সোমবার | ২রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৪২
Logo
এই মুহূর্তে ::
পাশাপাশি, তবে প্রাণ নেই, চিহ্ন বইছে ভেলুগোন্ডা, রবিবার জল সরার পরে : অশোক মজুমদার নলিনী বেরার কবিতা — স্বভূমি, স্বদেশ, স্বজন : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (প্রথম পর্ব) : রহমান হাবিব রংবাহারি ক্যাপসিকাম : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যের কৃষকমান্ডিতে কৃষকদের ধান বিক্রিতে দালাল মুক্ত করার নির্দেশ সরকারের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘উচ্ছেদ’ আমাদের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নানা মত : তপন মল্লিক চৌধুরী বেঙ্গল গোট গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনে দিতে পারে স্বচ্ছলতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পিটার নাজারেথ-এর ছোটগল্প ‘মালদার’ অনুবাদ মাসুদ খান আমরা নারী-আমরাও পারি : প্রসেনজিৎ দাস ঝুম্পা লাহিড়ীর ছোট গল্প “একটি সাময়িক ব্যাপার”-এ অস্তিত্ববাদ : সহদেব রায় ঝুম্পা লাহিড়ী-র ছোটগল্প ‘একটি সাময়িক বিষয়’ অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস ঠাকুর আমার মতাে চিরকালের গৃহীর চিরগুরু : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ভাবাদিঘির জট এখনও কাটেনি, বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি রেল চলাচল শীঘ্রই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (শেষ পর্ব) : অভিজিৎ রায় উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত মারাঠাভুমে লাডকি বহিন থেকে জয়, ঝাড়খণ্ডে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী প্রচারে হার : তপন মল্লিক চৌধুরী কিন্নর-কৈলাসের পথে : বিদিশা বসু হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (চতুর্থ পর্ব) : অভিজিৎ রায় ভনিতাহীন চলন, সাইফুর রহমানের গল্প : অমর মিত্র সাইফুর রহমান-এর বড়োগল্প ‘করোনা ও কফিন’ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (তৃতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

নলিনী বেরার কবিতা — স্বভূমি, স্বদেশ, স্বজন : ড. পুরুষোত্তম সিংহ

ড. পুরুষোত্তম সিংহ / ৩০ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪

কিছুটা আড্ডার ঢঙে শুরু করা যাক। কেননা ‘মস্করাই বেঁচে থাকার মূলধন’ (রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়)। আবার অমর মিত্র লিখলেন ‘আড্ডাবাজের জীবন’। তাঁর মনে হল—“আড্ডা ব্যতীত জীবন চলতেই চায় না। কিছু না হলে না হবে। চাই না কিছু। আড্ডা চাই। গল্পের আড্ডা। সাহিত্যের আড্ডা।” (আড্ডাবাজের জীবন, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে, আত্মজা পাবলিশার্স, পৃ. ১৩৭) অমর মিত্রের ‘কফিহাউস—না লেখা বই’ গদ্য থেকে একটি উদ্ধৃতি আমরা তুলে আনবো —“কফি হাউসে না গেলে মুরাকামী কিংবা মাহমুদুল হকের বই আদান প্রদান হয় না। শ্যামল না শীর্ষেন্দু এই নিয়ে বা সদ্য পড়া গল্প উপন্যাস নিয়ে তক্কো-বিতক্কো হয় না। এসব না হলে সাহিত্যের আড্ডা হয় কী করে? নলিনী তাঁর উপন্যাস গল্পের বাইরে কবিতা বের করেন ঝুলি থেকে। দিয়ে বলেন, পড়ুন দেখি।” (তদেব, পৃ. ১৪৭) আমাদের অর্ধ আড্ডা পর্ব শেষ হল। আমরা পেয়ে গেলাম কবি নলিনী বেরাকে। আখ্যানকার হিসেবে নলিনী বেরার বিপুল পরিচয়ের বাইরে রয়েছে কবিসত্তা। যদিও কবিতা দিয়েই তিনি সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন। আখ্যানকে যে মায়াবী স্পর্শে বা ভাষার জাদু দিয়ে বুনে চলেন তা যেন কবিতাই। নলিনী বেরার আখ্যানভূমি থেকে কবিসত্তাকে চিহ্নিত করা সচেতন পাঠকের খুব বেশি কঠিন কাজ নয়।

নলিনী বেরার কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে ফেলে আসা জন্মভূমির স্মৃতি। স্মৃতিময় স্বভূমিই তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়। কী গল্প-উপন্যাস কী কবিতা সবই তার জন্মভূমির রোমন্থন। নিজের শেকড়ের সন্ধান। সুবর্ণরেখা নদীর তীরবর্তী মানুষ, জনজীবন, স্বজন-প্রিয়জনই যেন তার সাহিত্যের কাঁচামাল। কোনো কোনো সাহিত্যিক সারাজীবন ধরে একটি বিষাদময় কাব্যই রচনা করতে চান। যতই লেখেন তবুও যেন ফুরায় না। আবার সেই জনপদ জীবন নিয়ে শুরু করেন। উপন্যাসে তিনি ভিন্ন পরিসরে, ভিন্ন প্লট নিয়ে বিচারণ করেছেন ঠিকই কিন্তু তার লেখার সিংহভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে ঝাড়খণ্ড, সুবর্ণরেখা, দামোদর নদী তীরবর্তী অঞ্চল। ‘সে জানে শুশনি পাতা’ কাব্যের প্রথম কবিতাতেই সে চিত্র আবারও ফুটে উঠল। পরবর্তী কবিতা সরণিতেও অবধারিত ভাবে সে চিত্র আবারও ফুটে ফুটবে। কেননা তিনি একটি অঞ্চলের মহাজীবনের রূপকার। সত্যদ্রষ্টা ঋষির (প্রাচীন নয় আধুনিক) মতো দশকে দশকে সে অঞ্চলের যাপিত জীবনসত্য নিজে যেমন উপলব্ধি করেন তেমনি পাঠককেও পড়িয়ে নেন। আমারাও নলিনী বেরার নয়ন দিয়ে ঘুরে আসি সেইসব প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে। তার নিজস্ব একটি ভাষা আছে। সে ভাষা এমন মায়াময়, এমন স্পর্শময়, এমন এক কারুণ্যবোধ শব্দের অন্তর্দেশে প্রবেশ করে থাকে যে হৃদয়ে স্পর্শ করে। আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার প্রায়ই থাকে কিন্তু জটিল শব্দবন্ধ, আধুনিক সাহিত্যের আলপটকা শব্দ থেকে তিনি দূরে থাকেন। আটপ্রৌঢ় শব্দ নিয়েই তার কারবার। কিন্তু শব্দের একটা রঙ থাকে, একটা মাধুর্য থাকে। এখানেই তিনি জয়ী হয়ে যান। প্রথম কবিতা ‘টেলিফোন’। যুগ বদলের চিহ্নবহনকারী বার্তাবাহক। পিতামাতা সন্তানের কাছে চিঠির প্রত্যাশা করত। কিন্তু দিন বদলে গেছে। চিঠির স্থান দখল করেছে টেলিফোন(তখনও মোবাইলের রমরমা হয়নি) চিঠিতে পিতামাতার স্পর্শ, জন্মভূমির স্পর্শ লেগে থাকতো, টেলিফোনে কি স্পর্শ লেগে থাকে? টেলিফোনে মৃদুময় কণ্ঠস্বর ভেসে আসে ঠিকই কিন্তু টেলিফোন কেনার যে সাধ্য নেই সুবর্ণরেখা নদীতীরবর্তী ভূমিজ অধ্যুষিত মানুষদের। কবিতায় শুনতে পাই —

