সভ্যতার একেবারে আদিযুগ থেকে মানুষ ক্রমেই উত্তরণের পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। এই উত্তরণ আসলে অন্ধকার থেকে আলোয় উৎসারণের প্রক্রিয়া। মানুষের কাছে আলো তাই একটা শক্তি, প্রতীক। জীবনে আলোর উদ্ভাস এনে সে অন্ধকারকে বা অশুভ শক্তিকে দূর করতে সচেষ্ট হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা আলোর সাধনা করে চলেছি। কার্তিক মাস পড়লেই এখনও আমরা আকাশপ্রদীপ জ্বালি। দূরের তারার পানে চেয়ে সে সারারাত মিটমিট করে জ্বলে। বেদোত্তর যুগে এই আকাশপ্রদীপের উল্লেখ পাই। সেখানে বলা হয়েছে, আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে আমরা পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এই আলোক-তর্পণের মধ্য দিয়ে তাঁদের আবাহন করা হয়। তাঁরা ওই আলোর সরণি বেয়ে মর্ত্যে নেমে এসে আমাদের আশীর্বাদ করে যান। এছাড়া কার্তিক মাসের অমাবস্যায় আমরা দীপান্বিতা উৎসব পালন করি, কালীপুজো করি।
আমরা আজ যে কালীমূর্তির পুজো করি, তা এসেছে অনেক পরে। তার আগে থেকে অবশ্য দেশের মানুষ দীপান্বিতা উৎসবই পালন করতেন। কোথাও একে বলে দীপাবলি, কোথাও দেওয়ালি, আবার কোথাও একে সুখরাত্রি বা যক্ষরাত্রি বলে। প্রথম শতাব্দীতে প্রাকৃত ভাষায় লেখা ‘গাথা সপ্তশতী’তে আমরা দীপান্বিতার উল্লেখ পাই। আসলে অমাবস্যার আগে ত্রয়োদশী থেকেই যেন শুরু হয়ে যায় আলোর উৎসব। এই ত্রয়োদশীকে বলা হয় ধনত্রয়োদশী বা ধনতেরস। এই দিনে মূলত দেবী লক্ষ্মীর পুজো হয়। দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে যখন সমুদ্রমন্থন হয়েছিল, তখন ধনত্রয়োদশীর দিন দেবী লক্ষ্মী ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন। আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে যে সাতটি মহাসাগরের উল্লেখ আছে, ক্ষীরসাগর তার মধ্যে একটি। চতুর্দশী দিনটি পালিত হয় ভূত
চতুর্দশী হিসাবে। বলা হয় এই দিনে দৈত্যরাজ বলি ভূত, প্রেত, যোগিনী সহ পৃথিবীতে আসেন। পুরাণ কাহিনি বলছে, বিষ্ণু বামন অবতার হয়ে বলিরাজকে পায়ের চাপে পাতালে প্রবেশ করিয়েছিলেন। এই দিনে আরও একটি ঘটনার উল্লেখ পুরাণে পাই। প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকাসুর ১৬ হাজার গোপিনীকে বন্দি করেছিলেন। তাঁদের ওপর তিনি নির্যাতন চালাতেন। কৃষ্ণ সত্যভামাকে নিয়ে সেখানে যান এবং নরকাসুরকে বধ করে সেই ১৬ হাজার গোপিনীকে উদ্ধার করেন। তাই এই দিনটিকে নরক চতুর্দশীও বলা হয়। এছাড়া বলা হয় ভূত চতুর্দশীর দিনে দেবী চামুণ্ডা তাঁর ১৪ জন প্রেতসঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। পৃথিবীর যাবতীয় অশুভ শক্তির বিনাশ করেন তিনি। কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, গোয়া সহ বিভিন্ন রাজ্যে এই ভূতচতুর্দশীকে কেন্দ্র করে নানা রীতি প্রচলিত আছে। বাঙালিদের মধ্যেও এদিন ১৪ শাক খাওয়ার রীতি চালু আছে। অবশ্য পুরাণের পাশাপাশি অন্য ব্যাখ্যাও আছে। সেটা হল সিজন বদলের সময় আমাদের ওপর নানা ধরনের মরশুমি রোগের আক্রমণ ঘটতে পারে। তাকে ঠেকাতে এই ১৪ শাক খুবই উপকারী ভূমিকা পালন করে। আমরা এখন বাজার থেকে যে ১৪ শাক কিনে এনে খাই, তা কিন্তু শাস্ত্রে লেখা নেই। এই ১৪ শাক হল ওল, কেঁউ, বেতো, কালকাসুন্দে, সরষে নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চে, গুলঞ্চ, পলতা, শেলুকা, হেলেঞ্চা, ঘেঁটু, শুষনি। স্মৃতিশাস্ত্র রচয়িতা রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের ‘কৃত্যতত্ত্ব’ বইতে আমরা এর উল্লেখ পাই। তবে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে অন্য কয়েকটি শাকের কথাও বলা হয়েছে।
