আজ থেকে একশ কুড়ি বছর পূর্বে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর বিখ্যাত গ্রন্থ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (প্রথম প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি, ১৯০৪)। বাংলা ভাষার যেসব গ্রন্থ শতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে উত্তরকালীন মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ ঠিক এমন একধরনের বই। রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন আলোচনা-সূত্রে গোটা উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি আর রামতনু লাহিড়ীর জীবন ছিল অভিন্ন। শিবনাথ শাস্ত্রী ব্যক্তি রামতনু লাহিড়ী ও নবজাগ্রত উনিশ শতকী বাংলাদেশকে অভিন্ন দৃষ্টিতে এই গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ শীর্ষক গ্রন্থ সম্পর্কে আলোকপাতের পূর্বে গ্রন্থের লেখক শিবনাথ শাস্ত্রীকে কিছুটা জেনে নেওয়া প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচনা করি।
দুই
উনিশ শতকের অন্যতম উজ্জ্বল আলোকিত মানুষ শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি দক্ষিণ চবিবশ পরগনার চাংড়িপোতা গ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরানন্দ ভট্টাচার্য আর মাতা কামিনী ভট্টাচার্য। উনিশ শতকের আরেক আলোকিত মানুষ, বিশিষ্ট সমাজ-সংস্কারক, সোমপ্রকাশ (১৮৫৮) পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন তাঁর মাতুল। শৈশব-কৈশোরে মাতুলালয়েই থাকতেন শিবনাথ এবং মামার আদর্শেই তিনি বড় হতে থাকেন। মামা দ্বারকানাথ শিবনাথকে খুব ভালোবাসতেন এবং আপন আদর্শে তাঁকে বড় করে তুলতে থাকেন। শৈশব-কৈশোরেই নানা বিষয়ে তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। অন্য বালকদের মতো খেলাধুলায় তেমন মন ছিল না শিবনাথের, বরং মামার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থপাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এভাবে শৈশব-কৈশোরেই শিবনাথের চেতনায় উপ্ত হয়েছিল উত্তরকালীন বিপুল সম্ভাবনার বীজ।
শিবনাথ শাস্ত্রীর পৈতৃক নিবাস ছিল চবিবশ পরগনার মজিলপুর গ্রামে। মজিলপুর পাঠশালায় তাঁর বাল্যশিক্ষা আরম্ভ হলেও তিনি সেখানে বেশিদিন পড়ালেখা করেননি। মামাবাড়ির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল তীব্র। এ-কারণে মামা দ্বারকানাথের তত্ত্বাবধানেই শেষ হয় তাঁর বাল্যের পাঠ। অতঃপর মামার ইচ্ছানুসারে শিবনাথ ভর্তি হলেন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। কলেজিয়েট স্কুলের পাঠ শেষ হলে শিবনাথ ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত সংস্কৃত কলেজে। সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৭২ সালে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এমএ পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করায় তিনি অর্জন করেন ‘শাস্ত্রী’ উপাধি। অতঃপর পারিবারিক পদবি ভট্টাচার্যের পরিবর্তে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘শাস্ত্রী’ উপাধি এবং তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন শিবনাথ শাস্ত্রী নামে।১
উনিশ শতকের মধ্যপাদে কলকাতা শহরে ব্রাহ্মধর্ম ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। সে-সময়ে শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব এড়ানো সম্ভব ছিল না। শিবনাথও ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর বাবা হরানন্দ ছিলেন রক্ষণশীল গোঁড়া ব্রাহ্মণ। কাজেই ছেলের ব্রাহ্মধর্মপ্রীতি তিনি ভালো চোখে দেখলেন না। শিবনাথের সঙ্গে হরানন্দের মতবিরোধ চরম আকার ধারণ করে। পিতা-পুত্রের বিতর্ক শিবনাথ-গবেষক ড. মিলন দত্ত তুলে ধরেছেন এভাবে —
সে সময়টায় ছিল ব্রাহ্মধর্মের জোয়ার। ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব এড়ানো শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শিবনাথও ছাত্রজীবনে ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্ম-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। বাবা গোঁড়া ব্রাহ্মণ। ছেলের এসব কাজের উপর ভীষণ রেগে গেলেন। স্পষ্ট বললেন, এই ‘বেম্মজ্ঞানী’দের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা চলবে না।
ব্রাহ্মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে দোষের কি আছে?