“আমরা জানি না, জানি না, তোমরাও জানো না, সে তো জানে অঞ্চল-বিডিও

নদীধারে ছেলেকে বিদায় দিতে এসে চুমো খায় বাবা, বলে—‘চিঠি দিও’

জলতল ছেড়ে সরাল শামখোল উড়ে যায়, পড়ে থাকে পালক, কুটো

জললিপি জলটুঙি থেকে দেয় হাঁক—হটো হে বন্দুকবাজ, দূর হটো”

(টেলিফোন, সে জানে শুশনি পাতা, মহুল প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০০৫, পৃ. ১০)

ভুঁড়িদাসরা হয়ে যায় কবির সঙ্গী। চাঁদ ডাকে আয় আয়। হাতছানি দেয়। চাঁদের ওম এসে স্পর্শ বুলিয়ে দেয়। একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষের পক্ষে এই ডাক উপেক্ষা করা কি সম্ভব? পিছনে পরে থাকে ভোগের মালসা (হে মাননীয় পাঠক মহাশয় কবির শব্দগুলি লক্ষ্য করবেন)। ঘরকুনো হয়ে থাকলে এই পৃথিবীর সৌন্দর্য যে কিছুই জানা হবে না তা কবি জানেন। ‘মোহগর্তে’ লুকিয়ে থাকলে সৌন্দর্যবোধ যে ‘মহাগর্ভে’ই তলিয়ে যাবে এ সত্য কবির থেকে আর কেই-বা বেশি জানে। কবিতায় ধ্বনিত হয়—“জোছনায় থুবড়ে মুখ শুয়ে রব ঘাসে ডোবাবো শিশিরে জিহ্বা” (চন্দ্রপূজা, তদেব, পৃ. ১১) তিনি সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ। সুবর্ণরেখার সঙ্গে তার নাড়ির যোগ (এই কথাগুলো বারবার উচ্চারণ করতে হবে, পাঠকবর্গ ক্ষমা করবেন। কেননা তিনি সেই জীবনের কথাই লিখতে চান, বারবার সেই জীবন, নদী, মানুষ উঠে আসে লেখনীতে)। সুবর্ণরেখাকে তিনি মায়ের মতোই ভালোবাসেন (পাঠকবর্গের বোধহয় খেয়াল আছে সুবর্ণরেখা তীরবর্তী জনজীবন নিয়ে তার লেখা পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ র কথা) একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষের পক্ষে নিজের নদীকে ভোলা সম্ভব নয়। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে যে নদীভূমি জড়িয়ে আছে তাকে ভুলবেন কী করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি অমর মিত্রের ‘একটি গ্রাম একটি নদী’ উপন্যাসের কথা। নায়ক বিল্বমঙ্গলের নিজের নদী কপোতাক্ষ। দেশত্যাগে নিজের নদীকে হারাতে হয়েছে। অন্যদিকে দেবাংশুর নিজের নদী আছে, সে নদী দামোদর। দেবাংশু নিজের নদী নিয়ে বিল্বমঙ্গলের কাছে নানা গল্প ফাঁদে। বিল্বমঙ্গলের বড় ইচ্ছা দেবাংশুর নদী একদিন দেখে আসবে। কিন্তু দেবাংশু নিয়ে যায়নি। অবসর নেওয়ার পর বিল্বমঙ্গল ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে এক তরুণীর সঙ্গে। সেই কপোতাক্ষের ছবি পাঠায়। বিল্লমঙ্গল ফেসবুকে বসেই নিজের নদী আবিষ্কার করে। নদী হারানোর দুঃখ ভোলে। পাঠকবর্গের অবশ্যই মনে আছে কপোতাক্ষকে কেন্দ্র করে মধুসূদনের সেই স্মরণীয় কবিতার কথা। প্রত্যেকেরই একটা করে নিজস্ব নদী আছে। যার নেই সে মনের মধ্যে একটি ধারণাকে বহন করে চলে (যেন অনেকটা গঙ্গা সবার মা’র মতো, পাঠকবর্গ মনে করে দেখুন ভুপেন হাজারিকার সেই ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ গানের কথা)। নলিনী বেরার নদী সুবর্ণরেখা। ‘সুবর্ণরেখা’ কবিতাটি আমার বড় প্রিয়। নদী, পিতা-মাতা, জন্মভূমি সেখানে সব একাকার হয়ে যায়—

“সুবর্ণরেখা যদি বা নদীর নাম আমারো মায়ের ওই নাম ছিল

বাবা ত নিয়ত মাকে ওই নামে ডেকে যাবতীয় কথা

কুলকুচোর মতো ফেলে রেখে চলে যেত নদীটার দিকে

নাকি সে-নদীর রূপ মা আমার ধরেছিল বস্তুত জীবনে

আমি ভাবি নদীই জননী ছিল নদী তো মায়ের মতো হয়”

(সুবর্ণরেখা, তদেব, পৃ.১২)

