সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছেন সলিল চৌধুরী। খুব ইচ্ছে তাঁর লেখা কয়েকটা গান যেন ‘হেমন্তদা’ রেকর্ড করেন। সলিল তাঁকে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের জন্য বাঁধা কয়েকটি গান শোনান। সেই গান শুনে হেমন্ত বললেন, ‘না, এখন এই গান রেকর্ড করা যাবে না। অন্য কোনও গান থাকলে শোনান।’ তখন সলিলের কাছে নতুন কোনও গান নেই। তাই বললেন, ‘এখন নতুন কোনও গান নেই। পরে তাহলে আপনাকে কয়েকটা গান শুনিয়ে যাব।’ একথা বলে সলিল বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। পকেটে লেখা নতুন কবিতার অর্ধেক লেখা ছিল। ফিরে গিয়ে হেমন্তকে বললেন সেই কথা। হেমন্ত বললেন, ‘শোনান’। সেই অর্ধেক কবিতা শুনে হেমন্ত বললেন, ‘হ্যাঁ এটা চলতে পারে। গানটা সম্পূর্ণ করে নিয়ে আসুন।’ সেই গান সম্পূর্ণ হল। হেমন্ত রেকর্ড করলেন আর সেই গান নিমেষে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আজও বাঙালি সেই গান তন্ময় হয়ে শোনে। ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো…’। আজও কোথাও বেজে উঠলে পথ চলতি মানুষ থমকে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনেন সেই মরমী, অবিস্মরণীয় গান।
সলিল চৌধুরী মানে বাংলা গানের এক আইকন। যিনি রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদের পরবর্তী সময়ে বাংলা আধুনিক গানে এক নতুন জগৎ তৈরি করলেন। বলা হয় যেখানে শেষ করেছিলেন পঞ্চকবি, সেখান থেকেই যেন নতুন আলোকবর্তিকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন গানের ‘রানার’ সলিল চৌধুরী। শচীন দেব বর্মন কিংবা পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীত বৃত্তের বাইরে গিয়ে তিনি তৈরি করলেন নতুন গানের সরণি। গানের কথায় এবং সুরে তিনি নবযুগ ও জীবনের তৃষ্ণাকে নিবারিত করেছিলেন। রাজনৈতিক গান থেকে শুরু করে রোমান্সের সবুজ তৃণভূমি পেরিয়ে প্রেমের গানের এক মায়াজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতিটি গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এক নিরুচ্চার দায়বদ্ধতা। বাংলা গানের সঙ্গে সঙ্গে মাতিয়ে দিলেন হিন্দি গানের শ্রোতাদেরও। আসমুদ্রহিমাচল দুলে উঠল তাঁর গানের মেলোডিতে। অথচ তাঁর প্রথম বোম্বাই যাত্রা ছিল একজন গল্পকার হিসাবে।
সলিল চৌধুরীর গানের যে অভীযাত্রা, তার মূলে ছিল এক গভীর তাগিদ। সেই তাগিদ ছিল সমাজের প্রতি এবং একইসঙ্গে মানুষের প্রতি। এই দায়বদ্ধতা তাঁর ভিতরে সুপ্ত আকারে ছিল। সেটা প্রকাশ পেল গণনাট্য সঙ্ঘের সংস্পর্শে এসে। ১৯৪৩ সালের ২৫ মে তৎকালীন বোম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় গণনাট্য সঙ্ঘ। আসলে বিশ্বজুড়ে তখন হিটলার, মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত আস্ফালন, সেই আন্দোলনের সঙ্গে মিশে গেল স্বদেশ ভাবনা। পাশাপাশি বাংলায় দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা মিলে সে এক মহাসঙ্কটকাল। শিল্পী-সাহিত্যিকরা এই প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার সৃষ্টিতে মেতে উঠলেন। সেই গান আর সংস্কৃতি চর্চায় মিশেছিল নতুন সমাজের শপথ। সেই আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য, পৃথ্বীরাজ কাপুর, ঋত্বিক ঘটক, শম্ভু মিত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, খাজা