‘দক্ষিণী’। বেহালা-ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের সাহিত্যসংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্র। সাহিত্যের নামে তাঁরা নিছক বিনোদনকে আসর জমাতে দেন না। হালকা বিনোদনের এই প্রমত্ত যুগেও ‘দক্ষিণী’তে চলে গুরুগম্ভীর আলোচনার আসর। বক্তার বক্তৃতার পরে শুরু হয় প্রশ্নোত্তরের পালা। এলাকার গুণীজনকে জানান সংবর্ধনা জানান তাঁরা। এই বছর সংবর্ধনা জানানোর জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন সাইকেলদাদাকে। এই সাইকেলদাদা আবার ‘দুর্বার কলম’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন প্রায় দুই যুগ। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। গত ১০ নভেম্বর সেই সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন শুভেন্দু বারিক, স্বপন মুখোপাধ্যায়, অসিত ঘোষ, সুকল্যাণ মজুমদার, অন্নপূর্ণা ঘোষ, সমরেন্দ্র মণ্ডল, প্রভাত রায়, সুতপা আচার্য প্রমুখেরা। বাৎসরিক সারস্বত সম্মাননা প্রদানের সঙ্গে ছিল স্মারক বক্তৃতা ‘বাংলা সংবাদপত্রে সাহিত্য’। সেই স্মারক বক্তৃতা দেন সাংবাদিক স্নেহাশিস সুর।
কিন্তু সাইকেলদাদাটি কে ?
সাইকেলদাদা হলেন সরকারপুলের অধিবাসী অমর নস্কর। এই সাইকেলে তিনি চষে বেড়ান বজবজ থেকে বেহালা, ঠাকুরপুকুর থেকে নিউ আলিপুর। পত্রিকা প্রকাশ করা তাঁর নেশা, বইমেলা সংগঠিত করা তাঁর নেশা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা তাঁর নেশা। পেশা? না, তেমন কিছু নেই। তাই সংসার না চলতে চলতে কোনরকম ভাবে চলে। স্ত্রীটি সর্বংসহা। চালিয়ে নেন। দুটি ছেলে। দুই বউমা। এখন ছেলেরা চাকরি-বাকরি করে। অল্প একটু হাল ফিরেছে সংসারের। বিশেষ করে ছোটবউমার বাস্তববুদ্ধি আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সামাল দিচ্ছে সব।
আরও ভালো চলত ‘দুর্বার কলম’। পত্রিকা চালাতে গেলে একটু ধরাধরি করতে হয়। ক্ষমতার বৃত্তে থাকেন যাঁরা, তাঁদের একটু তেল দিতে হয়। বত্রিশ পাটি বিকশিত করে হাঁ হুঁ করতে হয়। নস্করবাবু তা করবেন না। আপোষ তাঁর স্বভাবে নেই। তিনি আজন্ম প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সেই নজরুল ইসলামের ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে’। বিভিন্ন দলের মেজো-সেজো-ছোট নেতারা নানা সময় ধমকেছেন তাঁকে। থ্রেট কালচার। যা সব সময়েই ছিল নানান বেশে। বেশ কিছু বিশেষ সংখ্যা করেছেন তিনি। সেগুলির বিক্রয়যোগ্যতা আছে। সেদিকে সম্পাদকের হুঁশ নেই কোন। পতিরামের স্টলে সব বই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। পয়সা আনবার তাগিদ নেই।
সব সময় প্রাণের হিল্লোলে মশগুল। সব সময়ে মুখে হাসি। সব সময়ে এগিয়ে চলা। কথা বলতে ভালোবাসা। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ। বজবজ থেকে বেহালা। সেই মানুষটার গলার স্বর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। এ বছরের গোড়ার দিকে। আমার একটু সন্দেহ হল। দুর্গাদার কথা মনে করে। কবি দুর্গাদাস সরকার। তাঁরও এ রকম হয়েছিল। তারপর ধরা পড়ল ক্যানসার। আমার সন্দেহ সত্য হয়ে গেল। হ্যাঁ, ক্যানসারই। অমর নস্করের গলায় ক্যানসার হয়েছে। বেশ গুরুতর স্টেজ।
ক্যানসার। এই চারটি শব্দ শুনলে মানুষ মরার আগেই মরতে শুরু করে। সাপের কামড়ের মতো। শরীরে বিষের প্রতিক্রিয়া শুরু হবার আগেই প্রবল আতঙ্কে মানুষ এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। নস্করবাবু বিন্দাস। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’। মুম্বাই নিয়ে যাবার জেদ করলাম আমরা। সায় দিল ছেলে আর ছেলের বউ। সেখানে একের পর এক কেমো দেওয়া হল। মুম্বাই থেকে পত্রিকার কাজ করে যাচ্ছেন। ছড়া লিখছেন। অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে দেখে নিচ্ছেন মুম্বাই-এর এদিক-ওদিক।
মৃত্যুদূত সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বলে আমি ভয়ে মরছি। আর তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন মৃত্যুদূতের দিকে। ফিরে এলেন কলকাতায়। প্রায় চার মাস বাদে। চিত্তরঞ্জনে রেডিয়েশন হল। ১৪টা কেমো, ৩০ টা রেডিয়েশন। ভাবা যায়! শেষ হতেই আবার সাইকেল নিয়ে টো টো। আমার মেয়ে একদিন তাঁকে বকল খুব। ঘুরে বেড়াবার জন্য। আমার স্ত্রী বলল, এসবেই মন ভালো থাকবে তাঁর।
এই এসে গেল মনের কথা। মনে পড়ে গেল বিবেকানন্দের কথা — মানব মনের শক্তির কোন সীমা নেই। সান্দ্রা লেভিরা তো ক্যানসার আক্রান্তদের মনের শক্তি নিয়ে গবেষণা করে বলেছেন যার মনের শক্তি আছে, সে জয় করতে পারে ক্যানসারকে।
অমর নস্কর জয় করেছেন ক্যানসার। স্তব্ধ করে দিতে পেরছেন মৃত্যুর বিকৃত মুখব্যাদানকে। আর সেই ক্যানসারজয়ীকে সম্মানিত করল ‘দক্ষিণী’। স্বপনবাবু, অসিতবাবু, শুভেন্দুবাবুদের ধন্যবাদ।
দিলীপদার অসাধারণ বিশ্লেষণাত্মক বাস্তব ও সত্য প্রতিবেদন সাংবাদিক ও ছড়াকার, অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী অমর নস্করকে সাধারণ মানুষের সামনে মেলে ধরতে সহায়ক হয়েছে। দক্ষিণী সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের সারস্বত সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে দিলীপ দার দৃঢ় ও স্পষ্ট বক্তব্য আরো বিস্তৃত পরিসরে শ্রদ্ধেয় অমর নস্কর মহাশয়কে যথাযথ চিত্রায়িত করেছে। আমাদের ক্ষুদ্র কিন্তু আন্তরিক আয়োজন দিলীপদার উপস্থিতিতে পূর্ণতা পেয়েছে।