নদী নিজের ক্রিয়াতেই চলমান। চলমান জলস্রোতে কত কী ভেসে যায় তার খবর কি নদী রাখে? রাখা সম্ভব? দুইপাড়ের ভাঙনে নদীর কী-বা এসে যায়! জলেরও তো নিজস্ব খেলা আছে। নিজস্ব উৎফুল্লতা আছে। তবে সবই শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ। রাজহংস ডুবে যায়, উঠে আসে বুদ্বুদ। গ্রামীণ মানুষের কাছে হাঁস মুরগি অর্থনীতির ভিত্তি। সেই হাঁস যদি নদীর পাকে ডুবে যায় নদী কি আর প্রিয় থাকে অভাবী মানুষের কাছে? অভাবী মানুষের পক্ষে কি শতদলের সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব? বরং তার প্রয়োজন পদ্ম ও পদ্মপাতা যেখানে একটু অর্থের আভাস রয়েছে। সেই পদ্মও যদি জলস্রোতে ডুবে যায় প্রিয় নদী হয়ে যায় রাক্ষসী। ‘ম্রিয়মান রোদ্দুরের দিকে’ অসাধারণ কবিতা। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে চলে আলো-অন্ধকারের খেলা। সময় যেন সর্বদা সবকিছুকে পিছনে ফলে দিতে চায়। পথের নিজস্ব গতিবেগ আছে, নিজস্ব চলন আছে। সেই গতিবেগের সঙ্গে সমানতালে চলা পথিককে যেন পথের বড় প্রিয়। কিন্তু যে গতিবেগের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনা তাকে পথ যেন বলতে চায় তুমি বিশ্রাম নাও পথের ধারে (‘পথের ধারে আমার দেবালয়’ এইসব কবিতার কথা এপ্রসঙ্গে মনে করার প্রয়োজন নেই, ‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি’—এহ বাহ্য) কিন্তু লক্ষ্যস্থলে সবাইকে তো পৌঁছতে হবে। রোদ থেকে রোদের কিনারে, পথ থেকে পথের কিনারে, দুপুর থেকে বিকালের কিনারের প্রসঙ্গ এনে আলো থেকে অন্ধকারের যাত্রাকেই কবি স্পষ্ট করে তোলেন। কিন্তু স্বজন সান্নিধ্য থেকে তো মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না। যেখানে নাড়িতে নাড়িতে যোগ বড় হয়ে উঠেছে সেখানে মিলন তো হবেই—

“যে যায় রাস্তার পীচে ম্রিয়মান রোদ্দুরের দিকে

স্বজন-সান্নিধ্য তারা ঠিক পাবে

আমার ভীষণ ইচ্ছা করে যেন কথা কয়ে উঠি :

যে হও গাঁয়ের লোক, বলো, মা কেমন আছে”

(ম্রিয়মান রোদ্দুরের দিকে, তদেব, পৃ. ১৪)

অভাবী জীবন সাঁওতাল, শবরদের। যেখানে দারিদ্র সেখানে লজ্জা গ্লানির ভয় কম। ক্ষুধাই যেখানে বড় সত্য সেখানে বস্ত্রের মূল্য কতটুকু? আমরা চেতনায় আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক জগতে পদার্পণ করেছি তবুও আমাদের দেশের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ভাবনা দূর হয়নি। দরিদ্র মানুষের কাছে শ্লীল-অশ্লীল কোন ধারণা নেই। তেমনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গ্রামীণ মানুষের পোশাকও বিচার করা সংগত নয়। ‘অশ্লীল’ কবিতায় উচ্চারিত হতে শুনি— “আমার মায়ের শাড়ি ভিজে/কিছু লজ্জা নিবারক দাও হে পশম” (পৃ.-১৫) নলিনী বেরার সাহিত্যধারা গড়ে উঠেছে আত্মজৈবনিক ঢঙে। কবির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ব্যক্তিবর্গ জানেন স্বভূমির জন্য তার কার্যকলাপের কথা। তেমনি ছোটকাকা, ছোটকাকিমার প্রসঙ্গ তার বহু গল্পে এসেছে। এই মুহূর্তে মনে আসছে ‘হোমগার্ডের জামা’ গল্পের কথা। ছোটকাকিমাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘চাঁদের জন্যই’ কবিতাটি। কবিতাটি প্রকৃতিকেন্দ্রিক। শহরে অবস্থানরত কবির মনে পড়েছে কাকিমার কথা। জ্যোৎস্নাই যেন কবিকে মনে করিয়ে দেয় কাকিমার কথা। জ্যোৎস্নাকে এখানে আমরা যদি আলোর দূত ধরে নেই তবে আলো তো সম্পর্কের সেতুকে দৃঢ় করবেই। ছোট বয়সে কাকিমার বিবাহ হয়েছে। সংসারের সমস্ত কর্ম সামলাতে পারেন না। সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু ফুটফুটে মুখের রঙিন হাসি যেন জ্যোৎস্নায় আরও শোভা পায়। উপমা, প্রকৃতি ও কাকিমার কথায়, মেলবন্ধনে অপূর্ব চিত্র রচিত হয়—

“চাঁদের চাঁদোয়া শাড়ি গায়ে দিয়ে অঘোরে ঘুমোন

কোনদিন রাতে উঠে দ্যাখেন অমল ধবল জ্যোৎস্না অগোছাল

পড়ে আছে বারান্দায়, হয়তো ধানের শিরে, দীঘির চাতালে

শুরু হয় বকুনি বকুনি, রজনী জানে না ঘর গুছাতে গাছাতে

না হয় আধেক জ্যোৎস্না এতক্ষণে জমা হয়ে যেত ভাঁড়ারে নিশ্চিত”

(চাঁদের জন্যই, পৃ.২০)