আহমেদ আব্বাস, সলিল চৌধুরী সহ আরও অনেকে। সলিল চৌধুরীকে চিনতে গেলে সময়ের এই পরতটুকুকে জানা দরকার। তা নাহলে ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ গানগুলির আত্মাকে শ্রোতারা যথার্থভাবে স্পর্শ করতে পারবেন না। গত শতাব্দীর চারের দশকে তাঁর লেখা গানগুলিতে ছিল সমাজমনস্কতার অঙ্গীকার। কিন্তু একটু একটু করে মন ভাঙছিল, বুঝতে পারছিলেন, কমিউনিজমের ভিতরে একটা অহঙ্কারের বাষ্প জমে তা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। তাঁর কয়েকটি গান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল পার্টি। পার্টির ভিতরে ঢুকে পড়া বেনোজল দেখে আহত হলেন সলিল। মন তাঁর চাইছিল না আদর্শহীনতার সঙ্গে আপস করতে। ভিতরে ভিতরে মন বলছিল, ‘মানব না এ বন্ধনে’। ইচ্ছে করছিল বোম্বাই পাড়ি দেওয়ার। পরিচালক বিমল রায়ের ফোন পাওয়ার পর আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি। বিমল রায়কে গিয়ে তাঁর লেখা গল্প ‘রিক্সাওয়ালা’ শোনালেন। বিমল রায় ঠিক করলেন, এই গল্প অবলম্বনে ছবি বানাবেন। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় লিখে ফেললেন চিত্রনাট্য। তাঁকে সাহায্য করলেন সলিল। বিমল রায় ছবির নাম দিলেন ‘দো বিঘা জমিন’। সুরকার হিসাবে ভাবলেন অনিল বিশ্বাসের কথা। সেকথা শুনেই হৃষিকেশ বললেন, ‘এক কাজ করুন বিমলদা। গল্পটা তো সলিলের, ওকেই সুরের দায়িত্বটা দিন না। থিমটা ওর কাছে পরিষ্কার, তাই ওর সুর বাঁধতে সুবিধা হবে।’
কথাটা মনে ধরল বিমল রায়ের। ছবি রিলিজ করার পর মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল সেই গান। মান্না দের কণ্ঠে ‘ধরতি কহে পুকারকে’। লতা মঙ্গেশকর গাইলেন ‘আজা রে আ নিন্দিয়া’। গানগুলি সুপারহিট হল। মজার কথা হল, এই গানে তিনি নিজের পছন্দের অর্কেস্ট্রাইজেশন করতে পারলেন না। কিন্তু মন বলছিল অর্কেস্ট্রাইজেশন প্রথা ভেঙে নতুন করে বাঁধতে না পারলে কালজয়ী কিছু বোধহয় সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এবার স্টেপ আউট করে ওভার বাউন্ডারি মারলেন। বিমল রায়ের ‘মধুমতী’র গানে সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন করে ফেললেন তামাম দেশবাসীকে। ‘সুহানা সফর’, ‘দিল তড়প তড়প কে’, ‘ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল ধড়কে’, ‘আজা রে পরদেশি’ গানগুলি আসমুদ্রহিমাচল আচ্ছন্ন করে ফেলল। একদিন মুম্বইয়ে কোনও এক স্টেশনের বাইরে শুনলেন এক ভিক্ষুকের কণ্ঠে ‘আজা রে পরদেশি’ গানটি। বুঝলেন, এটাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
সলিল চৌধুরী আগামী ১৯ নভেম্বর শতবর্ষে পদার্পণ করবেন। বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন অসমের চা বাগানের ডাক্তার। তাঁর সংগ্রহে ছিল অনেক পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সংগ্রহ। ছেলেবেলায় সেই গান শুনে কান তৈরি হয়ে গিয়েছিল সলিলের। সেই সঙ্গে দেশের লোকসঙ্গীত এবং হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের নিবিড় মিলন ঘটল তাঁর মধ্যে। ধীরে ধীরে খুঁজে পেলেন আত্ম-উন্মোচনের পথ। সেই সময় তিনি যুগের প্রয়োজনে লিখতে শুরু করেন একের পর এক গণসঙ্গীত। সেই গানের মধ্য দিয়ে যেন জেগে উঠেছিলেন এক প্রতিবাদী নাগরিক কবিয়াল। ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’, হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’ ইত্যাদি গানে ছিল বিশ্বায়নের স্বপ্ন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে সলিল যেন নতুন পরশপাথরের সন্ধান পেলেন। একের পর এক অবিস্মরণীয় গান সৃষ্টি হল তাঁদের যুগলবন্দিতে। ‘রানার’, ‘পাল্কির গান’। এমনি কয়েকটা সুপারহিট গানের পর দু’জনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হল। স্বার্থান্বেষীরা মিথ্যা কথা ছড়িয়ে সেই দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সার্থক হয়নি। তাই আবার দুই প্রতিভা কাছাকাছি আসে। নতুন করে সৃষ্টি হয় কয়েকটি অমর গানের। ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘ধিতং ধিতাং বোলে’, ‘আমায় প্রশ্ন করে’, ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’ সহ অজস্র গান আজও মানুষ তন্ময় হয়ে শোনেন।
জীবনের লড়াইয়ের প্রথম পর্বে তাঁর পাশে ছিলেন জ্যোতি চৌধুরী। বাড়ির অমতেই জ্যোতি বিয়ে করেছিলেন গৃহশিক্ষক সলিলকে। বম্বেতেও সে ছিল এক কষ্টের জীবন, তবু কত আনন্দের! তখন বাড়িতে বিমল রায় আসছেন, আসছেন নবেন্দু ঘোষ, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, গীতিকার শৈলেন্দ্র। গান লেখা হচ্ছে, সুর হচ্ছে, ছবি নিয়ে চলছে আলোচনা। আর সেই আড্ডায় চা এবং আমতেল দিয়ে মাখা মুড়ির জোগান দিয়ে চলেছেন জ্যোতি। বম্বেতে পরপর হিট হল ছবি। ‘বিরাজ বৌ’, ‘পরখ’, ‘ছায়া’, ‘কাবুলিওয়ালা’। সৃষ্টিসুখের সেই উল্লাসের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে এল অর্থ, খ্যাতি। আর সলিল তখন জ্যোতির পাশ থেকে চলে গেলেন সবিতা চৌধুরীর কাছে। জীবনের এই ভারসাম্যের রক্ষার মধ্যেও একইভাবে সৃষ্টিশীল থেকেছেন সলিল। সবিতা চৌধুরীর কণ্ঠে দিয়েছেন অজস্র হিট গান। প্রত্যেক সঙ্গীত শিল্পী চাইতেন সলিলের গান গাইতে। কেননা সলিলের গান মানেই সুপারহিট।
এমনই আব্দার করেছিলেন রাজেশ খান্নাও। ‘আনন্দ’ ছবিতে ‘জিন্দেগি, ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ গানটি ছিল ব্যাকগ্রাউন্ডে। সেটা জানতে পেরেই রাজেশ খান্না বললেন, ‘এ গানে আমি লিপ দেবই। এ গান কখনও ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকতে পারে না।’ এভাবেই সলিলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অজস্র ইতিহাস। কিছু তার লেখা আছে, কিছু এখনও লেখা হয়নি।
একবার শচীন দেববর্মন আক্ষেপ করে সলিলকে বলেছিলেন, ‘আমার পোলাডা কী যে সুর করে বুঝি না! আমার থিক্যা ও তোমারেই বেশি পছন্দ করে। তোমার চ্যালা হইসে। তোমার মতো হইতে চায়। তুমি ওরে একটু কও।’ সেকথা শুনে সলিল বলেছিলেন, ‘শচীনদা, পঞ্চমকে আটকাবেন না। ওকে ওর মতো হতে দিন। ওর গান একটা নতুন পথ খুঁজছে। ঠিক পেয়ে যাবে।’ রাহুল দেববর্মনকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন সলিল।
বাংলা ও হিন্দি গানের সম্পদ বাড়িয়েছেন সলিল। নতুন প্রজন্ম ইউটিউবে সার্চ করে তাঁর গান শোনে। তাঁর সঙ্গীত যেন চিরকালীন। আজকের জগঝম্প মিউজিকের যুগে যখন হারিয়ে যাচ্ছে মেলোডি, গানের বাণীর মর্যাদা, তখন বারবার মানুষ সলিল চৌধুরীর গানে সঙ্গীতের লাবণ্যকে আকুলভাবে পেতে চাইবেন। সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের এই আকাঙ্ক্ষাটুকুই যেন শতবর্ষের মুহূর্তে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।