তারপরই অমাবস্যায় হয় কালীপুজো। কালী আসলে আমাদের জীবনে এক প্রতীক দেবী। তাঁর মূর্তি কল্পনার মধ্যেই রয়েছে নানা ব্যঞ্জনা। কালী সাধনার মধ্য দিয়ে আমরা যেন শক্তির সাধনাই করি। বাঙালি মূলত দক্ষিণা কালীর পুজো করে। এই কালীর রূপ ও সাধনার প্রবর্তন করেছিলেন নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। ষোড়শ শতাব্দীতে তিনি ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীর রূপ বর্ণনা করলেন। কালী করাল বদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, মুণ্ডমালিনী এবং দিগম্বরী। তাঁর উপরের বামহস্তে আছে খড়্গ, নীচের বামহস্তে ছিন্ন নরমুণ্ড। দক্ষিণহস্তে তিনি বর এবং অভয় দান করছেন। তাঁর পদতলে শায়িত শিব।
দেবীর এই কালীমূর্তি নিয়ে আমাদের অনেকেরই নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। কেন মায়ের রং কালো, কেন তিনি জিভ বের করে আছেন, কেন তাঁর গলায় মুণ্ডমালা ইত্যাদি। আসলে এই রূপের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে শক্তিতত্ত্বের এক ব্যঞ্জনা। যার সঙ্গে যোগ রয়েছে তন্ত্রের।
বলা হয় ‘কালং কলয়তি ইতি কালী’। অর্থাৎ যিনি এই বিশ্বের অনন্ত কালকে কলন করেন বা গ্রাস করেন, তিনিই কালী। মহাকালকে তিনি জয় করে কালী হয়ে উঠেছেন। তাই তিনি নিজেই শক্তির এক আধার। তিনি নিজে কালো হলেও তাঁর পায়ের নীচে অলৌকিক আলোর উদ্ভাস।
কালীর চার হাতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, এই চার হাত হল চারটি বেদের প্রতীক। কেউ বলেছেন এই চার হাত হল, জীবনের চারটি পর্যায়। ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ। কালী উপরের ডানহস্ত ধর্মের প্রতীক, নীচের ডানহাতটি অর্থের প্রতীক। তাঁর বামদিকের নীচের হস্তটি কামের প্রতীক এবং উপরের বামহাতটি মোক্ষের প্রতীক। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, কালীর পদতলে শিব কেন? তিনি তো তাঁর স্বামী! আসলে জীব যখন তাঁর অহংকে বিসর্জন দিয়ে মায়ের পদতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন তিনি আর জীব থাকেন না, তিনি শিবে রূপান্তরিত হয়ে যান। এ এক সাধনার মধ্য দিয়ে উত্তরণ। সাধক রামপ্রসাদের গানে পাই, ‘শিব নয় মায়ের পদতলে / ওটা মিথ্যে লোকে বলে। / দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে / মা দাঁড়িয়ে তার উপরে। / মায়ের স্পর্শে দানব দেহ / শিবরূপ হয় রণস্থলে।’ অর্থাৎ মায়ের চরণস্পর্শে আমাদের দানব সত্তা বা আমাদের সব কামনা, বাসনা, ঈর্ষা, জিঘাংসাবৃত্তি লুপ্ত হয়ে তা শিবে রূপান্তরিত হয়। শিব অর্থাৎ শান্ত। দেখা যায় শিবের গাত্রবর্ণ সাদা। এর তাৎপর্য হল, সমস্ত অন্ধকার দূর হয়েছে, অজ্ঞানতাও দূর হয়েছে। সেই ব্যক্তি তখন জ্ঞানমার্গে উন্নীত। সেই জ্ঞানের প্রতীকই হলেন শ্বেতশুভ্র শিব।