সৈকত রক্ষিত লিখেছিলেন—“খালি পায়ে যাব / সহস্র খালি পায়ের কাছে।“ এই হল লেখকের জীবনদর্শন। সংগত কারণেই উদ্ধৃতি আমরা তুলে আনলাম কেননা নলিনী বেরার জীবনদর্শন ঠিক এমনই। যিনি লিখেছেন—শবরচরিত লিখে যেন শবর হারা হলাম। আবার ‘আনন্দ পুরস্কার’ এর অভিভাষণে জানিয়েছেন— এই পুরস্কারের মধ্য দিয়ে সাঁওতাল, লোধা, শবর সহ সাবঅলর্টান মানুষদেরই জয় ঘোষণা হল (প্রিয় পাঠকবর্গ আপনাকে মূলের জন্য ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’র ভূমিকা পড়ে নিতে হবে)। তিনি কী লিখতে চান বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। ‘হলুদ আলো’ কবিতায় পাই—“কী ভীষণ পথ আমি পায়ে পায়ে হাঁটি কবিতায়/কবিতা আমার তোমার মাঝে ব্রীজ হ’য়ে গেল” (পৃ.২২)। কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি হেঁটে যেতে চান সেই জনজীবনের কাছে। কবিতা যেন তার কাছে হেঁটে চলার দর্শন, পথের দর্শন, পথিকের দর্শন। হলুদ আলো ঝড়ের সংকেত বহন করে আনে। কিন্তু তিনি তো ঝড়কেই আলিঙ্গন দিতে চান। যেন ঝড়ের সঙ্গে অভিসারে মত্ত। আর যেখানে অভিসার সেখানে পৌঁছনো তো অবধারিত সত্য। এ অভিসার জন্মভূমির সঙ্গে। কোন প্রতীকি অভিসার নয়। এক ভালোবাসার দায়বদ্ধতা।

আবার সৈকত রক্ষিতের কাছে আশ্রয় নিতে হল। পাঠক মহাশয় বুঝি বড় ক্ষুব্ধ হচ্ছেন নলিনী বেরার কথা বলতে গিয়ে বারেবারে সৈকত রক্ষিত কেন! হ্যাঁ মহাশয় প্রয়োজন আছে। ‘লেখা এক অপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ শীর্ষক বয়ানে সৈকত রক্ষিত জানিয়েছেন—“আমার লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হবে কথাসাহিত্যের মধ্যে এই পুরুলিয়াকেই প্রতিবিম্বিত করা। পুরুলিয়াকে ডকুমেনটেশন করা।“ তিনি পুরুলিয়া দর্শনের মধ্য দিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে জানতে চেয়েছেন। ক্ষুদ্র ভূগোলের সত্যই যেন তার কাছে বৃহৎ ভূগোলের সত্য পরিণত হয়েছে। সেইসব শবর, লোধা সহ প্রান্তিক মানুষদের জীবনচিত্র সম্পূর্ণ জানলে আর ভারতবর্ষের প্রান্তপ্রদেশের মানুষদের কথা জানার প্রয়োজন হয় না। ক্ষুদ্র ভারতবর্ষের মধ্য দিয়েই যেন বৃহৎ ভারতবর্ষের প্রকৃত রূপ দর্শন। নলিনী বেরা সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী জনজীবনের সত্য জানতে চেয়েছেন, আমাদের জানাতে চেয়েছেন। নলিনী বেরা ‘ভারতবর্ষ’ কবিতায় নিজের পারিবারিক জীবনের চিত্র এঁকেছেন। আঁকতে বাধ্য হয়েছেন। এই আঁকার মধ্য দিয়েই গোটা ভারতবর্ষের চিত্র আমরা জেনে নিতে পারি। একান্নবর্তী পরিবারে বহু মানুষের সমাগম। তবে কোনো মান-অভিমান নেই। নেই একে অপরের প্রতি দোষারোপ। এক ভালোবাসার স্নিগ্ধ ধারা যেন প্রবাহিত। পাঠক মহাশয় নলিনী বেরার গল্প পড়লে এই সত্য গুলি আপনার কাছে আরও বেশি করে স্পষ্ট হবে। কথকতার পাঠ পেয়েছেন পিতার কাছ থেকে। সংসারে দরিদ্র্যতা। কবি সেই সত্যগুলি কখনো আড়াল করেননি। স্বনামেই উপস্থিত করেন। নলিনী বেরা লিখতে বসে কখনো ভান করেন না। কারও কারও কাছে হয়ত কল্পনা মনে হতে পারে (তখন কবি অলক্ষ্যে বসে হাসেন)। আসলে এগুলি বাস্তব সত্য। যাপিত জীবনের সত্য উঠে আসে কবিতায়—

“নদীদহে কালীদহে আমাদের রূপোকাকা আমাদেরই কালীকাকা

মেয়ের বিয়ের যৌতুক প্রার্থনা করে হা-পিত্যেশ বসে থাকে ঠা ঠা

কখন উঠবে দহের ভুত হাতে নিয়ে সোনাদানা বাক্স পেঁটরা

এভাবেই মানুষ আমরা আমাদের যাবতীয় আশা ও প্রত্যাশা”

(ভারতবর্ষ, তদেব, পৃ. ২৭)

যাপিত জীবনের সত্যকে সামনে রেখেই তিনি কবিতা গড়ে তোলেন। দেশ-পাড়া গাঁ’র যে আদুরে পরিবেশে তিনি বড় হয়ে ওঠেন তাই কাব্যবীণায় বেজে ওঠে। এই পাড়া গাঁ’র চিত্র তিনি কোন কবিতা পড়ে জানেননি। গ্রামের চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়ছেন, বড় হয়ে মিলিয়ে পড়েছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতা। তাই ‘কবিতার মাস’ কবিতায় ধ্বনিত হয়—“সমাগত কবিতার মাস, কবিতা কোথায় খুঁজি/ আমি যে পালিত আছি গাঁয়ে, কবিতাও আছে” (পৃ. ২৮) পৃথক ভাবনা, পৃথক জীবন পরিসর নিয়ে তিনি লেখা শুরু করলেও স্বদেশ-স্বজন এসে উঁকি দেয় সেখানে। আসলে অশ্বরোহী সৈনিকের মতো তিনি বারবার স্বদেশের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চান। স্বদেশ-স্বজনই যেন তার হাতে ভালো ফুটে ওঠে। সেটাই তো স্বাভাবিক। যে জীবনের একশো শতাংশ তিনি জানেন তা যে মর্মে, চিন্তায় বারবার উঁকি দেবে তা তো স্বাভাবিক। ‘বৃহন্নলা’ কবিতায় দেখি স্বভূমিতে এসেছে রাজ্যসরকারের খাদ্য দপ্তরের উচ্চপদস্থ অফিসার ও খ্যাতিমান লেখক নলিনী বেরা। কিন্তু এই নলিনী বেরা তো গাঁয়ের চাষাভূষো সাঁওতাল, শবরদের কাছে ছোট্ট নলিন। মঞ্চে উঠে সংস্কৃতির সংকট, বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছেন লেখক (কবির কথা বলতে গিয়ে লেখকসত্তার কথা বারবার উঠে আসছে কেননা কবি অপেক্ষা লেখক হিসেবেই তিনি আমার /আমাদের কাছে সমাধিক পরিচিত)। হাগরীর মাতার কাছে সংস্কৃতির সংকটের মূল্য কতটুকু? অবধারিত ভাবে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে কিছু সত্য। লেখকও নির্ভেজালভাবে উচ্চারণ করে চলেন—

