দক্ষিণেশ্বরের ছোট ভট্টচায্যিমশাই শুধু ভবতারিণী মায়ের পূজা করেননি, ওখানে দিনের পর দিন বসবাস করে যে সব যুগান্তকারী কাণ্ডকারখানা করেছেন, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। এক একটা করে ধরা যাক। হিন্দুর মন্দিরে বসে দ্বাদশ বছর ধরে পৃথিবীর সব ধর্ম নিয়ে তিনি অনুসন্ধান করেছেনযাকে এ কালে রিসার্চ ও এক্সপেরিমেন্ট বলা হয়। আত্মসন্ধানের প্রথম পর্বে (১৮৬১-৬৪) তান্ত্রিকসাধনা, দ্বিতীয় পর্বে (১৮৬৪-৬৫) বৈষ্ণব সাধনা, তৃতীয় পর্বে অদ্বৈত সাধনা (১৮৬৫)। পরে (১৮৬৬) ইসলাম সাধনাকঠিন সাধনার পথপ্রদর্শক সুফি সাধক গোবিন্দ রায়। ঠাকুর নিজেই বলেছেন, “ঐ সময় ‘আল্লা’মন্ত্র জপ করতাম,…কাছা খুলিয়া কাপড় পরতাম, ত্রিসন্ধ্যা নামাজ পড়তাম।” এ বিষয়ে হৃদয়ের রিপোর্ট, “মামা যজ্ঞসূত্র ত্যাগ করে” নামাজ পড়ছেন। আর এক রিপোর্ট, গাজিপুকুরে রামকৃষ্ণ “পাঁচ বার নামাজ পড়তেন, মুসলমান খানা খেতেন এবং সকল বিষয়ে মুসলমান সমাজে প্রচলিত শিষ্টাচার পালন করতেন।” বেদিযুক্ত গাছের একটি স্মারকচিহ্নের কথা বিভিন্ন বইতে উল্লেখিত হয়েছে: “রামকৃষ্ণ এই স্থানে পীরসাধনা করেছিলেন।”
দক্ষিণেশ্বরে সাধিকা ভৈরবীর আগমনের পরে সব চেয়ে বড় ঘটনা, দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী তোতাপুরীর দক্ষিণেশ্বরে আগমন। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ইনিই ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ নামটি দিয়েছিলেন।
ভবঘুরে এই সন্ন্যাসীরা তিন দিনের বেশি কোথাও বাস করেন না, কিন্তু এ বার ব্যতিক্রমটানা এগারো মাস এখানে থেকে তিনি দক্ষিণেশ্বর গবেষণাগারের মাহাত্ম্য বাড়িয়ে গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্ট্যাটাস শেষ পর্যন্ত গৃহী না সন্ন্যাসী, এই প্রশ্নের অবসান অনেক আগেই হয়েছে। ঠাকুর তোতাপুরীকে ‘ন্যাংটা’ বলতেন এবং এঁর কাছেই সন্ন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় শাস্ত্রাদি ক্রিয়া গোপনে সেরে ফেলেন, গোপনীয়তার কারণ তিনি দক্ষিণেশ্বরে বসবাসকারিণী গর্ভধারিণী জননীর প্রাণে আঘাত দিতে চাননি। জননী চন্দ্রমণির দেহত্যাগও দক্ষিণেশ্বরে ১৮৭৬ সালে (পঁচাশি বছর বয়সে)। প্রাণ দিয়ে সেবাযত্ন করলেও সন্ন্যাসীর আচরণবিধি মান্য করে রামকৃষ্ণ নিজের মায়ের মুখাগ্নিও করেননি, শ্রাদ্ধকর্মও করেননি।
উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে দক্ষিণেশ্বরে আর দু’টি বড় ধরনের বৈপ্লবিক ঘটনা একই সঙ্গে কিন্তু প্রায় নিঃশব্দে ঘটেছিল। মার্চ ১৮৭২ : অর্ধাঙ্গিনী ১৮ বছর বয়সের পূর্ণযৌবনা সারদার দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিতি। এই দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে এখন পৃথিবার দেশে দেশে এবং স্বদেশেও নানা কৌতূহল ও গবেষণা। ঠাকুরের শ্বশুরবাড়িতে তখন গুজব রটেছে, তিনি পাগল হয়েছেন এবং উলঙ্গ হয়ে বেড়ান। রামকৃষ্ণজায়া নিজেই বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন, “রাত প্রায় ন’টার সময় দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছলাম।…আমরা তাঁর ঘরেই শুলাম। হৃদয় দু’ধামা না তিনধামা মুড়ি আনলে। তখন সকলের খাওয়া হয়ে গিয়েছে।”