নিশ্চয় দোষের আছে। ব্রাহ্মরা হিন্দু নয়। ওরা না হিন্দু, না মুসলমান, না খ্রিষ্টান। ওরা এক অদ্ভুত জাত।
শিবনাথ বললেন, এটা আপনার ভুল ধারণা বাবা। ব্রাহ্মধর্ম উপনিষদের উপর ভিত্তি করে গঠিত। উপনিষদের ব্রাহ্মই হলেন উপাস্য। এক কথায় বলা যেতে পারে ব্রাহ্মধর্ম হলো প্রকৃত হিন্দুধর্মের নির্যাস। হরানন্দ রেগে গেলেন, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। দুদিনের ছেলে। তুমি আমাকে ধর্মশিক্ষা দিতে এসেছ ? হয় তুমি ‘বেম্ম’দের সংস্রব ছাড়ো, না হলে আমাকে ছাড়ো।
শিবনাথ মামার আদর্শে মানুষ। নরানাম্ মাতুলক্রমঃ। মামার মতোই জেদী। নিজে যা ভালো বোঝেন, তাই করেন। ব্রাহ্মধর্মের সংস্রব তাঁর পক্ষে ত্যাগ করা সম্ভব না। এই নিয়ে বাপ ছেলেতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ২
১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট শিবনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেন শিবনাথ, ছেদ করেন পরিবারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক। পিতা হরানন্দ শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেন, স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথও চিরকালের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ক্রমে শিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ইতোমধ্যে ১৮৬৮ সালে ব্রাহ্ম-আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪) প্রতিষ্ঠা করেন Indian Reforms Association। এ সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল মদ্যপান নিবারণ, শিক্ষা প্রসার, সুলভ সাহিত্য ও কারিগরি জ্ঞানের প্রচার, নারীশিক্ষা তথা নারীমুক্তি। এসব আদর্শের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে শিবনাথ যোগ দেন Indian Reforms Association-এ। শিবনাথ কেশবচন্দ্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে এসময় সমাজ সংস্কারমূলক অনেক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নারীশিক্ষার পক্ষে তিনি গ্রহণ করেন দৃঢ় অবস্থান, বিধবাদের বিয়ের পক্ষে তিনি উচ্চারণ করেন জোরালো বক্তব্য। কেশবচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় এসময় শিবনাথ মদ্যপান নিবারণ এবং শিক্ষা-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যা প্রচারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। সমাজে মদ্যপানের ভয়াবহতা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তরুণ সমাজকে মদ্যপানের ছোবল থেকে রক্ষা করার মানসে তিনি প্রকাশ করেন মদ না গরল শীর্ষক পত্রিকা।
শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় Indian Association’। এই সংস্থাই হলো ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সংঘবদ্ধ প্রয়াস। এই সংস্থার অনুপ্রেরণাতেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী গঠন করেন ‘গুপ্ত বৈপ্লবিক সমিতি’। এই সংস্থার প্রধান কর্মসূচি ছিল — জাতিভেদ অস্বীকার, সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান, সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, অশ্বারোহণ ও বন্দুক চালনা শিক্ষা, জাতীয়তামূলক ও সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। এসব উদ্দেশ্য থেকেই শিবনাথ শাস্ত্রীর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
শিবনাথ শাস্ত্রী বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৭৪ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরস্থ সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। দুবছর পর সাউথ সুবার্বন স্কুল ছেড়ে তিনি যোগ দেন হেয়ার স্কুলে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক রূপে। এ সময় মামা দ্বারকানাথ শিবনাথ শাস্ত্রীর ওপর হরিনাভী স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল দায়িত্বই তিনি পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় উল্লিখিত স্কুলগুলোতে পঠন-পাঠনে ইতিবাচক নানা পরিবর্তন সূচিত হয়। রাজনৈতিক কারণে ১৮৭৮ সালে হেয়ার স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি থেকে তিনি স্বেচ্ছায় ইস্তফা গ্রহণ করেন।
শিবনাথ শাস্ত্রীর বর্ণাঢ্য ও উজ্জ্বল কর্মজীবনের এক গৌরবজনক অধ্যায় তাঁর সাংবাদিক-জীবন। মামা দ্বারকানাথ-প্রতিষ্ঠিত সোমপ্রকাশ পত্রিকার সঙ্গে তিনি নানাভাবে জড়িত ছিলেন। দ্বারকানাথের ব্যস্ততার কারণে ১৮৭৩-৭৪ – এই দুবছর শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ পত্রিকা। বস্ত্তত, দ্বারকানাথই ছিলেন শিবনাথের সাংবাদিক জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণা। ১৮৮৩ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে সখা নামে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক প্রকাশিত হয়। অভিন্ন সময়ে তত্ত্বকৌমুদী (১৮৮২) এবং ইন্ডিয়ান মেসেজ (১৮৮৩) নামে দুটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকা সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৯৫ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিখ্যাত কিশোর মাসিক মুকুল। বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য বিকাশে এই পত্রিকা পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। উল্লিখিত পত্রিকাসমূহ সম্পাদনায় শিবনাথ শাস্ত্রী বিশেষ দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। (ক্রমশ)