“আজ দেখি কাঠকুড়ানিসহ একটি ছাগল

টপকে দেয়াল ঢুকেছে মাঠে যেই আমিও হঠাৎ

মঞ্চে উঠে শুরু করি : সমস্ত পুস্তকপ্রেমী কবি ও লেখক

          শোনো শোনো পঞ্চজন—

অমনি খিঁচিয়ে মুখ তেড়ে আসে হাগরীর মা

কাঠকুড়ানী ও একটি ছাগল

 

বলে কী না- বুড়োভাম পাগল পাগল

সে তো জানে না আর আমিই অর্জুন, এখন বৃহন্নলা

আমার বাবার নাম গিরিশচন্দ্র মা দেবী ঊর্মিলা”

(বৃহন্নলা, তদেব, পৃ. ৩০)

দুই

নলিনী বেরার কবিতা মুগ্ধ হয়ে পড়ি। এক মাধুর্যবোধ কবিতার শরীরে লেগে থাকে।  সে স্পর্শের অনুভূতি আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে। আজ আর বৃহৎ স্বদেশ চেতনার প্রয়োজন নেই, বা সম্ভব নয়। গ্রাম, স্বদেশভূমিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই যেন নিজের দেশকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। স্বদেশভূমিকে ভালোবাসার জন্য ত্রিবেনীর গঙ্গায় ডুব (পাঠক গোরার কথা মনে করতে পারেন) দেওয়ার প্রয়োজন নেই, নিজের স্বভূমির ছোটো জীর্ণ নদীতে ডুব দিলেই পূণ্য অভিষেক হবে। নলিনী বেরার জন্ম ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের ওড়িশা ঝাড়খণ্ড সীমান্তের কাছাকাছি ঝাড়গ্রাম মহুকমার সুবর্ণরেখা নদী তীরবর্তী সাঁওতাল লোধা ভুঁইয়া ভূমিজ অধ্যুষিত জঙ্গলাকীর্ণ কীর্তনখোলার বাছুড়খোঁয়াড় গ্রামে। স্বদেশভূমির স্মৃতিচারণ করেছেন ‘কীর্তনখোলা’ কবিতায়। জন্মভূমিও যেন নিজের ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতির অপূর্ব চিত্র। চাঁদও যেন গ্রামের চাঁদকে চিনে নিয়েছে। যমকের বর্ণচ্ছটায় কবিতায় এক মায়াভূমি রচনা করেন। পড়তে পড়তে আমরাও যেন কোথায় ডুবে যাই। কোনো বিশেষ ভাব বা তত্ত্ব নয়, একেবারে সহজ সরল ভাষায় তিনি জীবনের গভীর তলদেশে নিয়ে যান। যেখানে লুকিয়ে আছে একাধিক সত্য। সেই সত্য বয়ানগুলি একে একে উন্মোচিত হয়। যার মধ্য দিয়ে আমরা চিনে নিতে পারি সীমান্ত এলাকার পরিবেশ, মানুষ, সংস্কৃতিকে। এই কবিতাটি শুরু হয়েছে একেবারে সরল ভাবে—

“বহুদিন বাদে বাড়ি ফেরা হল, বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে

কিছুটা খাবার খেয়ে গোঠটাঁড়ের মাঠে উপস্থিত হয়ে

ঘাসভূমে শুয়ে চাঁদ দেখা হল, চাঁদের সঙ্গে আলাপন হল

কিছুক্ষণ চাঁদের সঙ্গেই, ”

(কীর্তনখোলা, তদেব, পৃ. ৩১)

এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। কবিতার শেষবিন্দুতে গিয়ে আরও এক সত্য আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বভূমির কথা, স্বভূমিতে আমন্ত্রণের কথা—

“কীর্তনখোলা গ্রামের তটভূমে সুবর্ণরেখায় তুমিও অবশেষে

এসো বন্ধু এসো, বোসো, ভালোবেসো আমাদের উঠোনে জোছনায়

শীতলামঙ্গল পালা গাওনা হবে, সুরথ বাজবে খোল যাত্রায়।”

(কীর্তনখোলা, তদেব, পৃ. ৩১)

এখান থেকে আমরা শুধু যদি ‘গাওনা’ শব্দটি বেছে নেই তবে দেখা যাবে তিনি একশো শতাংশ সত্য বলছেন। তিনি ‘গাওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। সত্যের অপলাপ করেননি। কোন চাপিয়ে দেওয়া কথাবার্তা বা শব্দ বুনে চলেননি। এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। জন্মভূমির সীমা-পরিসীমা, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমা রেখে মেপে নিতে চান। অভাবী সংসার। বালকের নেই গ্লোব-ভূমণ্ডল। যা দিয়ে তিনি জন্মভূমির ভূগোলকে জেনে নিতে চান। কিন্তু জন্মভূমির মানুষকে মাপবেন কী দিয়ে? বাল্যকাল থেকেই দেখেছেন পিথো মুর্মুদের। কবিতা লিখেই সে ঋণ শোধ করতে চেয়েছেন। জনপদ জীবনের জনপদাবলি রচনা করতে চেয়েছেন, এমনকি সক্ষম হয়েছেন। অভাবী মানুষের বেদনাকে সত্য জীবনচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে লীলাদি। কবিতার শিরোনাম হয়ে ওঠে ‘শীলাদি’। লীলা, শীলা এখানে ধ্রুবক। গ্রামজীবন থেকে কত নারীই তো হারিয়ে গেছে। একটি দুটি ছোটো কবিতায় কি সে চিত্র ধরে রাখা সম্ভব? না জীবনের বিস্তৃত পরিসরের কথা বলা সম্ভব! কিন্তু এই মানুষগুলি সম্পর্কে যে হৃদয়ে অনেক কথা জমেছে। তাই তো কবিতার পাশপাশি মহাকাব্যিক উপন্যাস রচনা করতে হয়েছে কবিকে। মাওবাদী, লালগরের কথা আমরা জানি। কিন্তু মানুষগুলি কেন মাওবাদী হল সে প্রশ্ন কি তুলেছি? স্মৃতি রোমন্থনে কেটে যায় কবির দিনকাল। শহরে থাকলেও মন পড়ে থাকে গ্রামে। নিজের প্রিয় নেশা বলতে তিনি উল্লেখ করেছেন—“সাঁওতাল-লোধা-ভুঁঞ্যা-ভূমিজ অধ্যুষিত জন্মভিটায় হুটহাট চলে যাওয়া।“ জীবন থেকে হারিয়ে গেছে লীলাদি। পরে রয়েছে সারি সারি শালবন। দেখা মেলে একটি ছোট মেয়ের। শৈশবে এমনই হয়ত ছিল লীলাদি বা এমনভাবেই দেখা মিলত, খেলা চলত। আজ তো স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। লিখতে হয় কবিতা—