মানুষ আসলে অজ্ঞানতার পঙ্কে ডুবে আছে। তার জীবনযাপনে জড়িয়ে আছে নানা লোভ
হিংসা, কামনা, প্রবঞ্চনা, স্বার্থপরতার বিষাক্ত শ্বাস। সেই অজ্ঞানতার মধ্যে, মোহের আবরণে সে কীট হয়ে বাস করে। সেখান থেকে তাঁকে খুঁজে নিতে হবে জ্ঞানের আলো। তাই সাধক কবি মায়ের পায়ের জবা হয়ে ফুটে উঠতে বলেছেন। তার মধ্যেই আনন্দ এবং মুক্তিকে অনুভব করা যায়। কালী সাধকরাও সেই মায়ের পায়ের নীচের আলোটুকু হৃদয় দিয়ে
প্রত্যক্ষ করার জন্য সারাজীবন তাঁরই অনুধ্যানে ডুবে থাকেন। কমলাকান্ত বললেন, ‘কালোরূপে দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে আলো’।
এভাবেই শ্যামাসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সাধক যেমন মায়ের সন্ধান করেন, তেমনই গৃহী বাঙালি শ্যামাসঙ্গীতের সুধারসে নিজেকে ডুবিয়ে মাতৃনামের আনন্দ অনুভব করেন। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত থেকে শুরু করে ঈশ্বর গুপ্ত, গিরিশ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ সকলেই শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। পাশাপাশি বহু মুসলিম কবিও শ্যামার নামে গান বেঁধে অমর হয়ে আছেন শাক্ত পদাবলীর ইতিহাসে। নজরুল ইসলাম সাধকের মতোই কালীর নামে অসংখ্য গান বেঁধেছেন। এছাড়া গান লিখেছেন আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি, নওয়াজিস খান, হাসন রাজা সহ আরও অনেকে। ‘কালিকমঙ্গল’ লিখেছিলেন শাহ বারিদ খাঁ। মুনসি বেলায়েত হোসেন উৎকৃষ্ট শ্যামাসঙ্গীত রচনার জন্য ‘কালীপ্রসন্ন’ উপাধি পান। ধর্মের সংকীর্ণ বেড়াজাল ভেঙে তাঁরাও কালীর বন্দনা করেছেন।
বাংলা শাক্ত পদাবলীর গানে পান্নালাল ভট্টাচার্যের মতো এত জনপ্রিয়তা আর কেউ পাননি। ‘মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল সকলি পুরায়ে যায় মা।’ মানব জীবনের কী করুণ আর্তনাদ এই সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে। এই যে আমাদের এত লোভ, এত তৃষ্ণা, তা কি সত্যিই কোনওদিন নিবারিত হতে পারে? আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে মানুষ ক্রমেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। আর যখন একটু একটু করে আলো নিভে আসে, যখন জীবনের সব সঞ্চয় একটু একটু করে ক্ষয়ে যায়, তখন জীবন প্রদীপের সেই ম্রিয়মান আলোয় আমাদের ক্রন্দনধ্বনি বোধ হয় এভাবেই প্রকাশিত হয়ে ওঠে। মাগো, বাসনার পিছনে ছুটতে ছুটতে সময় তো অতিক্রান্ত, তোমাকে ডাকার সময় পেলাম কই! শ্যামাসঙ্গীত যেন মায়ের সঙ্গে সন্তানের সেই কথোপকথন। সেই কথার মধ্যে সন্তানের অনুযোগই বেশি। ‘মা আমায় ঘুরাবি কত, কলুর বলদের মতো’। ‘যে ভালো করেছো কালী আর ভালোতে কাজ নাই, / ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই।’ ‘কোন অবিচারে আমার পরে / করলে দুঃখের ডিক্রিজারি?’
তাই এখানে ভগবানের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক হল আসলে মা ও ছেলের। সব কিছু সাঙ্গ হলে পড়ে থাকে মায়ের চরণ। ভক্ত তখন আকুল স্বরে বলে ওঠেন, ‘আমি কর্মদোষে রইনু বসে পাপের বোঝা শিরে ধরি…/নে মা কোলে তুলে অভাগারে, দে মা তোর ঐ চরণতরী।’