মাস দেড়েক পরে দক্ষিণেশ্বরেই উনিশে-পা-দেওয়া নিজের পূর্ণযৌবনা স্ত্রীকে ষোড়শী পূজা করে নতুন এক এক্সপেরিমেন্ট করলেন আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ। শুনুন তাঁর স্ত্রীর মুখের বর্ণনা: “তিনি আমাকে পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন, কাপড় ছাড়িয়ে কাপড় পরিয়ে দিলেন, সিঁদুর দিলেন, পান মিষ্টি খাওয়ালেন…আমি মনে মনে প্রণাম করলাম।” মায়ের অনুরাগিণীরা ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। তাঁরা এই কাপড় ছেড়ে কাপড় পরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু স্ট্র্যাটেজিক প্রশ্ন করেছিলেন।
এই কালে ঠাকুরের পদসেবার সুযোগও গৃহিণীর ছিল। “ঠাকুর আমার পা টিপে দেখিয়ে দিয়ে বলতেন, এমনি করে টেপো।” আর একদিন ঠাকুর একাকী তাঁর ছোট খাটে বসে আছেন, সুযোগ বুঝে অর্ধাঙ্গিনী কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “আমি তোমার কে?” স্বামীর উত্তরটিও অবিস্মরণীয়, “তুমি আমার আনন্দময়ী মা।”
দাম্পত্যজীবনের আরও কিছু অন্তরঙ্গ বিবরণ সারদামণির স্মৃতি থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এক সময় টানা আট মাস তিনি ঠাকুরের সঙ্গে নহবতে বসবাস করেছেন। “আমার বয়স তখন আঠারো-উনিশ বছর হবে, ওঁর সঙ্গে শুতুম। একদিন বললেন, ‘তুমি কে?’ বল্লুম, ‘আমি তোমার সেবা কত্তে আছি।’ ‘কী?’ ‘তোমার সেবা কত্তে আছি।’ ‘তুমি আমার বই আর কাকেও জানো না?’ ‘না।’ ‘আর কাকেও জানো না?’ ‘না।’ ‘আর কাকেও না?’ ‘না।’ ”
দাম্পত্যসম্পর্ক ও কামনাময় শরীরের দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যাঁরা জটিল উপন্যাস রচনার ক্ষমতা রাখেন, তাঁরাও দক্ষিণেশ্বরের এই দুঃসাহসী দম্পতিকে বুঝতে পারেন নাআশঙ্কা করেন, কোথাও কিছু গোপনীয়তা আছে, অথবা কোনও গোলযোগ। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরবাসী মূল নায়ক-নায়িকা আনন্দে এবং সন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছেন। এঁদের ভক্তরাও নিষ্ঠার সঙ্গে পত্নীর স্বামীগৃহে যাতায়াতের হিসাবনিকাশ করেছেন এবং আমাদের জানিয়েছেন, সারদামণি স্বামীর জীবিতকালে ৮ বার দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন। প্রথম বার মার্চ ১৮৭২, দ্বিতীয় বার ১৮৭৪, তৃতীয় বার ১৭ মার্চ ১৮৭৬, চতুর্থ বার জানুয়ারি ১৮৭৭, পঞ্চম বার ফেব্রুয়ারি ১৮৮১, ষষ্ঠ বার ১৮৮২, সপ্তম বার ১৮৮৪ এবং অষ্টম বার মার্চ ১৮৮৫।
স্ত্রীকে অতি নিকটে থাকতে দিয়েও তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র ভোগেচ্ছা দেখতে পাননি। এক সময় স্বামীটি স্বীকার করেছেন, স্ত্রী যদি “আত্মহারা হয়ে তখন আমাকে আক্রমণ করত, তখন আমার সংযমের বাঁধ ভেঙে দেহবুদ্ধি আসত কি না, কে বলতে পারে? বিয়ের পর মাকে (জগদম্বাকে) ব্যাকুল হয়ে বলেছিলাম, মা, আমার পত্নীর ভেতর থেকে কামভাব এককালে দূর করে দে।”
দক্ষিণেশ্বরের ছোট ভট্টাচার্য যেমন তাঁর সাধনাস্থলে সম্মান পেয়েছেন, তেমনই কারণে-অকারণে যথেষ্ট অনাদর ও অবহেলাও পেয়েছেন। রানির জামাই মথুর তাঁকে সম্মান করেছেন, কিন্তু রানির দৌহিত্র ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস বেশ কয়েক বার তাঁকে অস্বস্তিতেও ফেলেছেন। কেশবচন্দ্র সেনের ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে দক্ষিণেশ্বরের নিয়মকানুনের পাল্লায় পড়েন বলে ঠাকুরের ভয় ছিল, খবরটা তিনি চাপাই রেখেছিলেন। ভক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে বলেছেন, “কাউকে বলো না, তা হলে কালীঘরে ঢুকতে দেবে না।” পরের দিন মন্দিরের খাজাঞ্চিকে দেখে বললেন, “দেখ, কাল কেশব সেনের কাছে গিয়েছিলাম। খুব খাওয়ালে। তা ধোপা কি নাপিত খাইয়েছে তা জানি না। আচ্ছা, এতে আমার কিছু হানি হলো?” (ক্রমশ)