“লীলাদি তোমাকে খুঁজতে আজ লালগড়ে

লালপেড়ে শাড়ি পরে তুমি তো সামনে এসে

দাঁড়ালে না? যে দাঁড়ালো তার নাম শাল

কখনও কেউ কী ভুলে শালবনে ফেলে গেছে নিরবধি কাল”

(শীলাদি, তদেব, পৃ.৩৫)

জন্মভূমির স্মৃতিচারণ, স্বজন-প্রিয়জনের কথা বড় হয়ে উঠেছে ‘যৌবনে কাদের মুখ’ কবিতায়। কৈশোর, বাল্যকাল ও যৌবনে যে সরল হাসিমাখা মুখগুলি কবির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তা সরলরেখার মতো করে উঠে এসেছে। মাতা-পিতা, সুলতাবোন, মৃন্ময়চাচা, কেদারের বউ, সুনা সাঁওতাল, কাকিমা, বাসনবালার মেয়েদের ফুটে উঠতে দেখি। এক আপাত সহজ সরল জীবনবোধ ও যাপনচিত্র থেকেই কবিতা গুলি গড়ে উঠেছে। জন্মভূমির নিকেতনের যে শস্য বীজ, যা দ্বারা পালিত হয়েছে কবির জীবন সেই শস্য, নদী, পাখিদের কবি ভুলবেন কী করে। নলিনী বেরার কবিতা জন্মভূমির এক দায়বদ্ধতার রূপান্তর। তিনি যেন বলতে চান—হে জন্মভূমি তুমি আমাকে লালন করেছ, আমি কবিতা লিখে সব ঋণ শোধ করব। জীবন ও মানুষের প্রতি কোন অবিশ্বাস বা সন্দেহ-সংশয় নেই, আছে উদার আস্তিক্য বোধ যা ভালোবাসার নামান্তর। কবির যাপিত জীবনেও দেখেছি তিনি একেবারে সাধারণ। সাধারণ হওয়ার ফলে সেই মানুষগুলির প্রতি এক স্বজাতি প্রীতি যেন অধিক। সময় বহিয়া যায়। কৈশোর যৌবনে এসে দাঁড়ায়। যৌবন চলে যায় বার্ধক্যের দিকে। বয়স যতই বৃদ্ধি পায় মনে এক করুণা বোধের সৃষ্টি হয়—

“এদের অস্তিত্ব নিয়ে আমার ভিতর বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস নেই

মিথ্যার কেশর নিয়ে টানাটানি কদাচ করিনি, হায়

জলের ভিতর গিয়ে জলশাঁখ ভুলেও তুলিনি, তবু

আমার যৌবন আমাকে নিয়ে রোজ ডিব্রুগড় যায়।”

(যৌবনে কাদের মুখ, তদেব, পৃ. ৪৩)

জন্মভূমির নায়ক নলিনী। বহু উপন্যাসে তিনিই কথক। নিজের জীবন সহ চারপাশের জীবন নিয়ে তার আখ্যানভূমি গড়ে ওঠে। সেখানে প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে। এ যুবকের প্রতি প্রেমে পড়া সহজ। প্রেমে পড়েছেও কেউ কেউ। কবিও পড়েছেন। রচিত হয়েছে ‘কাঠগোলাপ’ কবিতা। কিন্তু প্রেম মরে গেছে। সাঁওতাল, লোধা নারী পায়নি নায়ককে। দূরত্বই বুঝি সে কারণ। কিন্তু অনুভূতি তো মরে যায়নি। দুরত্ব সেই অনুভূতিকে আর গাঢ়তর করেছে। কবিতায় শুনতে পাই—“বরঞ্চ কাঠবৃক্ষ তুমি হও শমীবৃক্ষ, তোমার কোটরে চাপা থাক বর্ম ও ধনুক জীবন ধারণ/আমিই অর্জুন।।” (কাঠগোলাপ, তদেব, পৃ. ৪৮) সুবর্ণরেখা তীরবর্তী জীবন নিয়ে রচিত হয় ‘বারমাস্যা’ কবিতা। যে জীবনে দুঃখ-বেদনা, নিত্য অভাব বিদ্যমান তা যে নবযুগের বারোমাস্যা হবে তাই তো স্বাভাবিক। এইসব কবিতা পড়তে গিয়ে অন্তরে এক বেদনা অনুভব হয়। সে বেদনা আরও গাঢ়তর হয় কবির অনবদ্য শব্দচয়নে। ছাগল চরাণী মিনুকে পাই এই কবিতায়। মাতা অভাবী সংসারের সাতকাহন বলে চলেছেন। আছে শোষকের অত্যাচার, ঠকবাজ ডাক্তারের কার্যকলাপ, সরকারের অপদার্থতা, গ্রাম্য সুদের অত্যাচার। ফসল হয়নি। অভাবের তাড়নায় মিনুর দিদি ফলিডল খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। গৃহকর্তাকে দিতে হয়েছে নাকখত। কবি অনেকগুলি সংবাদ পরপর বলে চলেন এ কবিতায়। যে সংবাদগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে অভাবী মানুষের যন্ত্রণাময় জীবন। সে জীবন সুবর্ণরেখা তীরবর্তী অঞ্চলের। এইসব মানুষগুলির প্রতি কবির অন্তরের টান। এদের দেখে মনে এক তীব্র বেদনাবোধ অনুভব করেন। ছুটি পেলেই চলে যান এইসব মানুষগুলির কাছে। যতটা পারেন অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। মানুষগুলির ব্যথা বেদনা যেন চোখে জল এনে দেয়। সেই জল দিয়েই তিনি যেন অক্ষরমালা বুনে চলেন। মেকি জীবন বা ফ্যান্টাসি নয় সত্যজীবনের মর্মচিত্র ফুটিয়ে তুলতে তিনি বদ্ধপরিকর। যে কবির কাছে এমন জীবন আছে তিনি কেনই বা ভিন্ন সত্যের খোঁজে যাবেন। যেতে হয়নি নলিনী বেরাকেও। জন্মভূমিই যেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এইসব কবিতা। সেই সব অভাবী মানুষের সত্যজীবনের একটু স্বাদ নেওয়া যাক—

