্যে রাম। (ওই, পৃ-৭৬)
‘পল্লীসঙ্গীতে পালাগান’ রচনাটির মধ্যে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, কাঞ্চনমালা, মধুমালা, মালঞ্চমালা, মহুয়া প্রভৃতি কাহিনির অন্তর্গত জীবনসত্যকে হৃদয়বান সকল মানুষেরই মনে রাখতে বাধ্য। পল্লীগীতিকাসমূহের সংগ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও তাত্ত্বিক ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনকে লেখক খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। ‘পল্লীসঙ্গীতে পালাগান’ প্রবন্ধের মধ্যে তিনি ‘বিনোদের পালা’ ও ‘কটুমিঞার পালা’দ্বয় বর্ণনা করেছেন।
বিনোদের পালায় বিনোদ একজন পাকা কোড়া শিকারি। সংসারে তার মা, বউ এবং বোন রয়েছে। রাতে বর্ষাকালে শ্বাপদ পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে কোড়া শিকার করতে যায় বিনোদ। একটি শিকারি কোড়ার মাধ্যমে বন্য কোড়াদের জীবন্ত ধরে আনে কোড়া শিকারি বিনোদ। কিন্তু সর্পের কামড়ে বিনোদ মারা যাওয়ার সময় আর্তনাদ করে বলে যে, সে তার মায়ের কাছে যেতে চায়। বিনোদের যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে বিনোদের বোন অর্থাৎ তার স্ত্রীর ননদ খুব ঝগড়া করে। কিন্তু স্বামীকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার স্ত্রী প্রতিবেশীর নিকট থেকে চাল ধার করে এনে তার স্বামীকে খাইয়ে অতঃপর কোড়া শিকারে পাঠায়। তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদে তার জীবনের সব লক্ষ্যই শেষ হয়ে গেল :
অভাগিনী স্ত্রী কান্দে আর ত লক্ষ্যা নাই। (ওই, পৃ-৮১)
(ক্রমশ)