“অতদূর নাকখ্‌ত দেওয়া কি আমাদের সহ্য হয়

আবার কখন জুলুম হবে চাবুক মারার-ঐ ভয়

ফলিডলে মরেছে মিনুর দিদি আজও ভুলিনি শোক

 

কবুল করছি বাবা সারলোনে কিনিনি সার এক ছটাক

ট্যাকাগুলো খোকার অসুখে খেয়ে গেছে সুখেন ডাক্তার

ধান পান না বাঁচুক বাবা বেঁচেছে আমাগো পোলাপান।”

(বারোমাস্যা, তদেব, পৃ.৫৩)

কবি কখনও হয়ে যান ক্ষিতীশ বা ক্ষিতীশদাদা। মিনুর বয়স বৃদ্ধি পায়। শরীরে যৌবন প্রবেশ করে। ভাঙা খাটিয়া বসার অনুপযুক্ত। তবে খাটিয়াটা বিরাজ করে। কবিকে পৃথকভাবে নান্দনতত্ত্বের পাঠ দিতে হয় না। আটপ্রৌঢ় শব্দ বিন্যাসেও কবিতায় এক মাধুর্য বিরাজ করে। ‘এইসব’ কবিতায় কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন। কবি প্রশ্ন করেছেন ক্ষিতীশকে। বড় ‘আমি’র কাছে এ যেন ছোট ‘আমি’র প্রশ্ন। কবি নিজেই নিজের সত্তার কাছে, চেতনার কাছে গ্রামের কথা শুনে নিতে চাইছেন। স্মৃতিতে যে অজস্র দৃশ্য জমা হয়ে রয়েছে সেগুলি রোমন্থন করে নিতে চাইছেন। স্মৃতিতে ডুব দিতেই উঠে আসছে একের পর এক দৃশ্য। এ যেন ‘কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’। সেই দৃশ্যগুলিকেই তিনি লিপিবদ্ধ করে চলেন। উঠে আসে জন্মভূমির কথা—

“ক্ষিতীশ, গাঁয়ের কথা তুই কিছু বল

বল, উত্তরে সুবর্ণরেখা দক্ষিণে জঙ্গল

আরও ঘুরে পশ্চিমে গাঁয়ে যেতে বামে

বামনপাড়া সীতানালা শিবের মন্দির দোপাটি জঙ্গল”

(এইসব, তদেব, পৃ.৫৫)

‘সরস্বতী পূজা’, ‘পতঙ্গ’ কবিতায় পাল্টে যায় ক্ষিতীশ। নিজের সত্তা থেকে পৃথক হয়ে যায়। এইসব কবিতায় ক্ষিতীশ কবি বন্ধু হিসেবে উপস্থিত হয়। কবি ক্ষিতীশকে সামনে রেখে গ্রামের গল্প বলেন। বাল্যকালের সরস্বতী পূজার স্মৃতি যেমন স্মরণ করেন তেমনি গ্রাম থেকে নগর কলকাতায় এসে গ্রামের কথা স্মরণ করেন। গ্রামের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সত্তা বিচ্ছিন্ন হয়নি। জননী-জন্মভূমির সঙ্গে সন্তানের সত্তা কখনও বিচ্ছন্ন হয় না। হওয়া সম্ভব নয়। সেই শেকড় সন্ধান বড় হয়ে ওঠে। গ্রামে বড় হওয়ার এ এক নির্মম ট্র্যাজেডি। কর্মের সন্ধানে, বৃহৎ জীবনের সন্ধানে গ্রাম ত্যাগ করতে হয়। কেউ কেউ আধুনিক হবার পাল্লায় পড়ে নিজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভুলে যান। নলিনী বেরা আপাত অর্থে সেই আধুনিকদের (প্রকৃত পক্ষে অনাধুনিক) শ্রেণিতে বিচারণ করেন না। কবির স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ জুড়ে জননী-জন্মভূমি সদা বিদ্যমান। চেতন-অবচেতনে যেন ফেলে আসা জন্মভূমির কথাই বারবার বেজে ওঠে—

“এখন আমি অনেক দূরেই যেতে পারি বলতে গেলে অনেক দূর

এখন আমি অনেক কথাই বলতে পারি বলতে গেলে সমুদ্দুর

সেই আমার মায়ের কথা গাঁয়ের কথা—পুরানডিহি

নদীর ধারে বালির চড়ায় শুয়ে আছে বোষ্টুমী

 এখন বসত ছেড়ে বিদেশ যাব-সওদাগর

খোলামেলা তালাবিহীন থাকুক আমার পুরান ঘর”

(যৌবন, তদেব, পৃ.৫৮)

‘কলকাতা কলকাতা’ কবিতায়ও ফেলে আসা গ্রাম বড় হয়ে ওঠে। তিলোত্তমা নগর কলকাতার অপূর্ব সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করে না। মন পড়ে থাকে সেই সুবর্ণরেখা তীরবর্তী অঞ্চলে। চারিদিকে সৌন্দর্যের হাতছানি। কোলাহলমুখর জনজীবন। চারতলার উপরে বসে প্রকৃতির চিত্র দেখেন বটে। কিন্তু  গ্রাম্য প্রকৃতির সে স্নিগ্ধ রূপ খুঁজে পান না। তাই কবিতায় উঠে আসে—“পঞ্চান্নর বি ফ্রী স্ট্রীট কলকাতা ষোলর দুপুর/ মগ্ন হয়ে খুঁজে ফিরি গ্রাম, আমার নিজের গাঁ, সে কোথায়” (কলকাতা কলকাতা, তদেব, পৃ.৬০) স্বজন-প্রিয়জনের চিত্র বৃহৎ সত্যে ধরা দিয়েছে ‘ঝাড়গ্রামে দীঘল শাল’ কবিতায়। সাঁওতাল-শবর-লোধা মানুষগুলিকে তিনি নিজের সত্তা থেকে কখনোই পৃথকভাবে দেখেননি। কবিতায় শুনতে পাই—“যে যায় খাদানে রানীগঞ্জে ঝরিয়া আসানসোলে/ যে মরে বিহারে চাসনালা বাথানীটোলায়—/ বোড়ো জঙ্গীদের অসমে আগরতলায়, সে আমার ভাই” (ঝাড়গ্রামে দীঘল শাল, তদেব, পৃ. ৭২) বৃহৎ চেতনা না হলে এই মহান সত্য উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। স্বজন-স্বভূমির মানুষের প্রতি এমন উচ্চারণ বৃহৎ স্বদেশচেতনায়ই নামন্তর তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তিনি জানেন এই সাবঅলর্টান মানুষগুলির পরিণতি। তবুও মুখ ফিরিয়ে নেননি। তথাকথিত ভদ্র সমাজ থেকে অনেক দূরে এই মানুষগুলির অবস্থান। কবি যেন গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেন আমি তাদের প্রতিনিধি, এখানেই যেন তার অহংকার। বাল্যকালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ফ্রি প্রাইমারি’ কবিতা। এই ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের কথা নলিনী বেরার গল্পে একাধিক বার এসেছে। জরুরি তথ্য হিসেবে জানানো যেতে পারে কবি গ্রামের স্কুলের প্রাচীর নিজ অর্থব্যয়ে নির্মাণ করে দিয়েছেন। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর না হলে এমন কার্যকলাপ সম্ভব নয়। ফলে শৈশবের স্কুল বা ফেলে আসা গ্রামের যেকোন স্মৃতি বা মুহূর্তের কথা তার লেখায় ফুটে ওঠা স্বাভাবিক। সেই সহজ সত্যটাকেই কবি বারেবারে নানা পরিসরে ধরতে চেয়েছেন।

অনবদ্য কবিতা ‘সে জানে শুশনি পাতা’। এই কবিতার নামেই কাব্যের নামকরণ, আর কবিতাটি স্থান পেয়েছে সর্বশেষে। আসলে স্বদেশ, স্বজনভূমির যে স্মৃতিচারণা তিনি ‘চন্দ্রপূজা’ ‘সুবর্ণরেখা’ দিয়ে শুরু করেছিলেন তা এখানে এসে সমাপ্ত হয়েছে। এমনকি বলা যেতে পারে স্বভূমির স্মৃতিচারণার শীর্ষবিন্দুতে এসে পৌঁছেছেন এই কবিতায়। নিজের স্বভূমির সম্পূর্ণ বৃত্তান্তটি লেখক কৌশলে ছোট্ট কবিতায় বলে বিদায় নিয়েছেন। কিছু কিছু কবিতা রয়েছে যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রাখে না। কবি নিজেই সহজ ভাষায় সহজ জীবনের কথা বলে যান। নলিনী বেরা কোনো আড়াল-অবডাল বা হেঁয়ালি নয় সরাসরি জন্মভূমির কথা সহজ ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। রোহিণীগ্রাম, রোহিণী রুক্মিণীদেবী হায়ার সেকেণ্ডারী স্কুল, সুবর্ণরেখা, বাছুরখোঁয়াড় গ্রাম, জঙ্গল মহল, ছোট নদী ডুলুং এর কথা যেমন উঠে আসে তেমনি সুধাংশু সরখেল, মাধুব-যাদব, মৃগাঙ্কদের কথা। সমালোচকের বিশ্লেষণ অপেক্ষা কাব্যপাঠ শতগুণে শ্রেয়। অমৃতের স্বাদ কেই-বা অন্যের রসনা দ্বারা গ্রহণ করতে চায়। এবই বাজারে সুলভ নয়। সবদিক থেকে চিন্তা করে পাঠকের পিপাসা চরিতার্থ করতে কবিতার একটি বৃহৎ অংশ (ধৈর্য্যহীন পাঠক বাদ দিতে পারেন) তুলে ধরা গেল—

“নদীর ওপারে গ্রাম বাছুরখোঁয়াড় নাম আটত্রিশ জে এল নম্বর

ঝাড়খণ্ডী জঙ্গল মহল—আঁটারি চুরচু কইম করম গাছে বিদিত ভুবন

চরাতে বাঞ্ছার গরু ক্লান্ত হয়ে পড়ে মুড়ু তরুতলে পাতিয়া ন্যাপকিন

যদি ঘুমে মূর্ছা যায় হে পান্থপথিক ডেকে তুলে প্লিজ আক্স হিম

‘আমাদের গ্রাম আওয়ার ভিলেজ’ কাব্যের কবি অকবি ললিন

কোথায় থাকেন হে? ‘আই কান্ট সে’—যদি বলে জেগে উঠে মুড়ু

অবাক হয়ো না তুমি প্রমথর ছোটভাই মৃগাঙ্গ ‘ব্রেকেটে মুড়ু’ বি এ পার্ট টু

হয়নি চাকরি মুড়ু তাই গোষ্ঠবিহারী, নিজেদেরও গরু নেই বাঞ্ছাদের গরু

 

এখানে ললিন নামধেয় দুজন যুবক—বড় ললিন আর ছোট ললিন

সে-সব তোমার জানার কথাও নয়, সে জানে শুশুনিপাতা সে জানে নবীন”

(সে জানে শুশুনি পাতা, তদেব, পৃ. ৮০)

এক স্নিগ্ধ অনুভূতি নিয়ে নলিনী বেরা সাহিত্যে বিচারণ করেছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস যাই লিখুন না কেন এইসব প্রেক্ষাপট ও মানুষগুলিই তার মূলধন, কাঁচামাল। আখ্যানভূমি বা কবিতার প্লটের জন্য তিনি দূর দেশে যাননি। সংগতভাবেই যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। স্বদেশ-স্বজন-স্বভূমির মানুষদের হয়ে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেইসব তথাকথিত সাবঅলটার্ন মানুষগুলি নিজেদের দুঃখ কষ্ট ভাষায় লিখতে পারে না। তবে তাদের বেদনা নেই, তাদের আছে ললিন বা নলিন ভাই। তারা জানেন তাদের বেদনাগুলি নলিনভাইই লিপিবদ্ধ করবে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নলিনী বেরা যেন একের পর এক মহাকাব্যিক আখ্যান গড়ে তোলেন। শুধু দায়বদ্ধতাই নয় আছে শেকড়ের প্রতি গভীর টান, জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা। সেই ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ এইসব কবিতাগুলি।

লেখক : অধ্যাপক, রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন